লড়াই: মণিপুরে ৪ মে-র ঘটনা বিরুদ্ধে চুড়াচাঁদপুরে জনজাতি সংগঠনের সদস্যদের প্রতিবাদ। ছবি: পিটিআই।
একটি ভিডিয়ো এবং একটি স্টিল ছবি। দুটোই মণিপুরের। ভিডিয়োটির ব্যাপারে আলাদা করে বলার আর কিছু নেই। অনেকেই জেনেছেন, দেখেছেন, শিউরে উঠেছেন। স্টিল ছবিটি ২০ জুলাইয়ের। অর্থাৎ, ভিডিয়োটি সামনে আসার পরের দিনের। চূড়াচাঁদপুরে প্রতিবাদ সমাবেশের ছবি সেটি। অজস্র মানুষ জমায়েত হয়েছেন, তাঁদের সমবেত ছিছিক্কার জানিয়েছেন।
এই ভিডিয়ো আর ছবি পাশাপাশি দেখলে বড় বিহ্বল হতে হয়। গোষ্ঠীবদ্ধ জনতা কী নারকীয়তার জন্ম দিতে পারে, তার দলিল ওই ভিডিয়ো। আর প্রতিবাদের জনজোয়ার কিছুটা হলেও ফিরিয়ে দেয় ভরসা। মনে হয়, এ কালরাত্রিরও শেষ আছে! পরমুহূর্তেই প্রশ্ন জাগে, গণধর্ষণেও গণ আর গণপ্রতিবাদেও গণ! কোন ‘গণ’তন্ত্র আমার দেশে?
কুকি আর মেইতেইদের মধ্যে চলতি সংঘর্ষ আড়াই মাস পার করেছে। দুই কুকি নারীর গণধর্ষণের ওই ভিডিয়োটি ৪ মে-র। শোনা যাচ্ছে, এক মেইতেই নারীর ধর্ষণের গুজব ছড়িয়ে পড়ার পরে পাল্টা প্রতিশোধের তাগিদে ঘটানো হয়েছিল এমন। ৪ জুন এক কুকি মা আর শিশুপুত্রকে জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছিল। সেখানে কারণ হিসাবে সামনে আনা হয়েছিল খ্রিস্টধর্ম প্রচারের অভিযোগ। এখানেও সেই কৌমের বোধ আর কৌমচেতনাই চালিকাশক্তি। সমষ্টিই মারছে, সমষ্টিই সেই মারের নিন্দা করছে!
এই সংঘর্ষে প্রশাসনের মদত মেইতেইদের দিকে, এমন অভিযোগ বার বার উঠেছে। ওঠার কারণও আছে সম্যক। আবার অন্য দিকে এও সত্য, নাগা আর কুকিদের মধ্যে সংঘর্ষ কিন্তু নব্বইয়ের দশক থেকে চলছে। কিছু দিন আগেই কলকাতায় দেখানো হল মণিপুরি চিত্রপরিচালক হওবম পবন কুমারের ছবি নাইন হিলস ওয়ান ভ্যালি। সেখানে নাগারা শুনিয়েছেন কুকিদের হিংস্রতার কাহিনি, কুকিরা নাগাদের। বলার কথা এই— আজ মেইতেইদের যে হিংস্রতা দেখে সারা দেশ স্তম্ভিত, কুকিদের দিক থেকে তেমন কোনও ঘটনা কখনও ঘটেনি বা ঘটতে পারে না, এমন নয়। একই কথা প্রযোজ্য নাগাদের সম্পর্কেও। ঠিক যেমন দেশের অন্যত্র যেখানেই সাম্প্রদায়িক হানাহানির ইতিহাস, সেখানেও দু’তরফেই সমান পৈশাচিক কাহিনি মজুত। উন্মত্ততার গণ-চরিত্রে বিশেষ ফারাক থাকে না কোথাও।
মণিপুরে নারী-নির্যাতন ঘিরে এই তোলপাড়ের পরিপ্রেক্ষিতে আফস্পা-বিরোধী আন্দোলনের কথা, মেইতেই নারীদের প্রতিবাদের কথা, কানহাইয়া লালের দ্রৌপদী নাটকের কথা নতুন করে মনে করতে চাইছেন অনেকে। কিন্তু রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের সঙ্গে গোষ্ঠী সংঘর্ষকে এক বন্ধনীতে রাখা চলে না। রাখলে সমস্যার চরিত্র বুঝতে ভুল হয়। সত্যি বলতে কী, রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের ক্ষেত্রে প্রতিপক্ষকে চিহ্নিত করা অনেকাংশে সহজ। অপরাধীর মুখ সেখানে স্থিরনির্দিষ্ট। নাগরিক সমাজের ঐক্যবদ্ধতার ক্ষেত্রে অন্তরায়ও অনেক কম। কিন্তু গোষ্ঠী সংঘর্ষের চিত্রপট অনেক বেশি জটিল, কারণ সেখানে নাগরিকদের মধ্যেই সংঘাত, নাগরিকেরাই একে অপরের রক্তলোলুপ। প্রশাসনের ভূমিকা সেখানে ব্যর্থ হতে পারে, নিষ্ক্রিয় হতে পারে, এমনকি মদতদাতারও হতে পারে। কিন্তু আখেরে এই যুদ্ধটা নাগরিকের সঙ্গে নাগরিকের, জনগোষ্ঠীর সঙ্গে জনগোষ্ঠীর, সম্প্রদায়ের সঙ্গে সম্প্রদায়ের। সেটাকে শুধুমাত্র কায়েমি স্বার্থের খেলা, ভোটব্যাঙ্কের রাজনীতি, উস্কানির ফসল বলে ধরে নিলে ভাবনাকে ছকে ফেলতে সুবিধা হয় বটে।
কিন্তু কাজের কাজ হয় কি না, ভেবে দেখার সময় এসেছে। উস্কানি, কায়েমি স্বার্থ, ভোটব্যাঙ্ক রাজনীতি সক্রিয় নয়, এমন দাবি করা হচ্ছে না। কিন্তু এই উপাদানগুলো যে সহজেই কার্যকর হচ্ছে, খাপে-খাপে বসে যাচ্ছে, দীর্ঘসঞ্জাত দ্বন্দ্ব-বিরোধের জমি প্রস্তুত আছে বলেই সেটা সম্ভব হচ্ছে। শুধু মণিপুর কেন? সারা দেশ জুড়েই গত কয়েক বছরে ঘৃণা, বিভাজন আর বিদ্বেষের রাজনীতি যে লকলকিয়ে বেড়ে উঠতে পারল, তাকে কি কেবলমাত্র কিছু অশুভ শক্তির অঙ্গুলিহেলনের পরিণাম বলে ব্যাখ্যা করা যাবে? বিনা মেঘে বজ্রপাত বলে দাগিয়ে দেওয়া যাবে? অশুভ শক্তির বিদ্যমানতা নিয়ে সংশয় নেই। তার ক্ষমতাকে খাটো করে দেখার মূর্খামিও নেই। কিন্তু আম আদমিকে বিশুদ্ধ ক্রীড়নক বলে ভাবা নিয়ে প্রশ্ন আছে।
মণিপুরের ঘটনা সম্পর্কে নির্যাতিতাদের এক জন সংবাদমাধ্যমে যা বলেছেন, একটু খুঁটিয়ে পড়লেই তা থেকে কয়েকটা দিক বেরিয়ে আসে। খুন হয়েছেন বাবা আর ভাই। নিজে গণধর্ষিতা কুকি মেয়েটি জানিয়েছেন, মেইতেইরা বাড়ি বাড়ি আগুন লাগিয়ে দেওয়ার পরে সবাই যখন পালাতে ব্যস্ত, তখন পুলিশই তাঁদের পাঁচ জনকে ধরে উন্মত্ত জনতার হাতে তুলে দেয়। অতএব প্রশাসনের পক্ষপাত কোন দিকে ছিল, সেটা পরিষ্কার। তার পর তিনি বলেছেন, প্রধান অভিযুক্ত তাঁর ভাইয়ের ‘বন্ধু’। অর্থাৎ? এই যে যুবক, সে নিজে প্রথমে তার ‘বন্ধুর বাবা’কে খুন করেছে, ‘বন্ধু’কে খুন করেছে, ‘বন্ধুর বোন’কে প্রকাশ্য রাস্তায় বিবস্ত্র করে ধর্ষণ করেছে। কায়েমি স্বার্থের সুড়সুড়ি? গুজবে খুন চড়ে যাওয়া? প্রতিহিংসার স্পৃহা? সত্য, তবে তার চেয়েও বড় সত্য, হিংস্রতার উৎসব— দাঙ্গা-হাঙ্গামা-গোষ্ঠী সংঘর্ষ সব সময়েই যে নিষিদ্ধ দরজাটা হাট করে খুলে দেয়। তার উপরে প্রশাসনিক সক্রিয়তায় গাফিলতি থাকলে সেই অরাজক আবহ এমন সব ছাড়পত্রের বোধ তৈরি করে, যাতে লুটপাট-খুন-ধর্ষণ সব কিছুই জলভাত মনে হতে থাকে। অপরাধের সংজ্ঞাটাই ঝাপসা হয়ে আসে।
কৃষণ চন্দরের ‘অমৃতসর’ গল্পে যেমন দেখেছি, এক ব্যক্তি তাঁর গরুটি ল্যাম্পপোস্টে বেঁধে জল আনতে গেলেন। ফিরে এসে দেখেন গরু গায়েব। চোখে পড়ল, সামনের একটি বাড়িতে সে গরু বাঁধা। গিয়ে বলতেই গৃহকর্তা সসম্মানে গরু ফিরিয়ে দিয়ে বললেন, মাফ করবেন! ভেবেছিলাম কোনও মুসলমানের গরু! এই গৃহকর্তা কিন্তু চোর ছিলেন না কোনও দিন। শুধু লুটতরাজের হাওয়ায় মুসলমানের গরু নিয়ে আসাকে তাঁর আর চুরি বলে মনেই হয়নি। বস্তুত যে কোনও দাঙ্গা পরিস্থিতি কত মানুষের ভিতর থেকে কত নৃশংসতা টেনে বার করে আনে, ইতিহাস কি পদে পদে আমাদের দেখায়নি? ২০০২-এর গুজরাত, ১৯৮৯-এর ভাগলপুর, ১৯৮৪-র দিল্লি, ১৯৪৬-৪৭’এর বাংলা, ১৯৪৭-এর পঞ্জাবে? ভিন সম্প্রদায়ের একটি মেয়েকে গাছতলায় বসিয়ে রাখা হয়েছে। সে কাতরাতে কাতরাতে বলে চলেছে, ওগো তোমরা আমার দাদা-কাকা, আমাকে ছেড়ে দাও! এ দিকে পথচলতি মানুষের লাইন লম্বা হচ্ছে। সাধারণ মানুষ সব, রেশন তুলতে বেরিয়ে ফাঁকতালে ধর্ষণের লাইনে দাঁড়িয়ে পড়েছেন। কৃষণ চন্দরেরই গদ্দার উপন্যাসে এই কাহিনি পড়িনি আমরা? বাংলার অবস্থা দেখে জীবনানন্দ দাশের মনে হয়নি কি, ‘সৃষ্টির মনের কথা মনে হয়— দ্বেষ’?
মানুষকে স্বতঃসিদ্ধ ভাবে নির্বিবাদী, অহিংস, কোমলমতি ধরে নিয়ে এগোলে গণ-চরিত্র সতত প্রহেলিকাময় বলেই মনে হবে। অষ্টাঙ্গিক মার্গ মানুষের স্বভাবজ নয় বলেই আলাদা করে তার সাধনার প্রয়োজন হয়। গণহত্যার আয়োজন গণের দ্বারাই হয়, গণজাগরণের স্বপ্নও গণই দেখে। কোন গণের সংখ্যার জোর বেশি, তার উপরেই নির্ভর করে গণ-তন্ত্রের চরিত্র। সেই অঙ্কেই গণতান্ত্রিক নির্বাচনে জিতে স্বৈরাচারী সরকার ক্ষমতা দখল করে। সেই সরকারের প্রশাসন স্বাভাবিক ভাবেই গণহিংসায় দোষ দেখে না, গণপ্রতিবাদের টুঁটি টেপে আর বুক বাজিয়ে বলে যে, মানুষ তার সঙ্গে আছে। কোন মানুষ? যে মানুষ সকালবেলা অতি যত্নে বেলফুলের চারায় জল দেয় আর বেলা বাড়লে পাড়ার মোড়ে পকেটমার ধরা পড়েছে শুনলে দাঁত-নখ বার করে। যে মানুষী রাতে মত্ত স্বামীর মার খেয়ে কাঁদে আর সকালে ট্রেনে সিট দখলের জন্য সহযাত্রিণীর চুলের মুঠি ধরে।
মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারানো পাপ নিশ্চয়। কিন্তু সে বিশ্বাসকে বাঁচিয়ে রাখার রসদটুকু জোগান দেওয়ার দায়িত্বও মানুষেরই। রক্তমাংসের মানুষের দায়িত্ব, মানুষ নামক কোনও আইডিয়ার নয়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy