তখন পতিসরের নদী-চরে নেমে আসছে সন্ধ্যা। বোটে বসে রবীন্দ্রনাথ চিঠি লিখছেন ভাইঝি ইন্দিরাকে, যিনি কবিকে পিয়ানোয় বাজিয়ে শোনাতেন পাশ্চাত্য সঙ্গীতের বিভিন্ন সিম্ফনির অংশ, কনচের্টো, শোনাতেন মুনলাইট সোনাটা, ফিউরেলিস। আর রবীন্দ্রনাথের প্রাণ ভরে উঠত বিস্ময়ে। আজ এই ধু ধু বিশাল নির্জন জ্যোৎস্না-প্রান্তরে কবির কাছে যেন দেখা দিয়ে ফেলেছেন স্বয়ং বেঠোফেন।
তিনি লিখছেন, “...বড়োত্বর সঙ্গে সঙ্গে যে এক রকম শ্রীহীনত্ব আছে, তাতে অন্তরকে বিমুখ করে না, বরঞ্চ আকর্ষণ করে আনে। আমার ঘরে যে বেঠোফেনের ছবি আছে, অনেক সুন্দর মুখের সঙ্গে তুলনা করলে তাকে দর্শনযোগ্য মনে না হতে পারে, কিন্তু আমি যখন তার দিকে চাই সে আমাকে খুব টেনে নিয়ে যায়— ওই উশকোখুশকো মাথাটার ভিতরে কত বড়ো একটা শব্দহীন শব্দজগৎ! এবং কী একটা বেদনাময় অশান্ত ক্লিষ্টপ্রতিভা রুদ্ধ ঝড়ের মতো ওই লোকটার ভিতরে ঘূর্ণমান হত!”
শুধু রবীন্দ্রনাথকেই নয়, ২৫০ বছর ধরে কত কত মানুষকে রাঙিয়ে দিয়ে, রাগিয়ে দিয়ে, বেঠোফেনের সুর অমরত্বের অন্য পাড়ে দাঁড়িয়ে থাকে আজ। তাঁর বেহালার ছড়ে মানুষের এত কালের দুঃখ, বেদনার হৃদয় ঝমঝম করে বেজে ওঠে। আজও। সেই সব সুর ঠিকই মানুষের কান্নার ধ্বনি শুনে ফেলে।
ছোট্ট বেঠোফেন তার ভাইকে পাশে নিয়ে ঘুমোচ্ছে। তার মাতাল বাবা জোহান ফন বেঠোফেন তাঁর বন্ধুবান্ধবদের ঘরে ডেকে আনেন ছেলের পিয়ানো শোনাবেন বলে। ছেলেকে ডেকে তোলেন ঘুম থেকে। ঘুম-ভাঙা বেঠোফেন একটা প্রচণ্ড চোরা রাগে পিয়ানোর সামনের টুলটা টেনে বসে। তার বাবা আকণ্ঠ পান করতে থাকেন, আর বেঠোফেনের আঙুল চলতে থাকে পিয়ানোয়। কবে এই পিয়ানো দাবানল হয়ে উঠে পৃথিবীর সমস্ত ঠান্ডা হয়ে যাওয়া মানুষের বুকের মধ্যে পুরে দেবে স্ফুলিঙ্গ? মানুষ জাগবে, আলো ফুটবে, প্রাণ জাগবে...
আমার মনে হয়েছিল, সলিল চৌধুরীর নৌবিদ্রোহের সমর্থনে লেখা গান, ‘ঢেউ উঠছে কারা টুটছে’ যুদ্ধেরই ঘোষণা করেছিল। যে ঢেউ সলিল জাগিয়েছিলেন, সে ঢেউ যেন বেঠোফেনের যুদ্ধ পেরিয়ে মানুষের জেগে উঠবার গান ‘ফিফথ সিম্ফনি’-র মতোই মুঠো হাতের বিপ্লব। একেবারে ভেঙেচুরে সমস্তটাকে তোলপাড় করে অমৃত সেচে আনছেন এক অসামান্য গুণী... তাঁরই বিপ্লবের ব্যাটনটা যেন দেশ পার করে, কাঁটাতার আর ভাষার বাঁধন ছিঁড়ে ফেলে তুলে দিচ্ছেন আর এক বিপ্লবীর হাতে। তাঁর উত্তরসূরি, ভাবশিষ্য সলিল চৌধুরীকে।
অবশ্য শুধু সলিলেরই নয়, সমস্ত গণনাট্য সঙ্ঘেরই অত্যন্ত শ্রদ্ধেয় ছিলেন বেঠোফেন। তাঁর সুরের মধ্যেকার রাগ কণ্ঠে ভরে নিয়েছিলেন ঋত্বিক, সলিলরা। রাগ? না কি, সেই দাবানলই?
এক সময় সারি সারি মশাল হাতে সেই দাবানলের আঁচ এসে পড়ে সাধারণ মানুষের মনে। ফরাসি বিপ্লব শুরু হয়। আর যখন সেই বিপ্লবের নায়ক হয়ে উঠলেন নেপোলিয়ন, তাঁর হাত ধরে যখন ক্ষমতা চলে যাচ্ছে সাধারণ মানুষের হাতে, সেই সব ধুলোকণার মতো নগণ্য মানুষগুলো নিজেরাই হয়ে উঠতে চাইছে নিজেদের ভাগ্যবিধাতা— তখন বেঠোফেনের কাছে নেপোলিয়ন হয়ে উঠলেন নায়ক। ‘থার্ড সিম্ফনি’-র তারের ঝঙ্কার ঘোষণা করে দিল, “শত শত বছরের পাপ ভেঙে পড়ল এ বার।” তার পর ওবোতে, ক্ল্যারিয়োনেটে, টিম্পানিতে জেগে উঠল এক প্রচণ্ড আলো, বেঠোফেনের মনের দরজায় এসে দেখা দিলেন নেপোলিয়ন। বেঠোফেনের কাছে তখন ‘থার্ড সিম্ফনি’-তে নেপোলিয়নের নাম লেখা।
কিন্তু মোহ ভাঙতেও দেরি হয় না বেঠোফেনের। এক দিন শিষ্য রাইস তাঁর কাছে নিয়ে এলেন এক দুঃসংবাদ— নেপোলিয়ন নিজেকে ফ্রান্সের সম্রাট বলে ঘোষণা করেছেন। নায়ক আর সম্রাটের মধ্যেকার সূক্ষ্ম তফাতের ঘর্ষণে বেঠোফেনের মধ্যে ঝলসে উঠল আগুন। “বিশ্বাসঘাতক!” চিৎকার করে উঠে একটা কলমকে হাতের মুঠোয় চেপে ধরে এ ফোঁড়-ও ফোঁড় করে দিলেন তাঁর সাধের ‘থার্ড সিম্ফনি’-র নামটা। রইল পড়ে শুধু ‘এরোয়কা’। ‘হিরোইক’। ভবিষ্যতের এমন কোনও বীরের প্রতি উৎসর্গ করা হল সেই সুরকে, যিনি মানুষের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করবেন না।
সেই রাগই যেন পরে রবীন্দ্রনাথের রক্তে চলকে উঠবে, চলকে উঠবে সলিল চৌধুরীর কলমে, ব্রেশটের নাটকের মধ্যে চকমকি জ্বেলে নিয়ে শ্রমিকের ঘামে মিশে, সমস্ত অসহায় মানুষের হৃৎপিণ্ডের কাঁপনে ভেঙে ফেলবে বার্লিনের দেওয়াল। সব পাঁচিলে, কারখানায়, সমস্ত বিক্ষোভে। সেই রাগ ছড়িয়ে যাবে ভাবীকালের স্রষ্টাদের মধ্যে।
২৫০ বছর পার। বেঠোফেন ভেসে চলেছেন কালের সমুদ্র চিরে।
পঁচিশ বছর বয়সে বাঁ কানে শ্রবণশক্তি কমে আসছিল, ক্রমে তা হয়ে উঠল একটা নিরেট দেওয়ালের মতো। নোটসগুলোর সামনে যেন মাঝেমাঝেই গিয়ে দাঁড়ান সুরকার। সুরগুলো প্রকাণ্ড সব ডানা-মেলা পাখির মতো তাঁকে ঘিরে উড়তে থাকে। সমস্ত নোটেশনের পৃষ্ঠাও প্রতিবাদ করে ওঠে যেন— তাদের স্রষ্টার প্রতি তাদের দায়বদ্ধতা আছে। একটা বিশাল চোঙের মতো বস্তু, যা কিনা সেই সময় ব্যবহার হত ‘হিয়ারিং এড’ হিসাবে, কানের মধ্যে চেপে ধরেন তিনি। এই সুরের এলোমেলো ঝড় তাঁকে থামাতেই হবে। সংহতি! সংহত না হলে কী ভাবে তাল আসবে? জীবন কথা বলবে কী করে? হৃদয়ের গভীর থেকে— যেন আদি-সুরের মতোই— গর্জন করে ওঠে চারটে নোটস। টা রা রা ডাম! টা রা রা ডাম! টা রা রা ডাম! তৈরি হল সর্বকালের বিপ্লব, আর বিক্ষোভের সুর— ‘ফিফ্থ সিম্ফনি’!
ডাক্তার নিদান দিলেন, “এই শহরের ডামাডোল ছেড়ে কয়েক দিন ভিয়েনা উড্স-এ কাটিয়ে আসুন না, ভাল লাগবে।” শহরের শব্দহীনতা পেরিয়ে অতএব বেঠোফেন পৌঁছলেন গ্রামে। যেখানে বিশ্ব মায়ের আঁচল পাতা। আর কী আশ্চর্য! ওই যে কৃষক খেতে কাজ করছে, ছেলেরা ছোটাছুটি করছে, পাখি ডাকছে, ঝর্নার কলকল, ঝড়ের দাম্ভিক শনশন— এই সব ধ্বনি শুনতে তো শ্রবণ লাগছে না? কিন্তু সুরের ঘাটতি নেই কোথাও। যেন রবীন্দ্রনাথের সেই ফাল্গুনী নাটকের অন্ধ বাউলের মতো, শুধু চোখ দিয়ে দেখা নয়, সবটুকু দিয়ে দেখা। তেমনই কান দিয়ে শোনা নয়, রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রতিটা শিরা উপশিরার মধ্যে দিয়ে শোনা। বেঠোফেন আবার বশ করে ফেললেন সুরকে। মুঠোয় চেপে ধরলেন তাদের লাগাম।
জন্মাল ‘সিক্সথ সিম্ফনি’। বেঠোফেন নাম দিলেন ‘প্যাস্টোরাল’।
তার দেড় শতক পরে জার্মানির শাসক হয়ে উঠলেন হিটলার। সাধারণ মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে তাঁকে বেছে নিতে হল তাঁদেরই এক জন আইডলকে। আর জার্মানির আইডল বলতে সেই যুগে বেঠোফেন ছাড়া আর কাকে মনে পড়ে? হিটলার যেন হয়ে উঠলেন বেজায় সুররসিক, বেঠোফেন ভক্ত। বলেও বেড়াতে লাগলেন, তাঁর জন্মই বেঠোফেনের আত্মা থেকে! বেঠোফেনের ‘নাইন্থ সিম্ফনি’-কে করে নিলেন জার্মানির জাতীয় সঙ্গীত! সমস্ত রাজনৈতিক জমায়েতে, বক্তৃতা শুরু হওয়ার আগে বাজতে লাগল ‘নাইন্থ সিম্ফনি’! কিন্তু যে বেঠোফেন নেপোলিয়নের বিরুদ্ধে ফেটে পড়েছিলেন বিদ্রোহে, সেই বেঠোফেন কিনা হিটলারের সঙ্গে মিশ খাবেন? হাজার হাজার ইহুদিকে যখন গ্যাস চেম্বারে পুরে মেরে ফেলা হচ্ছে, মা-বাবার হাত থেকে ছাড়িয়ে নেওয়া হচ্ছে সন্তানকে, রবিবারের ফুর্তি হিসাবে বেছে নেওয়া হচ্ছে জনসমক্ষে ফাঁসি, তখন সমস্ত জার্মানির বুকের হাহাকারের মধ্যেও বাঁচার রসদ হয়ে সৌভ্রাতৃত্বের সুর— শেষ সম্বল হয়ে থাকল ‘নাইন্থ সিম্ফনি’। সেই সুর, যাকে হাওয়া নেবাতে পারে না; আগুন পোড়াতে পারে না; জল ভাসাতে পারে না।
সত্যজিৎ রায়ের কাছে বেঠোফেন আবার এক জন পাশ্চাত্য সঙ্গীতকার। দার্শনিক। জন অরণ্য-তে যখন স্থূল নটবর মিত্তির আর মধ্যবিত্ত সোমনাথ একটা সিগারেট কেসের ডালা খোলে, আর তার মধ্যে থেকে বেজে ওঠে ‘ফিউরেলিস’, তখন সেই সুর তৈরি করে ফেলে একটা লুকোনো রহস্য। আবার শাখা প্রশাখা-তে প্রশান্ত ওরফে সৌমিত্র-র লোয়ার স্কেল কণ্ঠের সঙ্গে তাল মিলিয়ে তাঁর নিজের ব্যারিটোনের থেকে নেমে এসে সত্যজিৎ গুনগুনিয়ে ওঠেন বেঠোফেনেরই একটি কনচের্টোর অংশ।
বেঠোফেনের ভেলা ভাসতে ভাসতে কত দূর যাবে আরও? যত দিন এই গ্রহ আছে, দেশে দেশে কাঁটাতার আছে, প্রেম আছে, আর আছে বিদ্রোহ— তত দিন আফগানিস্তানের পথঘাট গ্রেনেডের মুখে ছুড়ে দেবে বেঠোফেনের সুর, সীমান্তবর্তী পাহাড়ে ‘গুমনাম’ লাশের দেহ জুড়ে বেজে উঠবে ‘নাইন্থ সিম্ফনি’। প্রেমের শিসে নরম আঙুল খুঁজে নেবে ‘ফিউরেলিস’-এর পিয়ানো। সেই ফিউরেলিস, যাকে বেঠোফেনের মৃত্যুর প্রায় চল্লিশ বছর পর আবিষ্কার করবেন এক বেঠোফেন-ভক্ত লুডউইগ নোহল। সেই সুরই হেভি মেটালে তুলে নেবেন এই প্রজন্মের কত কত মানুষ, তরুণ-তরুণী। একটা পরিপূর্ণ জীবন অনন্তের দিকে যাত্রা শুরু করে। বেঠোফেনের আড়াইশো নয়, প্রান্তিক মানুষগুলোর আড়াইশো।
কিন্তু আমার শহর? যদিও সে নিরুত্তাপ এখনও, তবু এখনও কত কত কচিকাঁচা আর তরুণ-তরুণী হাতে তুলে নিচ্ছেন বেঠোফেনের বেহালা আর পিয়ানো। আশা করতে দোষ কী? ওই সুরের মস্ত ডানা মেলা পাখিগুলো ঠোঁটে করে সুরেরই খড়কুটো এনে হয়তো জমিয়ে রাখছে কারও কারও মনে। সেখানে এক বসন্তে তাদের থেকেই জন্মাবে আরও আরও পাখি। যারা সমস্ত ফ্যাসিস্টদের নেমেসিস হয়ে সজাগ দৃষ্টি রাখবে দিগন্তে। মানুষের কানে ঢেলে দেবে হৃদয়ের মন্ত্র। বেঁচে থাকা মানে শুধু নিজেরটুকু নিয়ে বেঁচে থাকা নয়— খেতে-খেতে যত কৃষকের ঘাম, খনিতে যত মৃত্যু আর মানুষের যত আশা, সবাইকে নিয়ে এক সঙ্গে বেঁচে থাকার এক অপূর্ব সিম্ফনি।
আশা করতে দোষ কী? হ্যাঁ, আমি এখনও সাম্যবাদের ম্যানিফেস্টোতে বিশ্বাসী!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy