বাংলায় একের পর এক চটকলে ‘সাসপেনশন অব ওয়ার্ক’ নোটিস ঝুলছে। গত কয়েক বছরে গোটা কুড়ি চটকল বন্ধ হয়ে গিয়েছে, পঞ্চাশ হাজারের উপর শ্রমিক কাজ হারিয়েছেন। অথচ চাহিদা অনুসারে চটের বস্তা জোগান দিতে পারছে না বাংলার চটকলগুলি। যে আটান্নটি চটকল চালু রয়েছে, সেখানেও শ্রমিকদের ন্যূনতম প্রাপ্য ও সুবিধাগুলো পেতে হয়রান হতে হচ্ছে। আড়াই লক্ষ শ্রমিকের নব্বই শতাংশই ‘ক্যাজুয়াল’ বা অস্থায়ী শ্রমিক। ইএসআই, প্রভিডেন্ট ফান্ড, গ্র্যাচুইটি কেবল খাতায়-কলমে রয়ে যাচ্ছে। চটকল শ্রমিকদের জীবন ক্রমশ অনিশ্চয়তার গহ্বরে ডুবে যাচ্ছে।
তার পরও সমগ্র ব্যারাকপুর শিল্পাঞ্চল অকল্পনীয় রকমের শান্ত। এমনকি কেন্দ্রীয় সরকারের শ্রমবিধির প্রতিবাদেও কোনও বিক্ষোভের ঢেউ দেখা যাচ্ছে না। অথচ নতুন শ্রমবিধি অনুসারে মালিকরা ইচ্ছেমতো কাজের সময় নির্ধারণ করতে পারেন; ন্যূনতম মজুরি বিধি অগ্রাহ্য করতে, ইচ্ছেমতো ছাঁটাই করতে পারেন। সেই আশঙ্কায় বিশেষ হেলদোল দেখা যাচ্ছে না শ্রমিক মহলে। গোটা শিল্পটাই এমন অনিশ্চয়তার মধ্যে রয়েছে যে, আন্দোলন সংগঠিত করার উদ্যোগও চোখে পড়ছে না।
অথচ, স্বাধীনতার পর বাংলার চটকলগুলিই শ্রমিক আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছিল। ১৯৭৭ সালে রাজ্যে পালাবদলের আগে-পরেও ১৯৭৫, ১৯৭৯ ও ১৯৮৪ সালে একের পর এক আন্দোলন করেন চটকল শ্রমিকরা। শ্রমিকদের বেতনবৃদ্ধি, ইএসআই, মহার্ঘভাতা, গৃহভাতা, গ্র্যাচুইটি, প্রভিডেন্ট ফান্ড, চাকরির নিশ্চয়তা, বোনাস আদায় করা গিয়েছিল এই সব আন্দোলনের ফলেই, যা আর্থিক নিশ্চয়তার সঙ্গে সঙ্গে শ্রমিকদের সামাজিক, রাজনৈতিক তথা মানসিক ক্ষেত্রেও পরিবর্তন এনেছিল। বিহার-উত্তরপ্রদেশ থেকে আসা শ্রমিকরা বাংলায় স্থায়ী ভাবে বাস করতে শুরু করেন, অনেকে জমি-বাড়িও কেনেন। শিল্পাঞ্চলগুলিতে এঁদের ভোট গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। ভাটপাড়া বিধানসভা এবং গাড়ুলিয়া, টিটাগড়, ভাটপাড়া, নৈহাটি প্রভৃতি পুরসভায় হিন্দিভাষী কাউন্সিলর বাড়তে থাকে।
বামফ্রন্টের শাসনকালেই ক্রমে চটকলের শ্রমিকদের দাবি রাজনৈতিক গুরুত্ব হারাল। তার অন্যতম কারণ ভোটের রাজনীতি। ১৯৬৭ সালের বিধানসভা নির্বাচনের সময় থেকেই বামপন্থীরা ওয়াকিবহাল ছিলেন যে, মিলের অভ্যন্তরে চটকল শ্রমিকরা তাঁদের সমর্থন করলেও, নির্বাচনে ভোট দেন না। এই অঞ্চলের কংগ্রেসি নেতারাই বার বার বিধানসভা ও পুরসভার ভোটে জয়ী হয়েছেন। এর প্রধান কারণ সামাজিক দূরত্ব। শিক্ষিত, মধ্যবিত্ত নেতাদের হাতেই বামপন্থী আন্দোলনের রাশ থেকেছে। ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনও সীমিত থেকে গিয়েছে শ্রমিকদের কারখানার মধ্যে অতিবাহিত আট ঘণ্টার জীবনে। কারখানার বাইরের ১৬ ঘণ্টাকে নেতারা তেমন গুরুত্ব দেননি। যার ফলে সামাজিক সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে তাঁরা শ্রমজীবীদের জীবনের থেকে দূরে থেকে গিয়েছেন, তাঁদের বৃহত্তর জীবনকে স্পর্শ করতে তাঁরা ব্যর্থ হয়েছেন। আজও এই হিন্দিভাষী চটকল শ্রমিকরা অধিকাংশ ট্রেড ইউনিয়ন নেতার কাছে ‘বহিরাগত’ পরিযায়ী শ্রমিক। বেতন বৃদ্ধির বাইরেও তাঁদের কিছু চাহিদা থাকতে পারে, তা এই নেতারা ধর্তব্যের মধ্যেই আনেন না। এখানেই বাংলার ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনের সীমাবদ্ধতা। ট্রেড ইউনিয়নের ১০০ বছর অতিক্রান্ত হয়েছে। খুব কম নেতাই উঠে এসেছেন শ্রমজীবীদের মধ্যে থেকে।
ষাটের দশকে লড়াই-করা বামপন্থী নেতারা শ্রমিকদরদি হওয়ায়, সত্তরের দশকের শেষে ক্ষমতায় আসার পরেও তাঁরা ভোটের রাজনীতিকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিতেন না। কিন্তু আশির দশকে যে নেতা-কর্মীরা উঠে এলেন, তাঁদের কাছে বামফ্রন্টের সরকারকে টিকিয়ে রাখাই ছিল মূল উদ্দেশ্য। মিল এলাকায় বাহুবলী হিন্দিভাষী নেতাদের সঙ্গে তাঁরা সমঝোতার রাজনীতি করে নেন। বস্তিগুলির যাবতীয় রাজনৈতিক কার্যকলাপ তাঁদের উপরেই ছেড়ে দেন বামপন্থীরা। তবে বামপন্থী শ্রমিক সংগঠনগুলি চটকলের ভিতরে ক্ষমতার রাশ নিজেদের হাতেই রাখে।
১৯৯০ সালে বিশ্বায়ন ও উদারীকরণের প্রভাবে বাংলার বামফ্রন্ট সরকারের নীতিতে পরিবর্তন দেখা যায়। আন্দোলন, ধর্মঘট, ঘেরাও-এর ইতিহাস থেকে সরে এসে সরকার ‘কর্মসংস্কৃতি’র বুলি আওড়ানো শুরু করে। শ্রমিকদের উপর লাঠিচালনা, আগে যাকে বলা হত ‘পুলিশি বর্বরতা,’ তাকে ‘আইনশৃঙ্খলা রক্ষা’ বলা হতে লাগল। ক্ষমতাসীন বামফ্রন্টের সর্ববৃহৎ পার্টি সিপিএম তার অধীনস্থ সমস্ত ট্রেড ইউনিয়নকে তীব্র নিয়ন্ত্রণ করার ফলে সেগুলোর স্বাধীন সত্তা আর বজায় থাকল না। তাই বেঙ্গল চটকল মজদুর ইউনিয়নের মতো শক্তিশালী সংগঠনও ক্রমশ সরকার অধীনস্থ ট্রেড ইউনিয়নে পরিণত হয়। নব্বইয়ের দশকে বামফ্রন্টের নির্বাচনী ইস্তাহার থেকে চটকল শ্রমিকদের সমস্যা ক্রমশ অপসারিত হতে থাকে। ২০১১ সালে চটকল শ্রমিক সমস্যা বামফ্রন্ট নির্বাচনী ইস্তাহার থেকে সম্পূর্ণ বিলুপ্ত হয়। তা সত্ত্বেও তৃণমূল আমলে চটকলগুলিতে বামপন্থী শ্রমিক ইউনিয়নের প্রভাবই সর্বাধিক। যদিও মিল-বহির্ভূত অঞ্চলের একটি বড় অংশে সমর্থন সরে গিয়েছে বিজেপির দিকে।
এই জটিল রাজনৈতিক সমীকরণ চটকলের শ্রমিকদের বিচ্ছিন্নতা, প্রান্তিকতা বাড়িয়ে তুলছে। অতিমারিতে দীর্ঘ দিন চটকল বন্ধ থাকা, তার পরেও অতি সামান্য কর্মীর কাজে ফেরা, কাঁচা পাটের অবৈধ মজুতদারি, চটকল বন্ধ হওয়ার আশঙ্কা, এ সবই শ্রমিকদের শক্তিক্ষয় করেছে। বাস্তবিক চটকলের শ্রমশক্তির পরিমাপও নেই— মিল মালিকদের সংগঠন (আইজেএমএ) ১৯৯৫ সালের পরে শ্রমিক সংক্রান্ত কোনও পরিসংখ্যানই আর রাখে না। রাজ্য সরকারও শ্রমিক সম্পর্কিত বার্ষিক রিপোর্ট প্রকাশ বন্ধ করেছে। ফলে রাজ্যের অন্যতম বৃহত্তম শিল্পে শ্রমিকদের পরিস্থিতি কী, তাও অজানা।
শ্রমিকের মর্যাদার জমি হারাচ্ছেন শ্রমিকরা সারা দেশেই, পশ্চিমবঙ্গের চটকল তার অন্যতম দৃষ্টান্ত।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy