Advertisement
২৩ ডিসেম্বর ২০২৪
Public Health

জনস্বাস্থ্য নিয়ে ছেলেখেলা

আমরা জেনে গিয়েছি যে, করোনাভাইরাস ক্রমে রূপ বদলায়, নতুন স্ট্রেনের ভাইরাস জন্ম নেয়।

অমিতাভ বন্দ্যোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ০৮ জানুয়ারি ২০২২ ০৭:২৭
Share: Save:

যুক্তি ও তর্কের প্রবণতা মানুষের একান্ত। যুক্তি শিক্ষা-নির্ভর, এই শিক্ষা পরিবেশ বা সমাজ থেকে আহৃত হতে পারে। প্রথাগত শিক্ষাব্যবস্থাও যুক্তি তৈরিতে সাহায্য করে। বিজ্ঞানীর যুক্তি পরীক্ষালব্ধ সত্যকে প্রতিষ্ঠা করে। আইনবিদ আইনের যুক্তি দিয়ে সত্য প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেন। সমাজতাত্ত্বিকরা সামাজিক সংস্কারের যুক্তি দেন। রাজনীতিকদের যুক্তি সুবিধামতো বদলায়, তা প্রতিষ্ঠা করার জন্য তর্কেরও শেষ নেই। অতিমারিকালে গত দু’বছর রাজনীতিকদের যুক্তি, তর্ক আর সিদ্ধান্ত নাগরিককে আতঙ্কে ঠেলে দিচ্ছে।

আমরা জেনে গিয়েছি যে, করোনাভাইরাস ক্রমে রূপ বদলায়, নতুন স্ট্রেনের ভাইরাস জন্ম নেয়। এর সংক্রমণ শক্তি সাংঘাতিক, বিশ্ব জুড়ে কোভিডে মৃত্যুর সংখ্যাই তার প্রমাণ। গোড়ায় এই সংক্রমণ থেকে মানুষ নিজেকে কী ভাবে রক্ষা করবে সেই নিয়ে দ্বিধা ছিল, তা দূর হয়েছে। মুখাবরণ, পরিচ্ছন্নতা, পারস্পরিক দূরত্ব বজায় রাখা— তিন মন্ত্র। বিজ্ঞানীদের এই সাবধানবাণী প্রচারের পরেও দেখা গেছে, রাজনীতিবিদরা, রাষ্ট্রের শাসক ও নেতারা নানা অবৈজ্ঞানিক যুক্তিনির্ভর কুসংস্কারকে মান্যতা দিয়ে মানুষকে ‘সাহস’ জোগাচ্ছেন। সেই ভুল ভেঙেছে মৃত্যুমিছিলে। চিকিৎসার দুর্বল পরিকাঠামো ও অব্যবস্থা প্রকট হয়েছে। লকডাউন, বিধিনিষেধ আরোপ এবং ধীরে ধীরে তা তুলে নিয়ে প্রথম ঢেউ পেরোতে শিথিল হয়েছে বাঁধন। দীর্ঘ ঘরবন্দি জীবন থেকে মুক্তি পেতে উচ্ছৃঙ্খল হয়েছিল মানুষ। এরই মধ্যে এল কোভিডের নতুন স্ট্রেনের দ্বিতীয় ঢেউ। চিকিৎসকরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে চিকিৎসা করেছেন, বিজ্ঞানীরা পরীক্ষাগারে প্রতিষেধক আবিষ্কারে নিমগ্ন। প্রতিষেধক এল, সংক্রমণের সঙ্গে যুঝতে সাহায্য করল মানুষকে। রাজনীতি ও ধর্ম যাঁদের ‘পেশা’, বিজ্ঞানীদের স্বীকৃতির অভ্যাস তাঁদের নেই। তাঁদের যুক্তি ও তর্ক বাস্তব থেকে অনেক দূরে। ধর্মীয় সংস্কার ও রাজনীতি স্বীয় স্বার্থসিদ্ধির জন্য মানুষকে বিপথে চালনা করে, অসহায়তার ফয়দা তোলে।

ইউরোপ-আমেরিকায় মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত বন্ধনমুক্তির আনন্দের সুযোগ এসেছে বিভিন্ন সময়ে প্রশাসনিক শিথিলতার জন্য, তার মূল্যও চোকাতে হয়েছে। ভারতে সরকারই ইন্ধন জোগাচ্ছে নির্দেশ অমান্য করতে। এর পিছনেও বেলাগাম রাজনীতি ও ধর্মাচরণ। গত বছর পাঁচ রাজ্যে ভোটের পর সংক্রমণ তরতরিয়ে বেড়েছিল। করোনাবিধি না মেনে বিপুল জনসমাগমে বিভিন্ন দলের প্রচার, আর কুম্ভমেলায় লক্ষ লক্ষ লোকের জমায়েতে যা হওয়ার তা-ই হয়েছে। হাজার হাজার লোক সংক্রমিত, অজস্র লাশ গঙ্গায়। সবে কোভিড একটু বশ মেনেছে প্রতিষেধকে, সেই সময় এল অন্য আর এক রূপ, ওমিক্রন। ডেল্টার সঙ্গেই সহাবস্থানে সে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে বিশ্বময়। বিজ্ঞানীরা ফের উচ্চারণ করলেন সাবধানবাণী। ইতিমধ্যে এল শীত, ক্রিসমাস, বর্ষবরণ। সুযুক্তিবাদীরা শঙ্কিত হলেন, কুযুক্তিবাদীর দল দিল বরাভয়। বিজ্ঞানীরা বলছেন নতুন স্ট্রেনের জন্য প্রতিষেধক যথেষ্ট নয়; আর স্বশিক্ষিতের বক্তব্য: হাঁপিয়ে উঠেছে প্রাণ, চলো ময়দান।

ভারত ও পশ্চিমবঙ্গে সংক্রমণ যখন যথেষ্ট নিয়ন্ত্রণে, একে একে অফিসকাছারি খুলে গেছে, বাস-ট্রেন চলাচল স্বাভাবিক, অসংগঠিত শ্রমিকদের রোজগার শুরু হয়েছে, স্কুলে যাচ্ছে নবম থেকে দ্বাদশ শ্রেণির পড়ুয়ারা, তখনই ওমিক্রনের হুমকি শোনা গেল বিদেশে। বিজ্ঞানীরা সতর্ক করলেন, আবার সে এসেছে অন্য রূপে। অনেক রাজ্য বড়দিন ও নতুন বছরের উৎসব-জমায়েত নিষিদ্ধ করল। পশ্চিমবঙ্গ তখন প্রায় নিয়ন্ত্রণমুক্ত। সরকার জনগণের সুবুদ্ধির উপর ভরসা করে আনন্দে ইন্ধন জুগিয়ে রাত্রিকালীন নিষেধাজ্ঞা তুলে নিল। মানুষের ঢল নেমে এল রাস্তায়, ক্ষণিকের আনন্দ চড়চড় করে তুলে দিল সংক্রমণের রেখচিত্র। কলকাতায় সবচেয়ে বেশি, লাফিয়ে বাড়ছে আক্রান্তের সংখ্যা। সামনে চোখ রাঙাচ্ছে পৌষ সংক্রান্তির গঙ্গাসাগর মেলা, যা মুখ্যমন্ত্রী নিজে গিয়ে তদারকি করে এসেছেন। সুযুক্তিবাদীদের উড়িয়ে দিয়ে বলা হয়েছে, কিছু হবে না। প্রধানমন্ত্রী কুম্ভমেলায় সায় দিলে মুখ্যমন্ত্রী গঙ্গাসাগর মেলায় সায় দেবেন না কেন?

এ তো গেল যুক্তি আর তর্ক। আসল কথাটা হল, সাধারণ মানুষের স্বাস্থ্য নিয়ে ছেলেখেলার অধিকার কি গণতন্ত্র দিয়েছে? বর্তমান শাসকদের মধ্যে সুযুক্তিবাদী শিক্ষিতের অভাব। সংখ্যাগরিষ্ঠতা শাসককে একনায়ক হতে প্রলুব্ধ করে, যার প্রতিফলন কেন্দ্রে ও এই রাজ্যে দেখা যাচ্ছে। শাসকেরা ভুলে যাচ্ছেন যে, তাঁরা প্রবীণ, বয়স্ক, অশক্তেরও প্রতিনিধি, তাঁদের স্বাস্থ্য বিপন্ন হলে তা সামলানোর মতো পরিকাঠামো নেই। ইতিমধ্যে অনেক চিকিৎসক আক্রান্ত। লাগামছাড়া সংক্রমণ দেখে ফের নিয়ন্ত্রণবিধি চালু হল, বন্ধ হল শিক্ষায়তন। বিনা পয়সায় চাল-গম, অনুদান চলবে— আয়কর থেকে এবং ঋণের বোঝা বাড়িয়ে। সুতো ছেড়ে সংক্রান্তির মেলায় ঘুড়ি উড়িয়ে কোভিডের সঙ্গে প্যাঁচ খেলার ক্ষমতা আছে তো? না কি আবার সেই লকডাউনের পথে হাঁটাই ভবিতব্য?

অন্য বিষয়গুলি:

Public Health Coronavirus in West Bengal Covid 19
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy