প্রতীকী ছবি।
খয়রাতি নিয়ে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর মন্তব্যটি ভর্তুকির যৌক্তিকতা বিষয়ক পুরনো তর্কটিকে ফের জাগিয়ে তুলেছে। মুক্ত বাজারপন্থীরা আরও এক বার মনে করিয়ে দিচ্ছেন যে, ভর্তুকি বস্তুটি নিতান্তই অবাঞ্ছিত, কারণ তা অর্থব্যবস্থাকে কুশলী হতে দেয় না। মুশকিল হল, আর্থিক ভাবে সমাজের সবচেয়ে পিছিয়ে পড়া অংশের মানুষের জন্য বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পে যে টাকা বরাদ্দ করা হয়, যা ছাড়া এই মানুষগুলির পক্ষে বেঁচে থাকাই কার্যত অসম্ভব, ভর্তুকির বিরুদ্ধে আক্রমণ শানানোর সময় সেগুলিকেও রেয়াত করা হয় না। সেই আক্রমণ এমনই প্রবল যে, মাননীয় সুপ্রিম কোর্টকে মনে করিয়ে দিতে হল, ভর্তুকি ও খয়রাতির বিতর্কে যেন সামাজিক উন্নয়নের খাতে বরাদ্দ আর ভোটের মুখ চেয়ে দেওয়া অযৌক্তিক খয়রাতির মধ্যে পার্থক্যের কথা ভুলে না যাওয়া হয়।
মহামান্য সুপ্রিম কোর্টের কথার সূত্র ধরে ভর্তুকি বিষয়ে আলোচনা শুরু করার সময় মনে রাখা জরুরি, ভর্তুকির প্রশ্নটি একমাত্রিক নয়, তার বহু স্তর রয়েছে। কেন্দ্রীয় বাজেট, এবং বিভিন্ন রাজ্য সরকারের বাজেটে ভর্তুকি এবং সুবিধা বা নগদ হস্তান্তর প্রকল্পের পরিসংখ্যানগুলিকে খুঁটিয়ে পড়লেই বিষয়টি স্পষ্ট হতে আরম্ভ করবে। কেন সরকারকে কৃষিক্ষেত্রে ভর্তুকি অব্যাহত রাখতে হয়, এবং স্বাস্থ্য ও শিক্ষাব্যবস্থাকে সবার কাছে পৌঁছে দিতে হলে কেন সরকারি উদ্যোগ অপরিহার্য, এই কথাগুলিও বুঝতে হবে। কিন্তু, খুঁটিনাটিতে ঢোকার আগে এক বার দেখে নেওয়া যাক, ‘ভর্তুকি’-র সংজ্ঞাটি ঠিক কী।
ভর্তুকি নিয়ে বিস্তর আলোচনা, তর্ক-বিতর্ক হয় বটে, কিন্তু তার যথাযথ সংজ্ঞা খুঁজে পাওয়া মুশকিল। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার এগ্রিমেন্ট অন সাবসিডিজ় অ্যান্ড কাউন্টারভেলিং মেজার্স (এএসসিএম) একটি বিরল ব্যতিক্রম, যেখানে ভর্তুকির সুস্পষ্ট সংজ্ঞা রয়েছে। এএসসিএম-এর মতে, কোনও ক্ষেত্রে সরকার বা কোনও সরকারি সংস্থা যদি প্রত্যক্ষ ভাবে নগদ হস্তান্তর করে (যেমন অনুদান, ঋণ বা ইকুইটি ইনফিউশন), এবং/অথবা সরকার যদি তার প্রাপ্য রাজস্ব আদায় না করে, বা ছেড়ে দেয়, এবং/অথবা সরকার যদি কোনও পণ্য বা পরিষেবার জোগান দেয়, তবে তাকে বলা হবে ভর্তুকি। তা ছাড়াও, সরকার যদি কোনও রকম আয়-সহায়তা করে, অথবা সহায়ক মূল্যে উৎপন্ন পণ্য ক্রয় করে, তাকেও ভর্তুকি বলেই গণ্য করা হবে। এটাই ভর্তুকির সম্পূর্ণ সংজ্ঞা, যার মধ্যে শুধু সরকারের দেওয়া প্রত্যক্ষ নগদ হস্তান্তরই নেই, বিভিন্ন কর ছাড় ও অন্যান্য কারণে সরকার যে রাজস্ব হারায়, সেটাও ধরা রয়েছে। ভর্তুকি নিয়ে যে তর্ক এখন চলছে, তাতে এই ছাড়ের প্রসঙ্গটা আশ্চর্যজনক ভাবে বাদ পড়ে যাচ্ছে।
২০০৬-০৭ সাল থেকেই কেন্দ্রীয় বাজেটে প্রত্যক্ষ ভর্তুকি ও নগদ হস্তান্তরের পরিসংখ্যান দেওয়া হয় রিসিপ্টস বাজেটের ‘রেভিনিউজ় ফোরগন আন্ডার দ্য সেন্ট্রাল ট্যাক্স সিস্টেম’ শিরোনামের অংশে। কাজেই, এএসসিএম-এর সংজ্ঞা অনুযায়ী ভর্তুকির প্রতিটি খাতের হিসাবই কেন্দ্রীয় বাজেটে থাকে। কিন্তু, ২০১৫-১৬ সাল থেকে বাজেটে এই অংশটির শিরোনাম হল ‘স্টেটমেন্ট অব রেভিনিউ ইমপ্যাক্ট অব ট্যাক্স ইনসেনটিভস আন্ডার দ্য সেন্ট্রাল ট্যাক্স সিস্টেম’। তবে, হিসাবগুলি একই থাকল।
যে কোনও করনীতিতেই এমন অনেকগুলি বিষয় থাকে, যার প্রভাব কর আদায়ের পরিমাণ, এবং কার থেকে কতখানি কর আদায় করা হচ্ছে, এই প্রশ্নগুলির উপর পড়ে। যেমন, করের বিশেষ হার, কর ছাড়, ডিডাকশন, রিবেট, দেরিতে কর দেওয়ার সুবিধা, কর প্রত্যর্পণ ইত্যাদি। এই ব্যবস্থাগুলিকে একত্রে ‘ট্যাক্স প্রেফারেন্সেস’ বা ‘কর সুবিধা’ বলা হয়ে থাকে। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ, উভয় করনীতিতেই এমন সুবিধা থাকতে পারে। এমন সুবিধা দেওয়ার কারণ হল, এর ফলে অধিকতর জনকল্যাণ নিশ্চিত করা যায়। যেমন, সাধারণ মানুষের ব্যক্তিগত সঞ্চয়ের পরিমাণ বৃদ্ধিতে উৎসাহ দিতে সঞ্চয়ের উপর আয়করে ছাড় দেওয়া হয়। তেমনই রফতানি বৃদ্ধি, পরিকাঠামো নির্মাণ, বৈজ্ঞানিক গবেষণা, এবং উন্নয়নের কাজ করলে কর্পোরেট সংস্থাকেও কর ছাড় দেওয়া হয়। এখানে মূল কথা হল, এই যে কর-সুবিধা, বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার সংজ্ঞা অনুসারে এটাও (পরোক্ষ) ভর্তুকি। কাজেই, ভর্তুকির ন্যায্যতা নিয়ে এখন যে বিতর্ক চলছে, এই ছাড়কে সেই পরিধিতে এনে তার যৌক্তিকতা বিচার করা চাই।
আগেই উল্লেখ করেছি যে, প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ কর মিলিয়ে সরকার মোট কতখানি রাজস্ব ছেড়ে দিচ্ছে, ২০০৬-০৭ সাল থেকেই কেন্দ্রীয় বাজেটে তার হিসাব পাওয়া যায়। এই লেখায় আমরা শুধু প্রত্যক্ষ করের হিসাব দেখব। কর্পোরেট ও তদ্ভিন্ন অন্য করদাতারা কী রকম কর দিয়েছেন, তার থেকে আমরা প্রত্যক্ষ কর আদায়ের মূল সূত্রগুলি পাওয়া যায়। প্রত্যক্ষ করের ক্ষেত্রে মোট কত রাজস্ব সরকার ছেড়ে দিয়েছে, ২০১৬ সালের একটি সিএজি রিপোর্টে সেই তথ্য আছে। রিপোর্ট বলছে যে, ২০১০-১১ সালে মোট ছেড়ে দেওয়া রাজস্বের পরিমাণ ছিল আদায় হওয়া প্রত্যক্ষ কর রাজস্বের ২১%। ২০১৪-১৫ অর্থবর্ষে সেই অনুপাতটি কমে দাঁড়ায় ১৫ শতাংশে। কিন্তু, পরবর্তী কালে অনুপাতটি আবার বেড়েছে। সিএজি-র অন্য একটি রিপোর্ট বলছে, ২০১৯-২০ অর্থবর্ষে এই অনুপাতটি এসে দাঁড়িয়েছে ২২ শতাংশে।
ভর্তুকি নিয়ে যে বিতর্ক চলছে, তাতে এই ‘কর সুবিধা’-র বিভিন্ন দিকের বিশেষ তাৎপর্য রয়েছে। শুধুমাত্র ২০১৯-২০ অর্থবর্ষ ছাড়া প্রতি বছরেই দেখা গিয়েছে যে, ব্যক্তিরা আয়করে যত ছাড় পেয়েছেন, তার থেকে বেশি ছাড় পেয়েছে কর্পোরেট সংস্থাগুলি। ২০১৯-২০ সালে যে কী ভাবে ব্যক্তির ছাড়ের পরিমাণ কর্পোরেটের পাওয়া ছাড়ের পরিমাণকে টপকে গেল, তা রহস্য। পাশাপাশি আরও একটা কথা খেয়াল রাখা ভাল। অর্থমন্ত্রী যেখানে জানিয়ে রেখেছেন যে, দীর্ঘমেয়াদে ব্যক্তি আয়করদাতাদের জন্য করের হার কমানো হবে, কিন্তু কোনও ‘কর সুবিধা’ থাকবে না, সেখানে কর্পোরেট ক্ষেত্র কিন্তু একই সঙ্গে দু’ধরনের সুবিধাই পায়— তাদের জন্য ‘কর সুবিধা’ও আছে, আবার করের হারও কম।
সরকার যে ভাবেই আর্থিক ছাড় দিক না কেন— তা ‘কর সুবিধা’ হিসাবেই হোক, করের হার কমিয়েই হোক বা অন্য কোনও ভাবে— তা করা হয় কিছু সুনির্দিষ্ট উদ্দেশ্যে। সেই উদ্দেশ্য যদি পূরণ না হয়? যেমন, ২০১৯-২০ অর্থবর্ষে কর্পোরেট করের হার কমানো হলেও তার ফলে দেশে বেসরকারি লগ্নির পরিমাণ সরকারের অনুমানের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে বাড়েনি। তা হলে কি এই কর ছাড়কে খয়রাতি বলা চলে না?
এই প্রসঙ্গেই কৃষি-ভর্তুকি, বা স্বাস্থ্য ও শিক্ষা পরিষেবাকে সর্বজনীন করার জন্য ভর্তুকির কথা আসে। বাজারপন্থীরা চিরকাল এই গোত্রের ভর্তুকি বা সাহায্যের বিরোধিতা করেছেন— বলেছেন, এতে সম্পদের কুশলী বণ্টন হয় না। গত তিন দশকে এই যুক্তির পালে হাওয়া লেগেছে, কারণ একের পর এক সরকার সমানেই এই ক্ষেত্রগুলিতে সরকারি সাহায্যের পরিমাণ কমিয়েছে। স্বাস্থ্য ও শিক্ষাক্ষেত্রে সরকারি উপস্থিতিতে রাশ টানা হয়েছে, যাতে বেসরকারি পুঁজির জন্য জায়গা তৈরি হয়। আর, কৃষিক্ষেত্রে ক্রমবর্ধমান ভর্তুকির সমস্যার ‘সমাধান’ করতে এই সরকার কৃষি আইন তৈরি করেছিল।
এই পথে হাঁটতে গিয়ে কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন প্রতিটি সরকারই যে বিষয়টি দেখতে অস্বীকার করেছে, তা হল— এই ক্ষেত্রগুলি বিনিয়োগের স্বল্পতায় আক্রান্ত। স্বাস্থ্যক্ষেত্রে বরাদ্দের পরিমাণ জিডিপি-র দেড় শতাংশের সীমা পেরোতেই চায় না— দুনিয়ার যে কোনও বড় অর্থব্যবস্থায় স্বাস্থ্যক্ষেত্রে বরাদ্দের অনুপাত এর চেয়ে বেশি। ১৯৬৬ সালে তৈরি হওয়া কোঠারি কমিশন সুপারিশ করেছিল যে, শিক্ষায় সরকারি বিনিয়োগের পরিমাণ যত দ্রুত সম্ভব জাতীয় আয়ের ছয় শতাংশ করতে হবে— তেত্রিশ দু’গুণে ছেষট্টি বছর কেটে গেল, কেউ কথা রাখেনি।
কৃষিক্ষেত্রেও সরকারি অবহেলার কথা বাড়িয়ে বলা মুশকিল। ঘটনা হল, এখনও দেশের অর্ধেকের বেশি জনসংখ্যা যে ক্ষেত্রটির উপর নির্ভরশীল, সেই কৃষিতে দেশের মোট লগ্নির পরিমাণ নগণ্য। নতুন সহস্রাব্দের গোড়ায় তা ছিল দেশের মোট লগ্নির ১০%— এখন তা অর্ধেকে এসে ঠেকেছে। কাজেই, কৃষিক্ষেত্রে সরকার যে ভর্তুকি দেয়, তা আসলে এই ক্ষেত্রটির প্রতি ধারাবাহিক অবহেলার দাম। কৃষকদের বেঁচে থাকার জন্য ন্যূনতম যেটুকু না হলেই নয়, শুধু সেটুকুই। একে খয়রাতি বলবেন, না অতি সামান্য ক্ষতিপূরণ?
জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়, নয়াদিল্লি
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy