আপনাকে বেশি উত্ত্যক্ত করলাম না তো?” এফএম চ্যানেলের অনুষ্ঠানে অনলাইনে উপস্থিত ছিলেন অলিম্পিক্স সোনাজয়ী নীরজ চোপড়া। সঞ্চালিকা শুরুতেই প্রগল্ভ নাচগান করে তাঁকে এই প্রশ্ন ছুড়লেন। যে তরুণ বিশ্বমঞ্চে জাতির অনাদিকাল লালিত স্বপ্ন সত্যি করেছেন, তাঁর ব্যক্তিগত পরিসরে জবরদস্তি ঢুকে পড়ার ইচ্ছে হল কেন? কারণ এটাই দেশের রেওয়াজ। ঘাড় উঁচু করেও নীরজ চোপড়ার কৃতিত্বের উচ্চতা ঠাহর করা যায় না। তাই তাঁকে নিজেদের সমতলে টেনে নামানোর অসংস্কৃত চেষ্টা। আর এমন আচরণেও ধৈর্যে অবিচল নীরজ। যেন তাঁর বিক্রান্ত-দ্যুতিতে ঠোকর খেয়ে ঝরে যায় অসম্মান।
এমন স্নিগ্ধ নক্ষত্র কালেভদ্রে আসেন বলেই কি এ দেশে কাপ-ট্রফি তো অগুনতি ওঠে, কিন্তু ট্র্যাক অ্যান্ড ফিল্ডের মতো মহারথী ইভেন্টে প্রথম সোনা আসতে শতাব্দী পার হয়ে যায়? জর্জ অরওয়েল বলেছিলেন, পেশাদার খেলাধুলা হল বিনা গুলিগোলার যুদ্ধ। তামাম ভারত তথা বর্তমানের বহু ময়দানি নায়ক সেটাকেই যেন মোক্ষ মানেন। তাঁদের আগ্রাসন, বাগ্যুদ্ধ, বিপক্ষকে শত্রুজ্ঞানে যেন তেন প্রকারেণ চিৎপাত করে ফেলা, ঘৃণা-ঈর্ষা-ইগোয় মাখামাখি উৎকট উল্লাসেই আমরা অভ্যস্ত। ভারতীয় ক্রিকেট দলের চলতি ইংল্যান্ড সফরে সেই বিতর্ক, খেলোয়াড়দের মধ্যে ঝঞ্ঝাট, গ্যালারির অভব্যতার প্রদর্শনী চলছে। ক্রিকেটের মতো জেন্টলম্যান’স গেমে এই ‘যুদ্ধ যুদ্ধ’ রণভেরি চিরকালই ভয়ঙ্করী। এতটাই যে, প্রতিবেশীর সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক সিরিজ় আয়োজনই হয়ে ওঠে না। একটা সেঞ্চুরি হাঁকিয়েই আত্মম্ভরিতার ষোলোকলা, কলার তোলা চলন-বলন, প্রাক্তন সতীর্থ বা সংবাদমাধ্যমকে হেনস্থা— উঠতি-পড়তি বহু ক্রিকেটারেরই স্টাইলের অঙ্গ। অসীম ব্যঞ্জনায় এই সব হল্লাহট্টগোলের উল্টো দিকে শান্ত ও সংহত দাঁড়িয়ে আছেন খোদ যুদ্ধভূমি পানীপতের স্টেডিয়ামে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত নীরজ। সোনা জেতার পর আফসোস করছেন পাক প্রতিযোগী নাদিমের পদক ফস্কানোর জন্য। বলছেন, এশিয়ার দু’জন পোডিয়ামে উঠলে ভাল হত। নাদিম তাঁর জ্যাভলিন নিয়ে চলে গিয়েছিলেন বলে জলঘোলা করতে নিষেধ করছেন। আর অরওয়েলের বাণীকেও অসাড় করে বলছেন, খেলা আমাদের ঐক্যবদ্ধ থাকতে শেখায়। কেরিয়ার শেষের আগে তাঁর বায়োপিক না ভাবতেও অনুরোধ রাখছেন।
আশ্চর্য! কারণ তাঁর খেলাটি সরাসরি আদিম সভ্যতারই জাতক। রণক্ষেত্রের সঙ্গেই তার যোগাযোগ। শিকারের বর্শার বিবর্তিত রূপ জ্যাভলিন থ্রোয়িং। ২৫০০ বছর আগে গ্রিসের প্রাচীন অলিম্পিক্সেও থাকত এই ইভেন্ট। তাই কৌলীন্য প্রশ্নাতীত। নতুন অলিম্পিক্সে তাতে কেবলই ইউরোপিয়ান অ্যাথলিটদের মৌরসিপাট্টা। সেই বৃত্তে নীরজ কিন্তু যথেষ্ট সমীহ উদ্রেককারী। ২০১৬-য় পোল্যান্ডে অনূর্ধ্ব ২০ বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে বিশ্বরেকর্ড করে সোনা জিতেছিলেন। ভারতবাসীর গাত্রোত্থান না হলেও তখন থেকেই তাঁর ভক্ত মার্ক জ়ুকারবার্গ। অলিম্পিক্স তো দূরগ্রহ, ২০১৮-য় গোল্ড কোস্টে নীরজের সোনার আগে কমনওয়েলথেও জ্যাভলিনে পদকই ছিল না ভারতের। সে বছরই অর্জুন পুরস্কার তাঁর।
পিটি ঊষার কথায়, অ্যাথলেটিক্স, বিশেষত ট্র্যাক অ্যান্ড ফিল্ড সব খেলার জননী। গ্রহের কঠিনতম এই খেলায় প্রতিযোগিতা চলে নিজের সঙ্গে। বন্ধুর, প্রতিকূল প্রকৃতি আর মানবজীবনের সামর্থ্যের সঙ্গে পাল্লা দিতে হয়। এ ক্ষেত্রে অন্যকে হারানো অভীষ্ট নয়। নিজের গতি, শক্তি আর নমনীয়তার সীমানাটাকে টান মেরে মেরে বাড়িয়ে যেতে হয় অতিমানব হয়ে। নীরজ স্বীয় মানোন্নয়নের সেই পাখির চোখটাকেই দেখেছিলেন। বিরতির পর মহম্মদ আলি যেমন সিংহ হয়ে উঠে রিঙে ফিরতেন, তেমন অস্ত্রোপচার, কোভিডে অনুশীলনের ব্যাঘাতের বাধা টপকে আরও অদম্য হয়ে প্রত্যাবর্তন হয়েছে তাঁর। তাই বোধ হয় হৃদয়ের পরিধিও এতটা বিরাট। বিশ্বসেরা জোহানেস ভেত্তার প্রায়শই ৯০ মিটার জ্যাভলিন ছোড়েন। তাঁকে পিছনে ফেলেও তিনি নির্দম্ভ। বলেছেন, “দিনটা বেচারার ছিল না।” যে খেলোয়াড় নীরজকে বিদ্রুপ করেছিলেন, তিনি প্রথম দশেই আসেননি। স্বর্ণজয়ী বলছেন, “বড় খেলোয়াড়দের সঙ্গে অমন হয়।” রেষারেষি তাঁর চর্যায় নেই।
ইতিহাস গড়ল ৮৭.৫৮ মিটারের তাঁর দ্বিতীয় থ্রো। রেকর্ড বলছে, ফাইনালে অন্য থ্রোয়াররা ৮৭ মিটারের ঘরেই পৌঁছাননি। দ্বিতীয় থ্রোয়ে জ্যাভলিন শূন্যে ছুটতেই সোনা দেখে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করছেন নীরজ, আর বর্শা উড়তে উড়তে সেই ৮৭.৫৮ মিটারে পেরিয়ে যাচ্ছে দেড়শো কোটির অপ্রাপ্তি, হতাশা, নর্ম্যান প্রিচার্ডের ভারতীয়ত্ব নিয়ে সংশয়, মিলখা-ঊষার পদক থেকে মুহূর্তের ভগ্নাংশ দূরে থেমে যাওয়ার যন্ত্রণা। ভারত আর অ্যাথলেটিক্সে ব্যক্তিগত সোনার মধ্যের চিরকাল থেকে যাওয়া সেই এক চুলের দূরত্ব পেরিয়ে মাটিতে গেঁথে যাচ্ছে নীরজের জ্যাভলিন ভালহালা।
সর্বোচ্চ পোডিয়ামে তিনি উঠতে বাজল “গাহে তব জয়গাথা।” লোকগাথায় রইল তাঁর বীরত্ব। কিন্তু, তাঁর জীবনী ঠোঁটস্থ করে ফেলা ভারতবাসী তাঁর স্পোর্টসম্যান স্পিরিটের প্রতাপটিকে আদর্শ করতে পারবে? এই সময়, এই লেলিহান পরিপার্শ্বে পড়শির প্রতি সহিষ্ণুতার পাঠ যে জরুরি! সমকাল বিচারে নীরজ তাই সার্থক রোল মডেল। আমরা ধারণ করতে পারব তো এই নতুন তারা, তরুণ আইকনের সেই সোনালি আলো?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy