ফেব্রুয়ারি মাসের শেষ দিনটি ভারতবাসীর কাছে খুবই গর্বের। ভারতের একমাত্র নোবেলজয়ী বিজ্ঞানী সি ভি রমন এই দিনে তাঁর বিখ্যাত ‘রমন এফেক্ট’ আবিষ্কারের কথা ঘোষণা করেছিলেন। সেই কথা স্মরণ করে গত ৩৫ বছর ধরে ২৮ ফেব্রুয়ারি ভারতে ‘জাতীয় বিজ্ঞান দিবস’ হিসাবে পালিত হচ্ছে। প্রত্যেক বছর কেন্দ্রীয় সরকারের উদ্যোগে এই দিনটি পালনের জন্য একটি ভাবনা বা থিম ঠিক করে দেওয়া হয়। এ বছর সেই থিম হল ‘ইন্টিগ্রেশন অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি ফর সাস্টেনেবল ফিউচার’। বাংলা করলে, ‘দেশের মজবুত ভবিষ্যৎ গঠনের জন্য বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সমন্বয়’। ২০১৮ সালের বিজ্ঞান দিবসের থিম-ও ছিল ‘মজবুত ভবিষ্যৎ’ গঠন। সুতরাং, বোঝা যাচ্ছে যে দেশের মজবুতি নিয়ে সরকার চিন্তিত আর সেই দায়িত্ব বিজ্ঞানের উপরে ন্যস্ত করা হচ্ছে। দেশের মজবুত ভবিষ্যতের জন্য বিজ্ঞান-প্রযুক্তি গুরুত্বপূর্ণ সন্দেহ নেই, কিন্তু সরকার এই বিষয়ে ঠিক কী করতে চাইছে, সেটা বুঝতে কিছুটা অসুবিধে হচ্ছে।
কেন, সেই আলোচনায় যাওয়ার আগে এই থিমের বিষয়ে দু’টি কথা বলা যাক। প্রথমত, বিজ্ঞান দিবসের প্রথম দিকের কয়েকটি থিমের দিকে তাকালে দেখব, ১৯৯৯ সালের থিম ছিল ‘আওয়ার চেঞ্জিং আর্থ’ (আমাদের বদলে যাওয়া পৃথিবী), ২০০২ সালে ‘ওয়েলথ ফ্রম ওয়েস্ট’ (বর্জ্য থেকে সম্পদ আহরণ), ২০০৫-এ ‘থিয়োরি অব রিলেটিভিটি’-র শতবর্ষ উপলক্ষে ‘সেলিব্রেটিং ফিজ়িক্স’ (পদার্থবিজ্ঞানের উদ্যাপন) আর ২০১৪ সালে ‘ফস্টারিং সায়েন্টিফিক টেম্পার’ (বিজ্ঞানচেতনার লালন)। অর্থাৎ, তখনও পর্যন্ত বিজ্ঞানভাবনার সঙ্গে দেশসেবার ততটা অঙ্গাঙ্গি সম্পর্ক ছিল না। ২০১৫ সাল (থিম ছিল ‘সায়েন্স ফর নেশন বিল্ডিং’) থেকে শুরু করে প্রায়ই বিজ্ঞান-দিবসের থিমে জাতীয়তাবাদের ছোঁয়া লাগতে দেখা যাচ্ছে। মানে, বিজ্ঞানকে নৈর্ব্যক্তিক অবস্থান থেকে সরিয়ে এনে দেশের কাজে লাগানোর কথা মনে করানো হচ্ছে। দ্বিতীয়ত, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিকে হাতে হাত রেখে এগোতে হবে— এই কথা বলার মানেই হল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিকে আলাদা করে দেখা। প্রযুক্তি যে আদতে বিজ্ঞানই, অন্য কিছু নয়, বিশুদ্ধ বিজ্ঞানের প্রায়োগিক দিকটিই প্রযুক্তি— এই শিরোনাম সেই মূল কথাটিকে অস্বীকার করে। এর প্রেক্ষাপটে আছে এই ভাবনা যে, বিশুদ্ধ বিজ্ঞানের অনেকটাই ‘অপ্রয়োজনীয়’ এবং প্রয়োগমূলক দিকটিই কেবল দরকারি, কেননা সেটা সরাসরি কাজে লাগে। দেশের মজবুত ভবিষ্যতের জন্য তাই বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিকে হাত ধরাধরি করে এগোতে হবে। বিজ্ঞানের যে অংশটি প্রযুক্তির সঙ্গে সম্পর্কিত নয়, তা দেশের উন্নতির জন্য দরকারি নয়। আপাতসরল এই শিরোনামটুকু থেকে এত কথা ভেবে ফেলতে হত না, যদি সরকারের গত কয়েক বছরের কার্যক্রমে এই ভাবনার ছাপ পাওয়া না যেত।
কী রকম, দেখা যাক। দেশ জুড়ে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির গবেষণার বেশির ভাগটাই চলে সরকারি অনুদানে আর কিছুটা বিভিন্ন বাণিজ্যিক সংস্থার উদ্যোগে। সরকার বিভিন্ন গবেষণাকেন্দ্রে অনুদান দেন এবং অধ্যাপক-বিজ্ঞানীদের গবেষণা প্রকল্প অনুমোদন করে টাকা মঞ্জুর করেন। তাই দিয়েই চলে গবেষণা। কিন্তু এই সরল সমীকরণের চেহারা গত কয়েক বছর ধরে বেশ কিছুটা বদলেছে। এক দিকে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি দফতরের জন্য সরকারি বরাদ্দ কমে চলেছে, অন্য দিকে সরকারের তরফ থেকে বিজ্ঞানীদের কাছে বার্তা যাচ্ছে যে দেশের উন্নতির জন্য ‘দরকারি’ বিষয়ে গবেষণা করতে হবে। ২০২২-২৩ আর্থিক বছরে এই দফতরের বরাদ্দ আগের বছরের তুলনায় ৩.৯ শতাংশ কমেছে, ১৪,৭৯৪ কোটি থেকে কমে হয়ছে ১৪,২১৭ কোটি, যা মোট বরাদ্দের ০.৩৬ শতাংশ। ২০২০-২১ আর্থিক বর্ষেও এই বরাদ্দ আগের বছরের তুলনায় ২০ শতাংশ কমেছিল। অর্থাৎ, বিজ্ঞান-প্রযুক্তির উপর দেশকে শক্তিশালী করে তোলার দায়িত্ব দিলেও সেটা যে স্বল্পমূল্যেই করতে হবে, এটাও নীরবে দাবি করা হচ্ছে। এর ফলে বিজ্ঞানী-গবেষকরা এত দিন যে ভাবে নিজেদের পছন্দমতো বিষয়ে গবেষণা প্রকল্প (রিসার্চ প্রজেক্ট) লিখে গবেষণার অনুদান পেতেন, সেটা এখন খুবই অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। রিসার্চ প্রজেক্ট-এর ক্ষেত্রেও সরাসরি প্রয়োগ আছে (ল্যাব টু ল্যান্ড), এমন বিষয়ের নাম উল্লেখ করে প্রজেক্ট চাওয়া হচ্ছে, যেখানে বিভিন্ন সংস্থার বেশ কয়েক জন বিজ্ঞানী মিলে কাজ করবেন। অনেক ক্ষেত্রে কোনও শিল্পসংস্থার পক্ষ থেকেও এক জন অংশীদার থাকবেন (অর্থাৎ, তাঁরাও কিছুটা ব্যয়ভার বহন করবেন) এমন প্রজেক্টেই সরকার টাকা দিচ্ছে। স্বভাবতই, তাত্ত্বিক এবং মৌলিক গবেষণা ভীষণ ভাবে বঞ্চিত এবং বিঘ্নিত হচ্ছে। গবেষণাগারগুলোকে নির্দেশ দেওয়া হচ্ছে গবেষণার খরচ নিজেদের ‘রোজগার’ করে নিতে। যার অর্থ হল, শিল্পতালুকের সঙ্গে হাত ধরাধরি করে চলতে হবে। এবং বলা বাহুল্য, প্রয়োগমূলক কাজ ছাড়া শিল্পসংস্থাও সহযোগিতায় আগ্রহী হবে না। সুতরাং, থিম কেবল কথার কথা নয়, সত্যি কথাই বলছে— ভারতের বিজ্ঞান গবেষণাকে পরিকল্পিত ভাবেই প্রযুক্তির দিকে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে।
দেশের উন্নতির জন্য শুধু প্রয়োগনির্ভর কাজেরই দরকার আছে, এই ধারণা কিন্তু সর্বৈব ভ্রান্ত। কারণ, যে কোনও প্রযুক্তির উৎস হল মৌলিক বিজ্ঞান। যে ‘রমন এফেক্ট’ আর তার নোবেল স্বীকৃতি নিয়ে আমাদের এত গর্ব, সেই আবিষ্কার কি রমন-বর্ণালির (স্পেকট্রাম) ব্যবহারের কথা ভেবে করা হয়েছিল? নিশ্চয়ই নয়। যে সব প্রযুক্তি আমাদের জীবন বদলে দিয়েছে, তার বেশির ভাগই প্রথমে তাত্ত্বিক ভাবে আবিষ্কার হয়েছে এবং অনেকটা সময় ধরে একটু একটু করে প্রয়োগের রাস্তায় এসেছে। মৌলিক বিজ্ঞানই প্রযুক্তিকে রসদ জোগায়। তাই, মৌলিক গবেষণা পিছিয়ে পড়লে তা প্রযুক্তির অগ্রগতিকেও বাধা দেবে। আজ যে সব প্রযুক্তি কাজে লাগিয়ে খুব সহজে আমাদের ঘরে আলো-পাখা-টিভি-ইন্টারনেট চলে, তার সবের পিছনেই রয়েছে মৌলিক বিজ্ঞানের বহু বছরের সাধনা। তাই, বিজ্ঞানকে দেশের ভবিষ্যতের সঙ্গে যুক্ত করতে গেলে বিজ্ঞানের গবেষণা যত ব্যাপক এবং সর্বাত্মক হয়ে উঠবে, ততই মঙ্গল। উন্নত দেশে তাই মৌলিক গবেষণায় শুধু সরকার নয়, বেসরকারি সংস্থাও টাকা ঢালে।
আর শুধু বড় বড় গবেষণাগারের বিজ্ঞানীরাই তো গবেষণা করেন না, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরাও অনেকেই পড়ানোর পাশে নিজস্ব উদ্যোগে কিছুটা গবেষণা করেন। ছোট গবেষণা প্রকল্পের অনুদানগুলোই তাঁদের গবেষণাকে বাঁচিয়ে রাখে। এই পরিবর্তিত বিজ্ঞাননীতির দরুন দেশ জুড়ে সে সব গবেষণা প্রায় বন্ধ হওয়ার পথে। প্রতিষ্ঠিত বিজ্ঞানীরাও স্বাধীন ভাবে কাজ করতে না পেরে যথেষ্ট চিন্তিত ও বিড়ম্বিত। সুতরাং, বিজ্ঞান দিবসের থিম যা-ই বলুক, সরকারি নীতি যে তার বিপরীতে যাচ্ছে, তাতে সন্দেহ নেই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy