—প্রতীকী চিত্র।
যে ভূমিতে আপনি আমাকে জন্ম দিয়েছেন, যে ভাষায় কথা শিখিয়েছেন, সেই ভাষাকে, সেই জন্মভূমিকে রক্ষা করতে হলে আমার মতো অনেকের প্রাণ দিতে হবে... সে রক্ত ইতিহাসের পাতায় সাক্ষ্য দেবে যে বাঙালি এখনো মাতৃভূমি রক্ষা করতে নিজের জীবন পর্যন্ত বুলেটের সামনে পেতে দিতে দ্বিধা বোধ করে না।” ১৯৭১-এর ৪ এপ্রিল, মুক্তিযুদ্ধ শুরুর মাত্র দশ দিন পর মাকে চিঠি লিখছেন এক মুক্তিযোদ্ধা। ঢাকা থেকে প্রকাশিত একাত্তরের চিঠি বইটি এমনই অনেক চিঠির সঙ্কলন: মা-বাবাকে লেখা মুক্তিযোদ্ধা ছেলের, স্ত্রীকে লেখা মুক্তিযোদ্ধা স্বামীর, শিশুসন্তানকে লেখা মুক্তিযোদ্ধা পিতার। এঁদের অধিকাংশই আর ফেরেননি, চিঠিগুলি রয়ে গেছে ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে— স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী পেরিয়ে আসা বাংলাদেশ যে ইতিহাস আজ স্মরণ করছে ‘বিজয় দিবস’-এ। ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশে আনন্দ ও গর্বের দিন: স্বাধীনতা দিবস পালন করে থাকে সব দেশই, কিন্তু তথাকথিত অনভিজ্ঞ ও অপ্রশিক্ষিত, সমাজের সর্বস্তরের সাধারণ মানুষ নিয়ে গড়া এক ‘জন’যুদ্ধের সেনার জয়লাভের ঘোষিত দিনটির তাৎপর্য আলাদা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আনুষ্ঠানিক অন্তের ঘোষিত দিনটিও ‘ভিকট্রি ইন ইউরোপ ডে’ রূপে পালিত, কিন্তু ভৌগোলিক-ঐতিহাসিক নৈকট্যে জড়িয়ে থাকা দুই বাংলার কাছে ‘বিজয় দিবস’-এর আবেগ ও গুরুত্ব আরও বেশি।
সেই আবেগ মনে করিয়ে দেয়, মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়েছিল বাংলা ভাষা বলা, বাঙালি সংস্কৃতিতে শ্বাস নেওয়া মানুষের সম্মিলিত ও সুনির্দিষ্ট এক লক্ষ্যকে সামনে রেখে। তার বহিরঙ্গটি যদি হয় রাজনৈতিক স্বাধীনতা অর্জন, অন্তরঙ্গে ছিল বাঙালির ভাষিক-সাংস্কৃতিক অধিকার পুনঃ অর্জন। দেশভাগের পরেও তাই কাঁটাতারের দু’পাশে বাঙালির ধ্যানজ্ঞান ছিল পূর্ব ‘পাকিস্তান’ নয়, পূর্ব‘বঙ্গ’; বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতিই ছিল জাতীয়তাবোধের চালিকাশক্তি। ধর্মের ভিত্তিতে দেশভাগ হলেও, ১৯৪৮-এ রাষ্ট্রভাষার প্রশ্নে বাঙালির একত্র হওয়া আর ১৯৫২-র ভাষা আন্দোলন প্রমাণ করে দিয়েছিল: ধর্ম নয়, ভাষা-সংস্কৃতিই তার অস্তিত্বের আশ্রয়। অসাম্প্রদায়িক এই ভাষিক-সাংস্কৃতিক জাতিচরিত্রকেই বঙ্গবন্ধু আহ্বান জানিয়েছিলেন মুক্তির সংগ্রামে, সেখানে উচ্চ-নীচ, হিন্দু-মুসলমান, শিক্ষিত-অসাক্ষর, গ্রাম-শহরে প্রভেদ ছিল না, ছিল শুধু সকলে এক হয়ে, প্রয়োজনে জীবনপাত করে ‘বাঙালির মাতৃভূমি’র মর্যাদা রক্ষার ব্রত। ১৬ ডিসেম্বর তাই স্রেফ এক যুদ্ধজয়ের আনন্দ উদ্যাপনের দিন নয়। তার দর্শনটি গভীরতর: বাঙালি জাতীয়তাবাদ, অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র-সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন সার্থক হয়েছিল এ দিনে। সেটিই প্রকৃত ‘বিজয়’।
স্বাধীনতার পর পাঁচ দশকে পদ্মা দিয়ে জল কম গড়ায়নি। বাংলাদেশবাসী এর মধ্যে নানা রাজনৈতিক পালাবদল দেখেছেন, বাঙালি সংস্কৃতির উপর আঘাতের সাক্ষী থেকেছেন। ধর্ম ঘিরে রাজনীতি, উগ্রতা, সন্ত্রাস এখনও সুযোগসন্ধানী; ঢাকায় রমনা বটমূলে বর্ষবরণের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে বা ঢাকার বাইরে বাউল গানের উৎসবে বোমা বিস্ফোরণের ঘটনা জনমন বিস্মৃত হয়নি। সংস্কৃতির সুস্বাস্থ্য নির্ভর করে মুক্ত চিন্তার প্রচার-প্রসারের উপরে, সেই চিন্তার চর্চাকারীদেরও অনেকের প্রাণ গিয়েছে ধর্মান্ধ অশুভ শক্তির হাতে, অনেকে প্রাণভয়ে পলাতক বা স্বেচ্ছানির্বাসিত। আধুনিক বাংলাদেশ এক দিকে অর্থনীতি, ডিজিটাল প্রযুক্তি, ক্রিকেটে নজির গড়ছে, পদ্মা সেতু বানিয়ে কীর্তি স্থাপন করেছে, অন্য দিকে তার সমাজজীবনে এখনও প্রগতিমুখিতা ও পশ্চাৎপদতা এই দুইয়েরই টানাপড়েন। আসন্ন সাধারণ নির্বাচনের আবহে কিছু রাজনৈতিক দলের ধর্মীয় রাজনীতি ও বাঙালি সংস্কৃতিবিমুখতা রূপ পাচ্ছে রাস্তার সন্ত্রাসে। এই সবই যে নতুন বা অপরিচিত তা নয়, রাজনীতি ও ধর্মের আঁতাঁত বরাবরই সংস্কৃতিকে হতবল ও কুক্ষিগত করতে চেয়েছে, তা সে অতীতের অখণ্ড বঙ্গেই হোক বা আজকের বাংলাদেশে। আশার কথা, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির প্রতি বাংলাদেশের টান আজও অটুট: তার শিক্ষক কবি গায়ক শিল্পী চলচ্চিত্রকার থেকে শুরু করে একুশ শতকের নবীন প্রজন্মও ১৯৫২ বা ১৯৭১-এর ইতিহাসের উত্তরাধিকার বয়ে চলেছেন সানন্দে, সগর্বে। এই ঐতিহ্য বহনে ভার নেই, দায়বদ্ধতা আছে; অতীতকে ভুলে যাওয়া নেই, বুঝতে চাওয়া আছে, গ্লানিহীন আত্মসমালোচনা আছে। যত দিন বাঙালি এই অসাম্প্রদায়িক ভাষিক-সাংস্কৃতিক জাতীয়তার বোধে স্থিত থাকবে, তার ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস জেগে থাকবে পূর্ণ গৌরবে। বিজয় দিবসের উদ্যাপন-আবহে এ কথাটি স্মরণ রাখলে ভাল।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy