ইতিহাসবিদ ও পরম শ্রদ্ধেয় শিক্ষক অমলেশ ত্রিপাঠীর শতবর্ষ চলে গেল, আমাদের অধিকাংশেরই অগোচরে। অথচ আমাদের প্রজন্মের ইতিহাসচর্চায় এবং উচ্চশিক্ষার যাত্রায় অধ্যাপক ত্রিপাঠীর যে অবদান রয়েছে তা কোনও ভাবেই সামান্য নয়। আমি ওঁর ক্লাসে পড়েছি ১৯৬০ থেকে ১৯৬৪ পর্যন্ত। প্রথম দুই বছর পড়েছি প্রেসিডেন্সি কলেজের ইতিহাস অনার্স ক্লাসে, আর পরের দুই বছর, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের এম এ ক্লাসে। সেই সময় অধ্যাপক ত্রিপাঠী প্রেসিডেন্সির ইতিহাস বিভাগের প্রধান অধ্যাপক পদে নিযুক্ত ছিলেন। ওঁকে স্মরণ করলে প্রথমেই মনে পড়ে ওঁর অনায়াস পাণ্ডিত্য, সেই সঙ্গে ওঁর গম্ভীর ব্যক্তিত্ব— গুরুগম্ভীর বললেও ভুল হবে না। আমরা ছাত্রছাত্রীরা ওঁকে বিশেষ সমীহ করে চলতাম, হয়তো সামান্য ভয়ও পেতাম। তবে মাস্টারমশাইকে সত্যিকারের রাগ করতে দেখেছি বলে মনে পড়ে না। বরং ওঁর মৃদু হাসিটা মনে পড়ে। উনি অবশ্য ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে গল্প করতেন না। আলোচনাতেও বসতেন না। কখনও কখনও ডেকে নিয়ে বলে দিতেন আমাদের কী করতে হবে, কী বই পড়তে হবে। সর্বদাই কোনও বিষয়ের উপর একাধিক বই পড়তে আদেশ করতেন।
অমলেশবাবু সেই সময়ে ‘ইউরোপিয়ান রেনেসাঁস অ্যান্ড রিফর্মেশন’ কোর্সটি পড়াতেন। ক্লাসেই অনেক বই নিয়ে আসতেন। উনি বোধ হয় চাইতেন বইগুলি আমরা ছাত্রছাত্রীরা চাক্ষুষ দেখি, দেখে খুশি হই, পড়তে উৎসাহ পাই। সেই মানসিকতায় অবশ্য ইউরোপীয় রেনেসাঁস বিষয়টি ওই ভাবে পড়াবার পক্ষে উপযোগী ছিল। যে সব বই মাস্টারমশাই দেখাতে আনতেন সেগুলি বেশির ভাগই ছবির বই, অর্থাৎ রেনেসাঁস আর্ট-এর বই। চোখ জুড়ানো সব প্রকাশনা, যে স্তরের বইকে আমরা আর্ট বুকস বলে থাকি। কলেজের তিন নম্বর ঘরে, যে ঘরটিকে হিস্ট্রি সেমিনার বলা হত, সেই ঘরের টিচার্স প্ল্যাটফর্ম-এর উপরে যে টেবিলটি রাখা থাকত, তার উপরে অধ্যাপক ত্রিপাঠী বইগুলি খুলে রাখতেন। আমরা তিন-চার জন করে বেঞ্চ থেকে উঠে গিয়ে বইয়ের পাতা উল্টে উল্টে দেখে আসতাম। মাস্টারমশাই আমাদের বলেন ওই আর্টের মধ্যে রয়েছে ইউরোপীয় রেনেসাঁস যুগের দর্শন, সাহিত্য, সঙ্গীত, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির পরিচয়। তার ফলে কম বয়সেই আমরা ইউরোপের সভ্যতা ও সংস্কৃতির সম্বন্ধে কিছু ধারণা করতে পেরেছিলাম। তখন আমাদের যা বয়স ছিল, ১৮ থেকে ২০ বছর— কতটুকুই বা বুঝতে পারতাম মাস্টারমশায়ের পাণ্ডিত্যের মান! তবে উনি যে ভাবে পড়াতেন, তার থেকে মনে হত যে, বইয়ের জগতে ওঁর অগাধ প্রবেশ। আজ আরও বুঝি কত উপকার করেছিলেন ছাত্রছাত্রীদের। বই তো শুধু জ্ঞান অর্জনের জন্য নয়, বই তো জীবনের সঙ্গী। তাই বোধ হয় অধ্যাপক ত্রিপাঠী তাক-তাক বই সঙ্গে করে নিয়ে আসতেন।
তখন জানতাম না, পরে জেনেছিলাম, ওঁর মূল বা প্রধান গবেষণার বিষয় ইউরোপীয় ইতিহাস নয়। ওঁর সুখ্যাত প্রথম গবেষণা গ্রন্থের শিরোনাম ট্রেড অ্যান্ড ফাইনান্স ইন দ্য বেঙ্গল প্রেসিডেন্সি, ১৭৯৩-১৮৩৩। ১৯৫৬ সালে গ্রন্থটি প্রকাশিত হয় অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস থেকে। স্বদেশে ও বিদেশে অধ্যাপক ত্রিপাঠীর প্রথম প্রতিষ্ঠা হয় অর্থনৈতিক ইতিহাসে। এক জন বিশিষ্ট অর্থনৈতিক ইতিহাসবিদ বা ইকনমিক হিস্টোরিয়ান বলে উনি পরিচিত হন। সেই সময় অর্থনৈতিক ইতিহাসের ধারাটা আমাদের দেশে অভিনব। ওঁর লেখা থেকেই জানতে পারি ওই বিষয়ে ওঁর সবচেয়ে বড় অনুপ্রেরণা এসেছিল দু’টি অতি গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ থেকে— ১৯৪৮-এ প্রকাশিত আমেরিকার ইতিহাসবিদ হল্ডেন ফারবার-এর লেখা জন কোম্পানি অ্যাট ওয়ার্ক এবং ১৯৪০-এ প্রকাশিত ইংরেজ ইতিহাসবিদ সি এইচ ফিলিপস-এর দি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ১৭৮৪-১৮৩৪ শীর্ষক গ্রন্থে। ভারতের ইতিহাসবিদ্যায় অধ্যাপক ত্রিপাঠীর ট্রেড অ্যান্ড ফাইনান্স গ্রন্থের সমসাময়িক গ্রন্থ, ১৯৫৬-তেই প্রকাশিত, রমেশচন্দ্র দত্তের ইকনমিক হিস্ট্রি অব ইন্ডিয়া আন্ডার ব্রিটিশ রুল। এই পথিকৃৎ কাজ দিয়েই ভারতবর্ষে অর্থনৈতিক ইতিহাসচর্চার শুভ সূচনা হয়। বিষয়টা বিশ্ববিদ্যালয়েও পড়ানো শুরু হয়। পরবর্তী কালে অধ্যাপক ত্রিপাঠীর ইতিহাস গবেষণা অন্য একটা বিষয়ে প্রসারিত হয়ে বহু জনের কাছে পৌঁছয়। সেই ব্যাপ্তির নিদর্শন রয়েছে তাঁর রচিত ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম বিষয়ে একাধিক গ্রন্থে। ওই তালিকা থেকে ইংরেজি ও বাংলায় প্রকাশিত দু’-চারটির উল্লেখ করছি: দি এক্সট্রিমিস্ট চ্যালেঞ্জ: ইন্ডিয়া বিটুইন ১৮৯০ অ্যান্ড ১৯১০, বিদ্যাসাগর: দ্য ট্র্যাডিশনাল মডার্নাইজ়ার, বাংলায় আনন্দ পাবলিশার্স থেকে প্রকাশিত ভারতীয় মুক্তিসংগ্রামে চরমপন্থী পর্ব, স্বাধীনতা সংগ্রামে ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস ও মূল্যায়ন।
অধ্যাপক ত্রিপাঠীর চর্চায় যেটা লক্ষণীয় উনি কী ভাবে, গবেষণা গ্রন্থের বাইরে, ‘বিষয় ইতিহাস’ সম্বন্ধে নিজেকে আজীবন ব্যাপৃত রেখেছিলেন। আলোচনার মাধ্যমে বিষয়টা যেন উনি জনশিক্ষার স্তরে পৌঁছে দিয়েছিলেন। জিজ্ঞাসুদের খুব উপকার হয়েছিল। পৃথিবীজোড়া ইতিহাসবিদ ও সমাজবিজ্ঞানীদের প্রতিষ্ঠিত এবং বিতর্কিত তত্ত্ব উনি সহজ সরল পাণ্ডিত্যে বিশ্লেষণ করেছিলেন। তাঁর লেখা থেকে আমরা জানতে ও বুঝতে পারি ফ্রান্সের আনাল স্কুল, ইংল্যান্ডের কেমব্রিজ স্কুল, এবং ভারতে উদ্ভাবিত সাবঅলটার্ন স্টাডিজ়-এর চিন্তাধারা। বুঝতে পারি আমাদের মাস্টারমশাইয়ের কেমন অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাসবিদ্যায় স্বচ্ছন্দ বিচরণ ছিল। সেই সঙ্গে জানতে পারি তাঁর নিজস্ব মতামত। এই শতকের ইতিহাসচর্চার ধারাগুলি উনি আগ্রহে বুঝতে চাইতেন। পাঠকের তাতে অনেক সাহায্য হত।
বিভিন্ন রচনায়, কখনও বইয়ের ভূমিকাতে, কখনও বড় বড় সাক্ষাৎকারে— তিনি কিছু প্রশ্ন উত্থাপন করেছেন। যেমন, ইতিহাস কি শুধুই রাজা ও রাজত্বের উত্থান-পতনের সঙ্গেই জড়িত থাকবে? উত্তরে নিজেই বলেছেন, অবশ্যই নয়। আরও প্রশ্ন তুলেছেন, ইতিহাসবিদের কাজ কি বিচার করা না বোঝার চেষ্টা করা? জোর দিয়ে লিখেছেন, বিচার নয়। বুঝতে হবে। বুঝতে পারলে ক্ষমা করা সহজ হয়। একই সঙ্গে প্রশ্ন করেছেন,
সব অপরাধ কি ক্ষমণীয়? যেমন হিটলারের গ্যাস চেম্বার? উত্তরে মাস্টারমশাই ইতিহাসবিদ লুসিয়েঁ ফেব্রে-কে স্মরণ করেছেন এই মর্মে যে, ফেব্রে বিশাল পরিশ্রম করে রাবলের সাহিত্য থেকে ষোড়শ শতাব্দীর অবিশ্বাসের অভ্যুদয় বোঝাতে চেষ্টা করেছেন। ইতিহাসবিদ্যার জগতে এই ধরনের কাজকে অধ্যাপক ত্রিপাঠী মহামূল্যবান বলে মনে করতেন। নিজেও সাহিত্যচর্চা করতেন। ওঁর উপস্থাপনায় আরও একটি মননশীল প্রশ্ন থাকত। ইতিহাস কি মানববিদ্যা? ইতিহাস কি সমাজবিজ্ঞান? অধ্যাপক ত্রিপাঠীর বিশ্লেষণে পাই, “যুগের মুকুরে খণ্ড সত্যের প্রতিবিম্বে বেশী ধরা পড়বে না। ঐতিহাসিকের মনোভূমি একেবারে উপেক্ষণীয় নয়, হিস্টরিক্যাল ফ্যাক্টস আর, ইন এসেন্স, ফিলজ়ফিক্যাল ফ্যাক্টস। অসংখ্য তথ্যের মধ্যে থেকে কিছু তথ্য ঐতিহাসিক অর্থবহ বলে নির্বাচন করেন। তাঁর নির্বাচনের পিছনে কি সর্বজনগ্রাহ্য সর্বকালের সত্য কোনো নিয়ম আছে? না।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy