Advertisement
২১ ডিসেম্বর ২০২৪
ফাঁসির দাবিতে প্রায় সবাই একমত, কিন্তু তা ন্যায্য কি
Kolkata Doctor Rape and Murder

‘ঘৃণার আগুন, জ্বলুক...’

কোনও কৃতকর্মের জন্যে শাস্তি পেতে হবে কেন, তার একাধিক কারণ দার্শনিকরা আলোচনা করেছেন।

শাস্তি: আর জি কর-কাণ্ডে অপরাধীর বিচার চেয়ে জুনিয়র ডাক্তার, শিক্ষানবিশ ডাক্তার ও মেডিক্যাল ছাত্রদের প্রতিবাদ। ১২ অগস্ট, কলকাতা। পিটিআই

শাস্তি: আর জি কর-কাণ্ডে অপরাধীর বিচার চেয়ে জুনিয়র ডাক্তার, শিক্ষানবিশ ডাক্তার ও মেডিক্যাল ছাত্রদের প্রতিবাদ। ১২ অগস্ট, কলকাতা। পিটিআই

অচিন চক্রবর্তী
শেষ আপডেট: ০৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ০৯:৫৫
Share: Save:

দোষীর ফাঁসি চাই’। এই একটি দাবিতে অন্তত মুখ্যমন্ত্রী থেকে শুরু করে যাঁরা তাঁর পদত্যাগ চান, সবাই একমত। কেউ আবার একটু বৈচিত্র আনতে বলেছেন ‘এনকাউন্টার কিলিং’ চাই; কিংবা অপরাধীর পুরুষাঙ্গ ছেদন ইত্যাদি আরও ভয়ানক ও চাঞ্চল্যকর কিছু। অর্থাৎ, চতুর্দিকে “মারো মারো’ ওঠে হাঁকি’। যেখানে অপরাধী চিহ্নিত হওয়ার পথে তদন্ত ক’পা এগিয়েছে তা-ই বোঝা যাচ্ছে না, সেখানে দোষীর ফাঁসি চাই বলে এমনধারা চিৎকৃত দাবির মধ্যে এক রকম প্রতিশোধস্পৃহা অন্য সব যুক্তিকে ছাপিয়ে যায়। এই দাবিকে আমরা স্বাভাবিক এবং ন্যায্য বলেই মনে করি, কারণ অধুনা তা প্রায় সর্বজনীন। অতীতে রক্তক্ষয়ী বিপ্লবে মানুষকে উজ্জীবিত করতে পথেঘাটে কারখানার গেটেও শুনেছি ‘চিরশত্রুর পরে ঘৃণার আগুন, জ্বলুক জ্বলুক দাবানল’। এ ভাবেই প্রতিশোধস্পৃহাকে আমাদের সভ্যতা ও সংস্কৃতির অঙ্গ হিসাবেই ধরে নিয়েছি, তা সে শ্রেণিশত্রু নিধনই হোক কিংবা জঘন্য অপরাধীর ফাঁসি। শুধু তা-ই নয়, এই প্রতিশোধস্পৃহার সঙ্গে ‘আমি ন্যায়পরায়ণ’ এই শ্লাঘাবোধকে মিলিয়ে ফাঁসি চাওয়া জনতার পরিতৃপ্তির দিকটিও উড়িয়ে দেওয়া যায় না। তাই আধুনিক সভ্যতায় চরম প্রতিশোধমূলক দণ্ডের ধারণা নিয়ে যে বিস্তর সমালোচনা আছে, সে দিকে নজর দেওয়ার ইচ্ছা বা অবকাশ হয় না। এ সব ভেবে কালক্ষেপ করে ফুটন্ত রক্তকে ঠান্ডা হতে দেওয়া যায় না কি! কিন্তু সমাজব্যাপী এমন উত্তেজনা ও আবেগের সময়েই বোধ হয় ফাঁসির পক্ষে-বিপক্ষে যুক্তিগুলি আর এক বার গভীরে গিয়ে ভাবনার কারণ ঘটে।

কোনও কৃতকর্মের জন্যে শাস্তি পেতে হবে কেন, তার একাধিক কারণ দার্শনিকরা আলোচনা করেছেন। এক, ‘যেমন কর্ম তেমন ফল’-এর যুক্তি, যাকে বলে রেট্রিবিউশন। এক দল আছেন যাঁরা মনে করেন, চূড়ান্ত ঘৃণ্য অপকর্মটি যে করেছে, তার যেন তেমনই বা ততোধিক যন্ত্রণাদায়ক পরিণতি হয়। এই প্রতিহিংসা এবং প্রতিশোধ থেকে উৎসারিত তীব্র প্রত্যাঘাতের মানসিকতা যে সমাজমননে ক্রিয়াশীল সে বিষয়ে সন্দেহ নেই, কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে তার নৈতিকতা নিয়ে। এই বদলার দর্শন নৈতিকতার বিচারে কতটা গ্রহণযোগ্য?

এ কথায় অনেকেই বিরক্ত হবেন জানি, কারণ এমন প্রশ্ন তাঁদের অভ্যস্ত চিন্তায় প্রবেশাধিকার পায় না। ‘তার নিজের মুদ্রায় তাকে ফেরত দিলাম’, কিংবা জঘন্য অপরাধী ‘উচিত শিক্ষা’ পেল— এমন ভাবনা অনৈতিক হতে যাবে কেন? মহাভারত জুড়ে কি আমরা এমনতরো নৈতিকতার যুক্তিই পাই না? নারীর চূড়ান্ত অপমান সেখানে পরিসমাপ্তি পায়নি চূড়ান্ত রক্তক্ষয়ী প্রতিশোধে? জনপ্রিয় সিনেমার গল্পেও তো এমনটা আকছার দেখা যায়। অনেকের ধারণা, এই প্রতিশোধ নেওয়াকে মহিমান্বিত করেছেন মহাভারতকার। অতএব তা ন্যায্য। কিন্তু পণ্ডিতরা বলছেন, তা নয়। দার্শনিক অরিন্দম চক্রবর্তী বলছেন (ভাতকাপড়ের ভাবনা ও কয়েকটি আটপৌরে দার্শনিক প্রয়াস, অনুষ্টুপ, ২০১৩) প্রতিহিংসা একটি স্বাভাবিক প্রবৃত্তি হলেও একে হীন প্রবৃত্তি বলেই মনে করেছে মহাভারত। তার জন্যে শান্তি পর্বের ‘হংসগীতা’ অধ্যায়টি পড়তে বলছেন তিনি। সেখানে বলা হচ্ছে, মানুষই একমাত্র জীব, যে ঘৃণা বা প্রতিহিংসার বেগকে উল্টো দিকে বইয়ে দিতে পারে, আর সে জন্যই মানুষ শ্রেষ্ঠ। মহাভারতে আছে বলেই তাকে ধ্রুব বলে মানতে হবে এমন বাধ্যবাধকতা অবশ্যই নেই, কিন্তু যুক্তিগুলি একটু তলিয়ে ভাবা যেতে পারে।

আসলে ঘৃণ্য অপরাধীকে আমরা বিজেতা হিসাবে দেখি। সে জিতে যাচ্ছে এই বোধটি আমাদের তীব্র ঈর্ষা জাগায়। ফলে তাকে ফাঁসি দিয়ে শেষ করে দিতে না পারলে আমার জয় সম্পূর্ণ হয় না। কিন্তু মুশকিল হল, খুনি এবং নৃশংস অত্যাচারীকে তার নিজের মুদ্রায় ফেরত দিতে গেলে আমাকেও নৃশংসতায় তাকে ছাপিয়ে যেতে হয়। ইউরোপীয় রাষ্ট্রগুলি আমার সেই মনোভাবটি জেনেই অতীতে এই নৃশংসতার অনুষ্ঠান ঢাক পিটিয়ে জনসমক্ষে সাড়ম্বরে করত। ফাঁসিতে ঝোলানো দেখতে ভিড় ভেঙে পড়ত। তারা সেখান থেকে অনেক সরে এসেছে। বিশ্বের শতাধিক দেশ থেকে মৃত্যুদণ্ড ব্যাপারটাই উঠে গেছে। মনে রাখতে হবে যে, এই ‘উচিত শিক্ষা’মূলক শাস্তি যদি ফাঁসি হয়, তা হলে অপরাধী তো শিক্ষালাভের জন্যে আর বেঁচেই থাকল না। এমন ‘শিক্ষা’কে নিশ্চয়ই শিক্ষা বলা যায় না, যেখানে শিক্ষাপ্রাপ্তই মৃত!

তা হলে শাস্তিটি অন্যকে শিক্ষা দেবে এমন ভাবা যেতে পারে। যাকে বলা হয়ে থাকে ‘দৃষ্টান্তমূলক’ শাস্তি। এটি ফাঁসির পক্ষে দ্বিতীয় যুক্তি। শাস্তিটি এমনই ভয়ানক হবে যে, ভবিষ্যতে এমন অপরাধে লিপ্ত হওয়ার আগে সম্ভাব্য অপরাধী দ্বিতীয় বার ভাববে। কিন্তু এই যুক্তিও বাস্তব পরিসংখ্যানের সঙ্গে মেলে না। বিশ্বের সব দেশকে একত্রে দেখলে, মৃত্যুদণ্ড রদ হয়েছে বলে ধর্ষণ ও খুনের মতো অপরাধ বেড়েছে এমন প্রমাণ পাওয়া যায় না।

বিচারপতি এ এস আনন্দ ধনঞ্জয় চট্টোপাধ্যায়কে মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার সময় যুক্তি দিয়েছিলেন— এটি একটি ‘বিরলের মধ্যে বিরলতম’ অপরাধ। ভারতীয় দণ্ডনীতিতে এমনটাই বলা আছে: শুধু বিরলের মধ্যে বিরলতম অপরাধেই মৃত্যুদণ্ড দেওয়া যেতে পারে। বিচারপতি আনন্দের এই সাজা ঘোষণার পর দশ-দশটি বছর সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষও ও-ভাবেই ভেবেছেন এবং সংবাদমাধ্যমগুলিও তাঁদের সে ভাবেই ভাবিয়েছে। ফাঁসুড়ে নাটা মল্লিকের উপরে অতিরিক্ত প্রচারের আলো, কী ভাবে ফাঁসি দিতে হয় তার কৌশল প্রদর্শন টেলিভিশনের পর্দায়— এ সবের প্রভাব এমন পর্যায়ে গেল যে, একটি কিশোর নিজের উপর তার প্রয়োগ করতে গিয়ে মৃত্যুমুখে পড়ল। সমাজের সেই সামূহিক হননেচ্ছার নিরন্তর দৃশ্যায়ন আমরা নির্দ্বিধায় অবলোকন করেছি ন্যায় প্রতিষ্ঠা হচ্ছে ভেবে। পরে সে বিচারের যথার্থতা নিয়ে প্রশ্ন উঠলেও, প্রতিশোধপ্রিয় মানুষের বিবেককে তা তেমন খোঁচাতে পেরেছে বলে মনে হয় না।

বিভিন্ন সময়ে মৃত্যুদণ্ড বাতিল করার জন্যে সুপ্রিম কোর্টে আবেদন হলেও ভারতে মৃত্যুদণ্ড বাতিল হয়নি। বলা হয়েছে শুধু ‘বিরলের মধ্যে বিরলতম’ অপরাধেই ফাঁসি হতে পারে। এই শ্রেণির অপরাধ যে-হেতু যথাযথ সংজ্ঞায়িত করা যায়নি, তাই কোন অপরাধকে বিরলতম বলা হবে, সে বিচারের ভার বিচারকদের হাতেই ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। ফলে একই ধরনের অপরাধে কোথাও মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে, আবার কোথাও দেওয়া হয়েছে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড। নাবালিকাকে নৃশংস ধর্ষণ ও খুনের অপরাধেও যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে, এমন দৃষ্টান্ত আছে। আইন-বিশ্লেষকদের আলোচনায় যা উঠে আসে তা হল, বিচারক-বিশেষের রাজনৈতিক ও দার্শনিক প্রজ্ঞার পার্থক্যের ফলে এমন তফাত হয়ে থাকে। এই সম্ভাবনা মাথায় রাখলে কেউ প্রশ্ন করতে পারেন যে, মামলা কোন বিচারকের কাছে যাবে, আর তাঁর দার্শনিক অবস্থান কী, তার উপরে কি কোনও আসামির প্রাণদণ্ড হওয়া বা না-হওয়া নির্ভর করে? এই ব্যাপারটি মৃত্যুদণ্ড রেখে দেওয়ার পক্ষের যুক্তিকে দুর্বল করে দেয়। অন্য শাস্তির ক্ষেত্রে ক্ষতির মাত্রা তেমন নয়— একই অপরাধে কারও পাঁচ বছরের জেল হল তো কারও দশ। কিন্তু মৃত্যুদণ্ড তো একেবারেই আলাদা।

এ ছাড়া আরও যুক্তি রয়েছে। ধরা যাক যাবতীয় তথ্যপ্রমাণ থেকে বোঝা যাচ্ছে অভিযুক্ত আসামি অপরাধী, কিন্তু ক্ষীণ সন্দেহ থেকে যাচ্ছে যে, তিনি অপরাধী নাও হতে পারেন। অতীতে এমনও হয়েছে যে, মৃত্যুদণ্ডের রায়দানের পরেও নতুন করে তথ্যপ্রমাণ ঘেঁটে দেখা গিয়েছে, নিশ্চিত ভাবে বলা যাচ্ছে না যে, অভিযুক্তই অপরাধী। যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হলে অভিযুক্তের তবু মুক্তি পাওয়ার সম্ভাবনা থাকছে এ রকম ক্ষেত্রে, কিন্তু ফাঁসি হয়ে গেলে আর সে সুযোগ থাকে না। তাই রাষ্ট্র যে-হেতু মৃত নাগরিককে জীবন দিতে পারে না, রাষ্ট্রের জীবন নিয়ে নেওয়ারও অধিকার থাকতে পারে না। এই যুক্তিটির পিছনে রয়েছে ‘সামাজিক চুক্তি’র ধারণাটি, যেখানে সমাজের মানুষজন যেন একটি অন্তর্নিহিত চুক্তি দ্বারা স্থির করেছে রাষ্ট্র নাগরিকদের সুরক্ষার কাজটি করবে এবং নাগরিকরাও কিছু স্বাধীনতা স্বেচ্ছায় বিসর্জন দেবে এই সামূহিক মঙ্গলের জন্যে। এ রকম একটি চুক্তিতে কোনও নাগরিক কি সম্মতি দিতে পারে, যেখানে রাষ্ট্রকে অধিকার দেওয়া হচ্ছে নাগরিকের জীবন হরণের?

ফাঁসি নিয়ে এই চিল-চিৎকারের মধ্যে যে আশঙ্কাটি থেকে যায় তা হল, যে প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো এই অপরাধ সংঘটন সম্ভব করে, তা সংশোধনের দাবিটিতে চাপা পড়ে যায়।

অন্য বিষয়গুলি:

R G Kar Medical College And Hospital Incident
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy