সন্ধান: এ কে ফজলুল হক, আবুল হাশিম, শেখ মুজিবুর রহমান— অবিভক্ত ভারতের তিন বাঙালি নেতা।
সব সূচনারই পিছনে থাকে আর একটা সূচনা। পঞ্চাশ বছর আগে পাকিস্তানের কবল থেকে বেরিয়ে এসে যে দেশটি জন্মেছিল, তার সূচনাবীজ কী ছিল? সে কি ১৯৪০ সালের ঐতিহাসিক লাহৌর (পাকিস্তান) প্রস্তাব, না কি ১৯৪৮ সালের মার্চ মাসে মহম্মদ আলি জিন্নার কালান্তক ঘোষণা— ‘উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা’?
প্রথম ঘটনার পর কী ভাবে বাংলার পরিস্থিতি ধীরে ধীরে পাল্টে গিয়েছিল, সেটা আজ বহুপঠিত ইতিহাস। আর, দ্বিতীয় ঘটনার পর কী ভাবে পূর্ব পাকিস্তানের সমাজ-রাজনীতি দ্রুত পাল্টাল, তা প্রায় রোমাঞ্চকর উপকথায় পরিণত। তবে আমরা হয়তো ভুলে যাই— এই দু’টি ঘটনার মধ্যে কিন্তু এক আবশ্যিক কার্যকারণের সম্পর্ক ছিল। ১৯৭১ ঘটতে পারত না, যদি না ১৯৪০ থেকে একটি নতুন রেখা ধরে ছুটত বাংলার ইতিহাস। আর, ১৯৪০ (এবং তার দুর্ভাগ্যময় পরিণতি ১৯৪৭)-কে শেষ পর্যন্ত পৌঁছতেই হত ১৯৭১ সালের ঘটনায়। সে দিক থেকে, মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশের জন্মকে বলাই যায় দেশভাগের ‘আবশ্যিক’ পরবর্তী ধাপ।
আসলে, অবিভক্ত ভারতের মুসলিম লীগ-এর সর্বাধিপতি জিন্না ‘পাকিস্তান’ ও ‘হিন্দু-মুসলিম দ্বিজাতিতত্ত্ব’ বলে যা প্রচার করছিলেন, তাকে বধ করার উপযোগী একটা ভিন্ন জাতিবোধ অনেক দিন আগে থেকেই গোকুলে বেড়ে উঠেছিল— যার ভিত্তি বাংলা ভাষা, বাংলা সংস্কৃতি, বাঙালি জীবনচর্যা। ‘হিন্দু বনাম মুসলিম’ নয়, সেটা ছিল বাঙালি হিন্দু আর বাঙালি মুসলমানের অংশীদারিতে তৈরি বাঙালি জাতি। পরস্পরের সঙ্গে তারা ‘ওতপ্রোত’ ছিল না, কিন্তু পাশাপাশি বাস করে যথেষ্ট পরিমাণে ‘সংযুক্ত’ ছিল। বাঙালি মুসলমানের মধ্যে সেই প্রদীপ্ত বাঙালি জাতিবোধ একেবারে বুঝতে পারেননি পাকিস্তান আন্দোলনের হোতারা। বুঝতে পারেননি, ভারতের সব মুসলমানকে— বাংলা, উত্তর ভারত, পঞ্জাবের মুসলমানকে মিলিয়ে দিলেই একটা জাতিরাষ্ট্র তৈরি হয় না, ধর্মের পরিচিতি অন্য সব পরিচিতিকে ভুলিয়ে বা সরিয়ে দিতে পারে না।
এই না-বোঝার পিছনে ছিল একটা বিরাট স্পর্ধা। এবং, আকাশচুম্বী অজ্ঞতা। তাঁরা হয় বোঝেননি, কিংবা বুঝেও না বোঝার ভান করেছেন যে, বাঙালি মুসলমানের মধ্যে প্রোথিত বাঙালিত্ব একটি বহু কালের বাস্তব। পূর্ববঙ্গীয় মুসলমান কেবল মুসলমানই নন, প্রথমত ও শেষত বাঙালি, অত্যন্ত রকম বাঙালি। এবং সেই কারণে অন্য মুসলমানদের থেকে তাঁরা আলাদা ও বিশিষ্ট— এ কথাটা বোঝা খুব কঠিন ছিল কি? বার বার তা বলেছেন বাঙালি মুসলমান নেতারা, সাংবাদিকরা, লেখকরা, সম্পাদকরা, শিক্ষকরা। বিশ শতক জুড়ে একটা স্পষ্ট ধারাবাহিকতা দেখি বাংলার এই বিশিষ্ট সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যে।
এবং— নিঃসন্দেহে একটা দ্বন্দ্বও ছিল সেই ঐতিহ্যে। আসলে বাঙালিত্ব ও মুসলমানত্বের মধ্যে দ্বন্দ্বও বেশ পুরনো ঘটনা। সেই স্বদেশি আন্দোলনের সময় থেকেই এই ধরনের দ্বন্দ্বদীর্ণ কথাবার্তা আমাদের চোখে পড়ে। সে যুগের পত্রপত্রিকায় পড়ি, বিভিন্ন মানুষ বিভিন্ন ভাবে এই দ্বন্দ্বের নিরসন করতে চাইছেন। বাঙালি, না কি মুসলমান, না কি বাঙালি-মুসলমান, কিংবা আরও বড় করে, ভারতীয়-মুসলমান? জাতি বিষয়ে কত বিচিত্র ভাবনা চলেছে।
আশ্চর্য এই যে, ১৯৪০-এ লাহৌর প্রস্তাবের পর ১৯৪৭ সাল পর্যন্তও জাতি-বিষয়ক এই বিচিত্র ভাবনা প্রবাহিত হতে থেকেছে। ফজলুল হক, আবুল হাশিমের মতো নেতারা তখনও বাঙালিত্ব-কে সামনে রেখে আইডেন্টিটি-র তর্কবিতর্ক করছেন। শেখ মুজিবুর রহমানের আত্মজীবনীতে পড়ি, কী ভাবে ১৯৪৬-৪৭ সালে পাকিস্তান আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়ার সময়েও আবুল হাশিমের কড়া নির্দেশ, কোনও হিন্দুবিরোধী কথা উচ্চারণ নয়, কারণ “আমাদের সংগ্রাম হিন্দুদের বিরুদ্ধে নয়, ব্রিটিশের বিরুদ্ধে— আসুন আমরা জাতি ধর্ম নির্বিশেষে তা করি।” জিন্না যা-ই বলুন না কেন, বাংলার বহুমান্য নেতা ফজলুল হক স্পষ্ট করে দিয়েছিলেন লাহৌর প্রস্তাবের পরই, “কোনও মতে বাঙালি মুসলমানকে ভুল বুঝিয়ে বোকা বানানো যাবে না যে বাংলার স্বার্থ আর পঞ্জাবের স্বার্থ এক।”
‘পাকিস্তান’ বলতে ফজলুল হক চল্লিশের দশকের মধ্য ভাগেও ভেবেছেন বাংলায় একটা কোয়ালিশন সরকারের কথা: “উই হ্যাভ টু সিক দ্য হেল্প অব আদার ইন্টারেস্টস অ্যান্ড মাইনরিটিজ় অব দ্য প্রভিন্স টু ফর্ম আ কোয়ালিশন গভর্নমেন্ট।” পূর্ব পাকিস্তান রেনেসাঁস সোসাইটি কিংবা পূর্ব পাকিস্তান সাহিত্য সংসদ-এর মতো সংগঠন তৈরি হয়ে গিয়েছে তত দিনে, বাঙালি মুসলমানের সত্তাবোধকে তুলে ধরে তাতে লিখেছেন মুজিবুর রহমান খান, আবুল মনসুর আহমদ, আবুল কালাম শামসুদ্দিন। তাঁরা সম্প্রীতির কথা বলছেন, ‘ইদ-পূজা-সম্মিলন’ আয়োজন করছেন। বাঙালি সংস্কৃতির মধ্যেই মুসলমান-জীবনধারা সিঞ্চিত একটি সংস্কৃতি তৈরির কথা বলছেন। দাবি করছেন, এখানেই পূর্ব পাকিস্তান আলাদা— হিন্দু সংস্কৃতির থেকেও, আবার অন্য সমস্ত জায়গার মুসলমানদের থেকেও।
এত কিছু চলছে, তবু অন্ধ হওয়ার ভান করে প্রলয় বন্ধ করার চেষ্টা চালাচ্ছিলেন জিন্না আর তাঁর সর্বভারতীয় মুসলিম লীগ। বাঙালির জাতিসত্তাকে চাপাচুপি দিয়ে ভুলিয়ে দেওয়ার বন্দোবস্ত করেছিলেন। দেশভাগের পরও ঠিক এটাই চালিয়ে যেতে চাইলেন তাঁরা— সেই ‘স্টিমরোলিং’ বন্দোবস্ত। তারই ছাপ ১৯৪৮ সালের সেই ভয়ঙ্কর উদ্ধত সিদ্ধান্তে। স্বাভাবিক ভাবেই ফুঁসে উঠল ‘প্রলয়’, এত দিন ধরে সযত্নে লালিত পূর্ববঙ্গ তথা পূর্ব পাকিস্তানের বাসিন্দাদের ‘বাঙালিত্ব’। আটচল্লিশ সাল থেকেই আকাশবাতাস কাঁপতে লাগল একটি ধ্বনিতে: ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’। আর সেই স্লোগানের তলায় ডুবে যেতে লাগল ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ’ ধ্বনি। কায়েদ-এ-আজম জিন্নার বিরুদ্ধাচরণ করার কথা যাঁরা কয়েক মাস আগেও ভাবতে পারতেন না, তাঁদেরই বক্তৃতায় শোনা গেল, “জিন্নাই হোন আর যেই হোন, বাংলা ভাষার কোনো বিরুদ্ধাচারীকে বাঙালি ক্ষমা করবে না।”
কেবল ভাষাই তো নয়, অর্থনীতিও ছিল। পূর্ব পাকিস্তানের জনসংখ্যা অনেক বেশি হওয়া সত্ত্বেও তার দারিদ্রমোচন, উন্নয়নে আগ্রহ দেখালেন না পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকরা। ধর্ম দিয়ে বেশি দূর যাওয়া যায় না, ইসলামি ভ্রাতৃত্ব কোনও বাস্তব সমস্যার সুরাহা করবে না: টের পেলেন পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ। টের পেলেন যে ইসলামাবাদের সঙ্গে ‘ইসলাম এবং পিআইএ বিমান ছাড়া’ কোনও যোগ নেই তাঁদের। এরই পরিপ্রেক্ষিতে পেশ হল ১৯৬৬ সালের শেখ মুজিবের বিখ্যাত ছয় দফা দাবি, বাঙালির দাবি। পূর্ববঙ্গে এই দাবির বিপুল জনপ্রিয়তা এবং পাকিস্তানের শাসকদের ত্বরিত সন্ত্রস্ত প্রতিক্রিয়া সে দিন রাতারাতি শেখ মুজিবকে বিরাট নেতাতে পরিণত করল। বহু দিনের লালিত বাঙালি সত্তা, এবং গত দুই দশকের পাকিস্তান-বিরোধিতা যেন একটি বিন্দুতে এসে ঘন হল— বহুপ্রতীক্ষিত লগ্ন এল, সংগ্রামের লগ্ন। ১৯৭১ সালে ১৬ ডিসেম্বর এল জয়: সর্বার্থে অনুন্নত, পিছিয়ে-থাকা এক অঞ্চলের রিক্ত দরিদ্র মানুষ অসামান্য মনের জোরে লড়াই করে প্রবল প্রতাপান্বিত শাসক পাকিস্তানকে পর্যুদস্ত করে ফেলল। অবশ্যই ভারতের সামরিক সহায়তা এবং পশ্চিমবঙ্গের বাঙালির বিপুল জনসমর্থন ছিল তাদের পাশে। দুই পারের বাঙালির মধ্যে সুতোটি আবার নতুন করে বেঁধে দিল মুক্তিযুদ্ধ।
সুতরাং, ইতিহাসের অভ্রান্ত যুক্তিচক্রে, লাহৌর প্রস্তাবের তিরিশ বছর বাদে, অসংখ্য প্রাণের দামে, অবর্ণনীয় ক্লেশস্বীকারের পর, বাঙালি মুসলমান শেষ পর্যন্ত আদায় করতে পারল তার বাঙালি হওয়ার অধিকার। কোথায় যেন ১৯৪৭ সালের ভ্রম ও বিভ্রমের মূল্য কিছুটা হলেও চোকানো গেল। ধর্মের ভিত্তিতে যে সমাজের ভাগ হয় না, এমনকি রাষ্ট্রের ভাগও স্থায়ী হয় না— বুঝিয়ে দিল বাংলাদেশের জন্ম।
অবশ্য ১৯৭১ সালের তীব্র আশাময়তায় বাধা পড়ল, অচিরেই বোঝা গেল এই উপমহাদেশ ততখানি আশা বাঁচিয়ে রাখতে অক্ষম। ১৯৭৫-এ মুজিব-হত্যা প্রমাণ, সাম্প্রদায়িক রাজনীতির হাত কত দীর্ঘ, কত তীব্র। বোতল-দৈত্য এক বার বেরিয়ে এলে আর কি তাকে বোতলে পোরা যায়?
তবে, ১৯৭১-এর শিক্ষাও বৃথা গেল না। আমরা দেখলাম কী অবিশ্বাস্য কঠিন পরিস্থিতিতেও ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক রাজনীতির মোকাবিলা করা সম্ভব, ক্ষমতান্ধ রাষ্ট্রের ধর্মীয় জিগিরের সামনে রুখে দাঁড়ানো সম্ভব। বুঝলাম, কী ভাবে গরিব দুঃখী অর্ধভুক্ত কটিমাত্র-আচ্ছাদনকারী মানুষের পক্ষেও অধিকারের লড়াইয়ে জান লড়িয়ে দেওয়া সম্ভব।
সব সূচনারই সূচনা থাকে। স্বাধীনতা ও দেশভাগের আগে যে বাঙালি মুসলমান নেতারা আপ্রাণ একটি বাঙালি সত্তার রাজনীতি চেয়েছিলেন, মনে করেছিলেন, অখণ্ড বাংলাকে না ধরে রাখতে পারলে বাঙালির বিরাট ক্ষতি, তাঁঁদের কথা মনে পড়ে আজ বাংলাদেশকে দেখলে। দেশভাগের পর নতুন দেশে যেতে চাননি সুরাবর্দির মতো প্রধান নেতা— কলকাতা না পাওয়ার দুঃখে নয়, বাঙালিকে দ্বিখণ্ডিত হতে দেখার দুঃখে।
বাইরের সংগ্রাম মিটলেও অন্দরের সংগ্রামে, অন্তরের সংগ্রামে আজও ক্ষতবিক্ষত দেশটি। কিন্তু পঞ্চাশ-পূর্তিতে পৌঁছে মানতেই হবে, সে দেশে গৌরবময় লড়াই জারি রেখেছে বাঙালিত্ববাদ। বাঙালির কাছে বাংলাদেশের মর্ম এটাই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy