সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে বিজেপি-র অনেক বেশি মাথাব্যথার কারণ কৃষক আন্দোলন।
লখনউ থেকে লখিমপুরের দূরত্ব প্রায় একশো ত্রিশ কিলোমিটার। সেই জায়গাই এখন রাজনৈতিক ঘূর্ণিঝড়ের উৎসস্থল। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কিছুটা থিতিয়ে যায় যে কোনও আন্দোলন। আর যে সব লড়াই সময়োত্তীর্ণ, সেগুলোই ঢুকে পড়ে ইতিহাসের পাতায়। গত এক বছরের বেশি সময় ধরে কৃষক আন্দোলন বারবার উঠে আসছে সংবাদের শিরোনামে। দেশ জুড়ে বিরোধী অনৈক্যের মাঝে অবশ্যই নির্বাচনী রণকৌশলে অনেক এগিয়ে বিজেপি। কিন্তু তা সত্ত্বেও যদি সামনের উত্তরপ্রদেশ বিধানসভা নির্বাচন এবং তার পরের লোকসভা নির্বাচনে তারা খারাপ ফল করে, তার মূল কারণ হিসেবে আলোচিত হবে এই কৃষক আন্দোলনের কথা। তবে যে কোনও রাজনৈতিক চিত্রনাট্যের মতোই লখিমপুরের লড়াইও বহুরূপী, আর তার এক বঙ্গীয় প্রেক্ষিতও আছে। তা হল তৃণমূল এবং কংগ্রেসের মধ্যে বিরোধী নেতৃত্ব নিয়ে তরজা।
এই লেখার মূল বিষয় সেটিই। বিশেষ করে লখিমপুরে তৃণমূলের সাংসদেরা যে ভাবে চটজলদি পৌঁছে গিয়েছেন আক্রান্ত কৃষকদের বাড়িতে, আর অন্য দিকে এক দিনের উপর বন্দি থেকেছেন প্রিয়াঙ্কা গাঁধী, সেখানেই আর এক রাজনৈতিক ধারাবৃত্তান্তের শুরু। রাহুল গাঁধীও ঘটনাস্থলে পৌঁছনোর আগে বাধা পেয়েছেন প্রচুর। কংগ্রেস বলছে বিজেপি-র সঙ্গে গোপন আঁতাত আছে তৃণমূলের, তাই সে দলের সাংসদেরা সহজে পৌঁছতে পেরেছেন সঠিক জায়গায়। অন্য দিকে তৃণমূলের তির রাহুল গাঁধীর নেতৃত্বের সীমাবদ্ধতার দিকে। নেতা এবং তাঁর দলের রাজনৈতিক কৌশলের অপরিপক্বতা এবং উদ্দেশ্যহীনতার জন্যেই নাকি কংগ্রেস অপ্রাসঙ্গিক হয়ে উঠছে আর সুবিধা পাচ্ছে বিজেপি। তৃণমূলের বক্তব্য, তাঁদের সাংসদেরা যে বুদ্ধি করে সঠিক সময়ে সঠিক জায়গায় পৌঁছতে পেরেছেন তা মোটেই বিজেপি-র সঙ্গে বোঝাপড়ার ফসল নয়। বরং সর্বভারতীয় বিরোধী নেতৃত্বের প্রশ্নে অসহায় জনগণের পাশে দাঁড়ানোয় তৃণমূল অন্যান্য দলের থেকে এগিয়ে। ইঙ্গিত অবশ্যই কংগ্রেসের ব্যর্থতার দিকে।
তৃণমূলের মুখপত্র এবং দলের বিভিন্ন নেতানেত্রী সরাসরি জানাচ্ছেন যে রাহুল গাঁধী নন, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ই আগামী দিনের বিরোধী মুখ। ২০২৪-এর লোকসভা ভোট দেরি আছে। তবে একটা বিষয় একেবারে পরিষ্কার যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সারা দেশে বিরোধী নেত্রী হিসেবে সামনে উঠে আসছেন। তার মানেই যে তৃণমূল সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে চটজলদি প্রতিষ্ঠা পাবে কিংবা পশ্চিমবঙ্গের বাইরে প্রচুর লোকসভা আসন জিতবে এমনটা নয়। তবে তাদের উদ্দেশ্য ঘোষিত, তা হল আগামী দিনে সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে বর্ধিত প্রভাব বিস্তার করা। সাধ এবং সাধ্যের দূরত্ব কতটা তা প্রমাণ করবে আগামী লোকসভা এবং তার আগের বিভিন্ন বিধানসভা নির্বাচন।
সাদা চোখে এটা পরিষ্কার যে পশ্চিমবঙ্গে উপনির্বাচন বা পুরনির্বাচনে খুব ভাল ফল করবে তৃণমূল। হয়তো বা ত্রিপুরাতেও উল্লেখযোগ্য কিছু ঘটাতে পারে তারা। তবে তার বাইরে কিন্তু সর্বভারতীয় ভোট-রাজনীতিতে তাদের প্রভাব ফেলার সম্ভাবনা কম। আবার এটাও মনে রাখতে হবে যে রাজনীতির সবটা ভোটভিত্তিক নয়। উদাহরণ হিসেবে রয়েছেন ভারতের অনেক প্রধানমন্ত্রী, যাঁদের দল সংখ্যাগরিষ্ঠতা তো দূরে থাক, তার ধারেকাছেও যেতে পারেনি। ফলে বিভিন্ন সমীকরণ এবং অসমীকরণের সমাধানে ২০২৪-এ কী ঘটবে তা এই মুহূর্তে বলা শক্ত। উল্লেখযোগ্য বিষয় হল বিরোধী নেতানেত্রীদের মধ্যে সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে রাহুল গাঁধীর সঙ্গে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নাম উঠে আসছে বারংবার। এই মুহূর্তে অরবিন্দ কেজরীবালকে নিয়ে আলোচনা কম। মায়াবতী অনেক পিছনে। তবে সম্ভাবনার বিজ্ঞানে আগামী দিনে কে এগোবেন কে পিছোবেন বলা শক্ত। উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে, পঞ্জাবে আপ জিতে গেলে তখন হয়তো কেজরীবালকে নিয়ে আবার হইচই হবে।
এইখানে মূল প্রশ্ন উঠছে বিরোধী ঐক্য নিয়ে। সাধারণ ভাবনা বলছে, যত বেশি সংখ্যক বিরোধী নেতানেত্রী প্রধানমন্ত্রী হওয়ার স্বপ্ন দেখবেন, ততই বাড়বে অনৈক্য, আর অনুসিদ্ধান্তে বিজেপি-র সুবিধা। ফলে তৃণমূল যখন জনসমক্ষে রাহুল গাঁধী সম্পর্কে নেতিবাচক বক্তব্য রাখছে, তখন সহজেই মনে হবে বিজেপি-র হাত শক্ত করছে তারা। অবশ্যই এটি একটি রাজনৈতিক মতামত। কিন্তু এটিই একমাত্র বিশ্লেষণ নয়।
আমাদের খতিয়ে দেখা উচিত যে বিরোধী অনৈক্য বিজেপি-র সুবিধা করে দেবে এ কথা সব সময় সত্যি কি না। রাজনীতি যেহেতু সম্ভাবনার অঙ্কে কাজ করে, তাই এখানে প্রত্যক্ষ প্রমাণের কোনও জায়গা নেই। তবে শুরুর উদাহরণে আসবে কেরল। লক্ষ্য করা যাক ২০০৪ সাল থেকে। ১৭ বছর হয়ে গেল, বামজোট এবং কংগ্রেস কেন্দ্রে সহমর্মী, কিন্তু কেরলে তাদের মুখোমুখি লড়াই। বিজেপি মাঝেমধ্যে কেরলে সর্বাধিক ১৫ শতাংশ মতো ভোট পেয়েছে, কিন্তু দোস্তি-কুস্তির তত্ত্ব দিয়ে কংগ্রেস আর বামজোটের মোট ভোটকে খুব কমাতে পারেনি। ফলে লোকসভায় কুড়িটি আসনের প্রায় সবকটাই বেশিরভাগ সময় বিজেপি-বিরোধীদের হাতে রয়ে গিয়েছে। এই লড়াইয়ের তীব্রতা কমলেই কিন্তু বামপন্থী এবং কংগ্রেস সমর্থকদের একটা বড় অংশ বিরোধী ক্ষেত্র খুঁজতে বিজেপি-র দিকে চলে যেতেই পারে। অর্থাৎ তাদের জোটের বদলে প্রতিদ্বন্দ্বিতাই গুরুত্বপূর্ণ।
এই একই তত্ত্ব উঠে আসবে পশ্চিমবঙ্গে। আপাতত বিজেপি এখানে তৃণমূলের প্রধান প্রতিপক্ষ। মোটের উপর কংগ্রেস এবং বামফ্রন্টের অবস্থা খারাপ। তারা যদি বিজেপি বিরোধিতায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দলে ঘেঁষে তাতে এই তিন দলের কারোরই বিশেষ সুবিধা হওয়ার সম্ভাবনা কম। বরং সিপিএম-কংগ্রেস যদি নতুন উদ্যমে তৃণমূল বিরোধিতা তীব্রতর করতে পারে, সে ক্ষেত্রে বিরোধী ভোটের কিছু অংশ বিজেপি-র থেকে সরার সম্ভাবনা থাকবে। এতে আদতে লাভ বিজেপি বিরোধীদের, কারণ এই রাজ্য থেকে তৃণমূলের আসন তখন পঁয়ত্রিশের বেশি থেকে চল্লিশের দিকে এগোবে। একই যুক্তিতে পঞ্জাবে আপ এবং কংগ্রেসের লড়াই যত জোরালো হবে, বিজেপি-র তৃতীয় হওয়ার সম্ভাবনা তত বাড়বে।
এই প্রসঙ্গে অন্য আর এক ধরনের উদাহরণে আসা যাক। দেশের বিভিন্ন অংশে কংগ্রেসের অস্তিত্ব অস্বীকার করার উপায় নেই। গত দুটি লোকসভা নির্বাচনে তারা পঞ্চাশের আশেপাশে আসন পেয়েছে। কিন্তু দ্বিতীয় হওয়ার সংখ্যা এবং ভোট শতাংশ দেখলেই বোঝা যায় সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে বিজেপি ছাড়া অন্যান্য দলের থেকে তারা অনেক এগিয়ে। ফলে তৃণমূল এবং কংগ্রেসের নেতৃত্ব সংক্রান্ত দ্বন্দ্বে সেই সব রাজ্যে কংগ্রেসের ভোট শতাংশে প্রভাব ফেলার কোনও সম্ভাবনাই নেই।
এখানে একটা প্রশ্ন উঠবে যে বিরোধীদের নিজেদের মধ্যে তরজায় সাধারণ ভোটার কি এতটাই প্রভাবিত হতে পারেন যে স্থায়ী সরকারের লক্ষ্যে তারা বিজেপি-কেই ভোট দেবেন? সে রকমটা হতেই পারে, তবে তা শুধু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বনাম রাহুল গাঁধীর দ্বন্দ্ব দ্বারা পরিচালিত হবে এমনটা নয়। সামনেই আসছে বেশ কয়েকটি বিধানসভা নির্বাচন। একটু ভাবলেই দেখা যাবে যে কংগ্রেস-তৃণমূল অনৈক্য একমাত্র প্রভাব ফেলতে পারে ত্রিপুরায়, লোকসভায় যার অবদান মাত্র দুই। অবসৃত-কংগ্রেস থেকে বর্তমান-তৃণমূল বিবর্তনে গন্ডগোলে-গোয়াতেও সেই দু’টিই আসন। ফলে ২০২৪ সালের নির্বাচনে এই দু’য়ে দু’য়ে চারের গুরুত্ব একেবারেই কম। অন্য দিকে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ উত্তরপ্রদেশে অনৈক্যের ছবি স্পষ্ট। কিন্তু তৃণমূল সেখানে অস্তিত্বহীন, এবং কংগ্রেস আপাতত অপ্রাসঙ্গিক।
অর্থাৎ ২০২৪-এর লোকসভা নির্বাচনের প্রেক্ষিতে তৃণমূল এবং কংগ্রেসের নেতৃত্ব সংক্রান্ত লড়াইকে তৃণমূল-বিজেপি গোপন আঁতাত হিসেবে দাগিয়ে দেওয়া যেতে পারে, কিন্তু আদৌ তার প্রভাব সুদূরপ্রসারী নয়। বরং এই সরল ষড়যন্ত্র-তত্ত্বের সঙ্গে অসম্পর্কিত এবং বিপরীতধর্মী উদাহরণ প্রচুর। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে বিরোধী নেত্রী হিসেবে তুলে ধরা এবং রাহুল গাঁধীর ব্যর্থতার তীক্ষ্ণ সমালোচনা বিরোধীদের ভেঙে চুরমার করে দিয়ে সামগ্রিক ভাবে বিজেপি-র প্রচুর সুবিধা করে দেবে, এই অতি সরলীকরণ তাই যৌক্তিক বিশ্লেষণে চরম সত্য হিসেবে মেনে নেওয়া অসম্ভব।
সুতরাং চোখে আঙুল দিয়ে এটা মনে করিয়ে দেওয়া দরকার যে সর্বভারতীয় রাজনীতির অঙ্ক শুধু পশ্চিমবঙ্গের প্রেক্ষিতে কষা ভুল হবে। উত্তরপ্রদেশে এখনও সপা-বসপা যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। অখিলেশকে লখিমপুরে যেতে বাধা দিয়েছে যোগী সরকার। সেই নিয়ে শুরুতেই পুলিশের জিপ পুড়েছে, কিন্তু তার পর তাঁরও সেখানে পৌঁছতে অনেক দেরি হয়েছে। কলকাতা কিংবা দিল্লি যে লখনউ-এর তুলনায় লখিমপুরের থেকে দূরে তা সবাই জানেন, তবু সময় এবং দূরত্বের পাটিগণিত রাজনীতির রসায়নে প্রায়শই গুলিয়ে যায়। মায়াবতীকে তো প্রায় খুঁজেই পাওয়া যাচ্ছে না। বহু কষ্টে দেশের উচ্চতম ন্যায়ালয়ের উপর প্রবল আস্থা রেখে একটি টুইট করতে সমর্থ হয়েছেন তিনি।
উত্তর ভারতে যে আদতে কী রাজনীতি চলছে তা আমরা বুঝতে পারছি না, এই বোঝাটাই সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ। তাই পশ্চিমবঙ্গের আয়নায় লখিমপুরের লড়াই বিশ্লেষণ করে এই মুহূর্তে দেশের বিরোধী নেতৃত্ব নির্ধারণ করে ফেলা খানিকটা রাজনৈতিক অপরিপক্বতাই হবে। লোকসভা নির্বাচন এখনও আড়াই বছরের বেশি সময় দূরে। পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূলের কাছে ২০২১-এ বিপুল ধাক্কা খেয়েছে বিজেপি। কিন্তু কৌশলী এবং সাংগঠনিক শক্তিতে বলীয়ান এই দলের কাছে সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে অনেক বেশি মাথাব্যথার কারণ কৃষক আন্দোলন। কংগ্রেস এবং তৃণমূল শীর্ষনেতৃত্বের দ্বন্দ্ব সেখানে একেবারেই অপ্রাসঙ্গিক। থিতিয়ে পড়া সেই আন্দোলন গতি পেল লখিমপুরের লড়াইতে। কিন্তু সেখানেও শেষ বাজারে এই প্রশ্ন উঠছে, কৃষক আন্দোলনের নেতা রাকেশ টিকায়েত কি লড়াইয়ের উত্তাপ কমিয়ে যোগী সরকারের মুখরক্ষা করলেন? উপসংহারে তাই বলতেই হচ্ছে যে বেমালুম খরচ হয়ে যাওয়া কিছু প্রাণের দাম এবং নশ্বর লাশের ময়নাতদন্ত আগামী রাজনীতির দিক-নির্দেশক না হয়ে ওঠাটাই পৃথিবীর বৃহত্তম গণতন্ত্রের পক্ষে মঙ্গলের।
(লেখক ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক, মতামত ব্যক্তিগত)
গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy