—প্রতীকী ছবি।
ভারত সবুজ অঙ্গীকারে সই করেনি। অস্ট্রেলিয়া, নিউ জ়িল্যান্ড-সহ আরও কয়েকটি দেশ দুবাইয়ের কপ ২৮ বৈঠকের শেষে উষ্ণায়ন ঠেকানোর যৌথ প্রস্তাবের একাধিক অংশ নিয়ে তীব্র আপত্তি জানিয়েছে বিভিন্ন কারণে। আগের বৈঠকগুলির মতোই কপ ২৮ বৈঠকও নানান মতানৈক্য এবং বিরোধ কন্টকিত থেকেছে। কিন্তু তাই বলে এই বৈঠককে ব্যর্থ বলে বাতিলের দলে ফেলা দেওয়াটা ঠিক হবে না। কারণ, এই বৈঠকেই আবার উষ্ণায়নের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলিকে ক্ষতিপূরণের জন্য তহবিল গড়া থেকে শুরু করে ২০৫০ সালের মধ্যে প্রকৃতির গ্রিন হাউস গ্যাস শোধন ক্ষমতার মধ্যে নিষ্কাষণকে ধরে রাখার কার্যকর অঙ্গীকারের রাস্তায় হাঁটার প্রস্তুতির কাজটাও অনেকটাই এগিয়ে নিয়ে যাওয়া গিয়েছে।
ব্যর্থ বলে মেনে নেওয়া যাবে না কারণ, সংযুক্ত আরব আমিরশাহির পৌরোহিত্যে দুবাইয়ে কপ ২৮ বৈঠক শেষ হয়েছে যে অঙ্গীকার নিয়ে, তা যদি সদস্য দেশগুলি পালন করে উঠতে পারে তা হলে ২০২৫ সালের মধ্যে প্রতিটি সদস্য দেশ উষ্ণায়ন কমাতে কী করবে তার নির্দিষ্ট পরিকল্পনা জমা দেবে। ২০৩০ সালের মধ্যে সামগ্রিক পরিকল্পনা রূপায়ণের নির্দিষ্ট অগ্রগতির খতিয়ান দাখিল করবে এবং ২০৫০ সালের মধ্যে প্রকৃতির কার্বন শোধন ক্ষমতার মধ্যেই নিষ্কাষণকে বেঁধে ফেলা যাবে! অন্তত খাতায় কলমে এটাই পরিকল্পনা। কিন্তু তা কি হবে? ২০৫০ সালকে লক্ষ্য মানতে নারাজ ভারত। ২০৭০ সালকেই আঁকড়ে ধরে রাখতে চাইছি আমরা নিট শুন্য কার্বন নির্গমনে পৌঁছনোর লক্ষ্য হিসাবে। আবার, সমস্যা হচ্ছে উষ্ণায়নের প্রত্যক্ষ রোষে ইতিমধ্যেই যে দেশগুলির নাভিশ্বাস উঠতে শুরু করেছে তাদের বক্তব্য হল ‘দুবাই অঙ্গীকার’ আসলে উষ্ণায়নের কোপকে অস্বীকার করে কিছু দেশের আর্থিক স্বার্থকেই প্রাধান্য দিয়েছে। তাদের মতে ২০৫০ সালকে লক্ষ্য করলে পরিবেশ ক্ষতি এড়ানোর জন্য তা অনেক দেরি হয়ে যাবে।
এই বৈঠকের আগে থেকেই অবশ্য জানা ছিল এই সব আপত্তির কথা। কারণ, এই ধরনের আন্তর্জাতিক বৈঠকের প্রস্তুতি-আলাপ গোটা বছর ধরেই চলে সদস্য দেশগুলির মধ্যে। তাই, সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলি নিয়ে সদস্যদের অবস্থানও জানাই থাকে। এই কারণেই কে কীরকম আপত্তি তুলবে এবং কেন তুলবে তাও অনেকটাই জানা থাকে সবারই। আর এই আপত্তির জায়গাগুলোকে কমিয়ে সহমতের অবস্থান তৈরি করাই হল এই বৈঠকগুলোর উদ্দেশ্য। সেই জায়গা থেকে কিন্তু কপ ২৮-কে আমাদের উষ্ণায়ন ঠেকানোর রাস্তায় অগ্রগতি হিসাবেই মেনে নিতে হবে। এই অগ্রগতি ঠিক কতটা তার হিসাব নিয়ে অবশ্য চুলচেরা আলোচনা চলতেই পারে। এবং চলবেও। তারও প্রয়োজন আছে। কারণ এই জাতীয় আলোচনা থেকেই উঠে আসে অগ্রগতির ফাঁক ভরাটের পথ।
এই মুহূর্ত যে প্রশ্নটা সাধারণভাবে পরিবেশবান্ধব যুক্তি সামনে রাখছে তা অবশ্যই গোটা সভ্যতার বাঁচার প্রশ্ন ঘিরেই। প্রশ্ন উঠছে যেখানে সভ্যতার টিকে থাকাটাই আসল সেখানে একটি বা কয়েকটি দেশের স্বার্থকে কত বড় করে দেখতে পারি আমরা? নিশ্চয়ই। কিন্তু পরিবেশকে গুরুত্ব দিয়ে এবং মানব সভ্যতার টিকে থাকার সঙ্কটকে অস্বীকার না করেই উন্নয়নের দৌড়ে তুলনামূলক ভাবে পিছিয়ে থাকা দেশগুলির যুক্তি হল উন্নত দেশগুলির উন্নয়নের মূল্য আজ নিজেদের জীবন দিয়ে চোকাচ্ছে তারা। এবার যদি তাদের উপর জোর করে উষ্ণায়ন ঠেকানোর দায় চাপিয়ে দেওয়া হয়, তাহলে তো আবার তাদেরই কিছু বড়লোক দেশকে বাঁচানোর দায় নিয়ে নিতে হবে নিজেদের উন্নয়নের মূল্যে। আর সমস্যাটা অবস্থানের এই ফারাকের উপরই দাঁড়িয়ে রয়েছে।
দুবাই বৈঠকে যে বিষয়গুলি নিয়ে অগ্রগতি হয়েছে তার মধ্যে প্রধান ছ’টি হল:
১) উষ্ণায়নের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলিকে সাহায্যের জন্য ক্ষতিপূরণের তহবিল গঠন
২) উষ্ণায়ন রোধের রাস্তায় অগ্রগতির খতিয়ান নেওয়া
৩) সবুজ অঙ্গীকার
৪) দূষণের কারণে স্বাস্থ্যহানি রোখার অঙ্গীকার
৫) উষ্ণায়ন রোখার জন্য তহবিল
৬) প্রথাগত জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার থেকে বেরিয়ে আসা।
প্রথমটি নিয়ে প্রাথমিক আলোচনা করে গত বছরের কপ ২৭। প্রস্তাবটি এসেছিল জি-৭৭ গোষ্ঠীর কাছ থেকে। উষ্ণায়ন রোধে অগ্রগতির পথে অন্যতম বড় সমস্যা হল বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মধ্যে আর্থসামাজিক বৈষম্য। উষ্ণায়নের ফলে প্রাকৃতিক বিপর্যয় বাড়ছে। সমুদ্রের গ্রাসে পড়ে উপকূলের জীবন কঠিন হয়ে উঠছে। মৎস্যচাষ বিপন্ন। ক্ষেতেও ফসল ফলাতে জেরবার কৃষকরা। কারণ, মরসুমের খামখেয়ালিপনা। এরকম নয় প্রকৃতির রোষের দৃষ্টি শুধু গরীব দেশগুলির উপরই। ফারাক হল ধনীদের প্রযুক্তি এবং আর্থিক বল বেশি হওয়ায় এই সমস্যার মোকাবিলাতেও তারা অনেকটাই এগিয়ে।
কিন্তু এটাও ঠিক যে উষ্ণায়নের পিছনে উন্নত দুনিয়ার জীবন ধারার ঐতিহাসিকভাবে যে অবদান তার সিকিভাগও উন্নয়নশীল দুনিয়ার নেই। তাই জি-৭৭ গোষ্ঠী শর্ম এল-শেখ (ইজিপ্ট) কপ ২৭ বৈঠকে ক্ষতিপূরণ তহবিল গঠনের প্রস্তাব করে। কপ ২৮ বৈঠক তা অনুমোদন করে। এই তহবিল বিশ্বব্যাঙ্ক পরিচালনা করবে তা আমরা জানি।
পাশাপাশি, এই বৈঠকেই প্রথম ২০১৬ সালের পারিস চুক্তি মেনে সদস্য দেশগুলি উষ্ণায়ন রোধে কী পদক্ষেপ করল এবং তার ফল কী হল তা নজরে রাখবে। এই কাজটি প্রতি দু’বছরে করা হবে।
কিন্তু সবুজ অঙ্গীকারে ভারত সই করেনি। সই করেনি স্বাস্থ্য অঙ্গীকারে এবং জীবাশ্ম নির্ভর জ্বালানি বর্জনের অঙ্গীকারেও। ভারতের যুক্তিতে যাওয়ার আগে অঙ্গীকারগুলি এক নজরে দেখে নেওয়া যাক।
সবুজ অঙ্গীকারে বলা হয়েছে, সদস্য দেশগুলি ২০৩০ সালের মধ্যে সবুজ শক্তির ব্যবহার তিনগুণ বাড়াবে এবং কয়লায় আর নতুন বিনিয়োগ করবে না। জীবাশ্ম নির্ভর জ্বালানির ব্যবহার কমানোর অঙ্গীকারটিরও জোর একই জায়গায়। শুধু অন্তর্বর্তী সময়ে গ্যাসের ব্যবহারের উপর জোর দেওয়া হয়েছে। স্বাস্থ্য অঙ্গীকারের মোদ্দা কথাটা হল উষ্ণায়নের কারণে যে বৈষম্য বাড়ছে বিভিন্ন দেশের ভিতরে এবং বিভিন্ন দেশের মধ্যে তা দুর করতে পদক্ষেপ করতে হবে। কারণ, উষ্ণায়নের প্রভাব পড়ছে স্বাস্থ্যের উপর। এই প্রভাবের মূলে যেমন মরসুমের খামখেয়ালিপনা রয়েছে ঠিক তেমনই রয়েছে এর ফলে বাড়তে থাকা আর্থিক বৈষম্যও।
ভারতের বক্তব্য হল এই অঙ্গীকারগুলি একত্রে পড়লে ব্যাপারটা দাঁড়ায় এরকম:
• কয়লার ব্যবহার বর্জন
• কার্বন মুক্ত হওয়ার রাস্তায় আরও দ্রুত হাঁটা
• স্বাস্থ্যক্ষেত্রে বর্জ্যকে পরিবেশ বান্ধব পথে শোধন করা
• এবং স্বাস্থ্য পরিষেবাকে পরিবেশ দূষণের কারণে তৈরি নানান সমস্যা রুখতে আরও দক্ষ করে তোলা।
কিন্তু ভারতে বিশ্বের ১৭ শতাংশ মানুষের বাস। অথচ এই দেশ বিশ্বের বায়ুদূষণের মাত্র চার শতাংশের জন্য দায়ী। এবং ভারত হল বিশ্বের কতিপয় দেশেক একটি যারা কার্বন দূষণ রোধে করার অঙ্গীকার পুরোপুরি পালন করছে। ২০৩০ সালের মধ্যে বায়ু দূষণের মাত্রা ৪৫ শতাংশ কমানোর প্রতিশ্রুতি পালনের রাস্তায় হাঁটা থেকে এক পা-ও বিচ্যুত হয়নি। ২০৭০ সালে ভারত কার্বন মুক্ত হবে বলে অঙ্গীকারবদ্ধ। এই লক্ষ্যমাত্রাকে আরও এগিয়ে আনা ভারতের পক্ষে সম্ভব নয়।
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী তাঁর কপ ২৮ বৈঠকের ভাষণেই পরিষ্কার করে দিয়েছেন দূষণ নিয়ে দেশের অবস্থান। ভারতের মতো অনেক দেশের অবস্থানই হল বর্তমান আর্থসামাজিক পরিস্থিতিতে চাইলেও তাদের পক্ষে শুণ্য নেট কার্বনের লক্ষ্যমাত্রাকে আরও কাছে নিয়ে আসা সম্ভব নয়। তা করতে গেলে যে ভাবে প্রযু্ক্তি পরিবর্তন করতে হবে তা খরচসাপেক্ষ এবং তা সামলানোর ক্ষমতা কোষাগারগুলির নেই।
উল্টোদিকে অনেক ছোট এবং দ্বীপরাষ্ট্রই চাইছে বাতাসে দূষণ কমানোর রাস্তায় আরও দ্রুত হাঁটার। কারণ জলস্তর বাড়ার কারণে তাদের অস্তিত্বই বিপন্ন হয়ে উঠেছে।
আর এই দুই দিকের চাপে পড়েই অবশেষে ‘ক্লাইমেট ফিনান্স‘ বা পরিবেশ রক্ষক তহবিল গঠন অঙ্গীকার থেকে রূপায়ণের রাস্তায় পা বাড়িয়েছে। ২০০৯ সালে করা এই অঙ্গীকার অনুযায়ী পরিবেশ বাঁচাতে যে তহবিল দরকার তা গঠন করতে সাহায্য করবে উন্নত দুনিয়া নিজেদের গ্যাঁট থেকে টাকা দিয়ে। তা চালু হওয়ার কথা ছিল ২০২০ সালে। কিন্তু নানান গড়িমসিতে তা আর শুরু হয়েই ওঠেনি। এই বৈঠকে অবশেষে ওইসিডি গোষ্ঠী ১০ হাজার কোটি ডলারের প্রাথমিক তহবিল গড়ার দায় মেনে নিয়েছে। কী ভাবে এই তহবিল ব্যবহার হবে তার জটিল প্রক্রিয়া প্রস্তুতির কাজও শুরু হয়ে গিয়েছে। এই তহবিল কী ভাবে বিভিন্ন দেশকে সাহায্য করবে তা এক অন্য আলোচনার দাবি রাখে।
কিন্তু মোদ্দা কথাটা হল মানব সভ্যতার উপযুক্ত পরিবেশ বাঁচাতে কী করতে হবে তা নিয়ে বিভেদ কমছে আলোচনার ভিত্তিতেই। তার অন্যতম কারণ অবশ্যই প্রকৃতির ক্রমশই আরও বেশি নির্মম হয়ে ওঠা। কিন্তু একই সঙ্গে এটাও সত্যি যে দীর্ঘকাল ধরে বিশ্বজুড়ে আমাদের সম্মিলিত অবিমৃশ্যকারিতা প্রকৃতিকে যে ভাবে ধ্বংস করে এসেছি, তাতে আজকের পরিস্থিতি তৈরি হওয়া ছিল সময়ের অপেক্ষা। এখন প্রশ্ন হল অন্য। সবাই মিলে নিজেদের স্বার্থরক্ষা করে পরিবেশ রক্ষায় এগোলে আমাদের সভ্যতার টিকে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় পরিবেশকে বাঁচানো যাবে তো?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy