ঘরবন্দি দশায় কাটতে চলল আর একটা বছর। ২০২০-তে অবশ্য বন্দিদশায় যত কড়াকড়ি ছিল, এ বছর তা ছিল কম। কিন্তু পরিস্থিতি যে স্বাভাবিক হয়ে গিয়েছে, বলা যাবে না। তবে ইন্টারনেট-নির্ভরতা কিন্তু মানুষ বাইরে বেরোনো শুরু করলেও কমেনি, বরং বেড়েছে। সেই সঙ্গে বেড়েছে সাইবার দুনিয়ার প্রভাবে জনজীবনের প্রভাবিত হওয়ার পরিমাণ।
সাইবার পরিসরে মানুষ যত বেশি সময় কাটিয়েছেন, ততই অপরাধীরাও তাঁদের নিশানা করার জন্য সাইবার দুনিয়াকে বেছে নিয়েছে। এটা গত বছর থেকেই শুরু হয়েছিল। এ বছর অপরাধীরা আরও নানা নতুন নতুন কৌশলকে হাতিয়ার করেছে। ভুয়ো ফোনের মাধ্যমে ব্যাঙ্ক জালিয়াতির মতো চেনা অপরাধ তো ছিলই, সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ‘সেক্সটরসন’, অর্থাৎ যৌন কেলেঙ্কারিতে বিদ্ধ করার ভয় দেখিয়ে, পর্নোগ্রাফি কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে দেওয়ার ভয় দেখিয়ে টাকা হাতানোর মতো অভিযোগ। এই ধরনের অপরাধের বড় অংশই সংঘটিত হচ্ছে ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম-সহ বিভিন্ন সমাজমাধ্যমে। ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস বুরোর (এনসিআরবি) তথ্যই বলছে, দেশে সাইবার অপরাধ বেড়েছে ১২ শতাংশ। ইন্ডিয়ান কম্পিউটার এনার্জি রেসপন্স টিম নামক একটি সংস্থার সমীক্ষায় দাবি, ভারতে এই ধরনের অপরাধে অভিযুক্তদের ৫৬ শতাংশেরই বয়স মাত্র ১৬ থেকে ২৫ বছর। আক্রান্তদের বড় অংশও কমবয়সি। সাইবার পরিসরে তরুণ প্রজন্ম যে কতটা নিরাপত্তাহীন, পরিসংখ্যানেই তা স্পষ্ট।
কেবল তরুণরাই নন, সাইবার পরিসরে আর একটি বিষয়ে বিপদের সম্মুখীন ব্যবহারকারীরা— তথ্যের সুরক্ষা। গত ১৩ ডিসেম্বর নেদারল্যান্ডসের ভিপিএন সংস্থা সার্ফশার্ক একটি রিপোর্ট প্রকাশ করেছে, যাতে দেখা যাচ্ছে— ২০২০-র তুলনায় ২০২১-এ ভারতে তথ্য চুরির ঘটনা চার গুণেরও বেশি বেড়েছে। এ বছর দেশে প্রায় ৮ কোটি ৬৭ লক্ষ বাসিন্দার তথ্য বেহাত হয়েছে, যার মধ্যে এয়ার ইন্ডিয়া ও ডমিনোজ় পিৎজার মতো সংস্থার তথ্যভান্ডারে হানার ঘটনা রয়েছে।
সাইবার-যুগে তথ্য চুরির অভিযোগ অবশ্য উঠেছে বিশ্ব জুড়েই। ওই রিপোর্টেই প্রকাশ, এ বছর ওই তালিকায় শীর্ষে রয়েছে আমেরিকা। সেখানে ব্যক্তিগত তথ্য চুরি হয়েছে ২১ কোটিরও বেশি নাগরিকের। তবে আমেরিকায় তথ্য আক্রান্তের ঘটনা থাকলেও তা নিয়ে সচেতনতা, রাষ্ট্রের কার্যকর পদক্ষেপও দেখা যায়। এ বছর একাধিক বার আমেরিকার সেনেটে প্রশ্নের মুখে পড়তে হয়েছে ফেসবুককে। অভিযোগ, ইনস্টাগ্রামে শিশু-কিশোরদের মানসিক স্বাস্থ্যহানির কথা জেনেও তারা কোনও পদক্ষেপ করেনি। তার জেরে ছোটদের জন্য ইনস্টাগ্রামের নতুন সংস্করণ আনার কথা থাকলেও তারা তা পিছিয়ে দেয়।
ভারতে অবশ্য সমাজমাধ্যমকে নেতিবাচক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা রুখতে রাষ্ট্রের তরফে তেমন কড়াকড়ি চোখে পড়েনি। বরং রাজনীতির জন্য যে তাকে অস্ত্র করা হয়েছে, তার প্রমাণ দিয়েছেন হুইসলব্লোয়ার, ফেসবুকের প্রাক্তন প্রোডাক্ট ম্যানেজার ফ্রান্সেস হগেন। সংস্থার অভ্যন্তরীণ নথি পেশ করে তিনি অভিযোগ করেন, ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচন এবং বাংলায় ২০২১-এর নির্বাচনের আগে হিংসায় উস্কানি দিতে পারে এমন অসংখ্য ভুয়ো তথ্য ছড়ানো হয়েছিল ফেসবুকে।
তবে এই সাইবার পরিসর কিন্তু আমজনতার কাছে অনেক সময় রাষ্ট্রের দ্বিচারিতাও উন্মোচন করে দিয়েছে। যেমন, কেন্দ্রীয় সরকার করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ে অক্সিজেনে মৃত্যুর তথ্য ‘জানা নেই’ বলে অস্বীকারের চেষ্টা করলেও গুগলের বছরভরের সার্চ-সমীক্ষা স্পষ্ট করে দিয়েছে বাড়িতে অক্সিজেন তৈরির পদ্ধতির খোঁজ করেছেন অসংখ্য মানুষ। বছরভরের ‘হাউ টু’-র তালিকায় তা পাঁচ নম্বরে। তাকে ছাড়িয়ে গিয়ে তিন নম্বরে রয়েছে শরীরে অক্সিজেনের মাত্রা বৃদ্ধির উপায়। কাছাকাছি অক্সিজেন সিলিন্ডারের খোঁজ রয়েছে ‘নিয়ার মি’-র তালিকায় চার নম্বরে।
একটা সময় প্রশাসনের সাহায্য না পেলেও বাসিন্দাদের একে অন্যের সঙ্গে জুড়ে থাকতে, অচেনাকে আপন করে নিতে সেতু হয়েছিল সমাজমাধ্যমই। বহু খারাপের মধ্যেও সাইবার দুনিয়ার এই দিকটিও অবশ্য স্বীকার্য। সেই সব টুইট, ফেসবুক পোস্ট রয়েছে এখনও। এক জন অন্যকে খাবার জুগিয়েছেন, হাসপাতালে শয্যা জোগাড়ের চেষ্টা করেছেন, ডেটিং অ্যাপে বন্ধুর জন্য প্লাজ়মা চেয়ে ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া পেয়েছেন এক তরুণী।
যদিও এখনও এ দেশে ইন্টারনেট মুষ্টিমেয়কেই সুবিধে দিতে পারে। তা দেখা গিয়েছে অনলাইন ক্লাস চালুর সময়। আজিম প্রেমজি ফাউন্ডেশনের সমীক্ষা বলছে, দেশে ৬০ শতাংশ পড়ুয়াই অনলাইন শিক্ষার পরিধির বাইরে। তাই ক্লাসঘরে টানা শিক্ষা বন্ধ থাকায় বেড়েছে স্কুলছুট, নাবালিকা বিবাহ, যোগ-বিয়োগ অবধি ভুলে গিয়েছে প্রাথমিকের বহু পড়ুয়া। অন্য দিকে, বিদেশি পুঁজি পেয়ে ফুলেফেঁপে উঠেছে অনলাইনে শিক্ষার ব্যবসা করা অজস্র অ্যাপ।
এই বৈপরীত্যের অবসান হোক সাইবার পরিসরে, নতুন বছরে আশা এইটুকুই। যে বৈপরীত্য দেখায়, একটি টুইটের জন্য গ্রেফতার হতে হয় পরিবেশ আন্দোলনকর্মী দিশা রবিকে, অথচ হ্যাক হয়ে যায় খোদ প্রধানমন্ত্রীর টুইটার হ্যান্ডল! সাইবার পরিসরে সবার আনাগোনা, নির্ভরতা আরও বাড়বে। তাই রাষ্ট্র, প্রশাসনের উচিত এই সাইবার-পরিবেশকে দূষণমুক্ত করা। সেই দাবি উঠুক নাগরিক সমাজেও।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy