প্রথমে মেয়ের গলায় ফাঁস লাগানো হয়েছিল। এর পরে সেই দড়িতেই এমন ভাবে নিজের গলায় ফাঁস লাগিয়েছিলেন স্বজন, যাতে দু’জনেরই মৃত্যু নিশ্চিত হয়। এক জনের দেহের ভারে অন্য জনের দেহ মাটি থেকে উপরের দিকে উঠে যায়। বেহালার হো চি মিন সরণি থেকে উদ্ধার হওয়া বাবা এবং মেয়ের মৃতদেহের ময়না তদন্তের প্রাথমিক রিপোর্টের ভিত্তিতে এ ব্যাপারে নিশ্চিত হয়েছে পুলিশ। তদন্তকারীদের দাবি, এই মৃত্যুর পিছনে অন্য কারও যুক্ত থাকার প্রমাণ রবিবার রাত পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। প্রাথমিক ভাবে এটি আত্মহত্যার ঘটনা বলেই মনে করা হচ্ছে। কিন্তু ঠিক কী কারণে এই পথ বেছে নেওয়া হয়েছিল, সেই ব্যাপারে কিছু স্পষ্ট করে জানাতে পারেনি পুলিশ।
বেহালার হো চি মিন সরণির একটি দোতলা বাড়ির নীচের তলার ঘর থেকে শুক্রবার রাতে
স্বজন দাস নামে এক ব্যক্তি এবং সৃজা দাস নামে এক তরুণীর মৃতদেহ উদ্ধার হয়। ঘরের সিলিংয়ের লোহার হুকের সঙ্গে একই নাইলনের দড়িতে ঝুলছিল দেহ দু’টি। পরে জানা
যায়, ৫৩ বছরের স্বজন, ২৩ বছরের সৃজার বাবা। মৃতের পরিবার সূত্রে এর পরে সামনে আসে, তরুণী অটিস্টিক ছিলেন। তার জন্য চিন্তায় থাকতেন স্বজন। একাধিক জায়গায় মেয়েকে চিকিৎসার জন্যও নিয়ে গিয়েছিলেন তিনি। তাঁর মৃত্যুর পরে মেয়ের কী হবে, সেই নিয়ে সম্প্রতি স্বজন অবসাদেও ভুগতে শুরু করেন বলে মৃতের পরিবার এবং বন্ধুদের সূত্রে জানা গিয়েছে। ময়না তদন্তের প্রাথমিক রিপোর্টে এর পরে পুলিশ জানতে পারে, শ্বাসরোধ হয়ে মৃত্যু হয়েছে দু’জনেরই। ময়না তদন্তকারী চিকিৎসকেরা পুলিশকে জানিয়েছেন, গলার দাগ এবং আরও কিছু জিনিস দেখে তাঁদের ধারণা, দড়ি জাতীয় কিছু পেঁচিয়ে শ্বাসরোধ করা হয়েছে। পারিপার্শ্বিক তথ্যপ্রমাণ থেকে পুলিশ এক রকম নিশ্চিত, মেয়ের এবং নিজের গলায় ফাঁস লাগিয়েছিলেন স্বজনই।
এ দিন মৃতের পরিবার দক্ষিণ ২৪ পরগনার কালীতলা এলাকার বাড়িতে পারলৌকিক কাজ সেরেছে। পুলিশ জেনেছে, জলি দাসের সঙ্গে ২৫ বছরের বৈবাহিক জীবন স্বজনের। বিয়ের
দু’বছরের মাথায় প্রথম সন্তান সৃজার জন্মের পরে তাঁরা বুঝতে পারেন, সে অটিস্টিক। এর পর থেকেই মেয়ের চিকিৎসার জন্য বিভিন্ন জায়গায় যাওয়া শুরু করেন দম্পতি। এক আত্মীয় পুলিশকে জানিয়েছেন, এত বছরে একাধিক জায়গায় মেয়েকে নিয়ে গিয়ে চিকিৎসকদের দেখিয়েছেন ওই দম্পতি। মেয়েকে তাঁরা থেরাপির ক্লাসেও দিয়েছিলেন।
এর মধ্যেই ন’বছর আগে পুত্রসন্তান হয় দম্পতির। সেই সন্তানকে নিয়ে এর পরে ব্যস্ত হয়ে পড়েন জলি। এক আত্মীয় পুলিশের কাছে দাবি করেছেন, ‘‘ছেলেকে নিয়েই ব্যস্ত থাকত জলি। স্বজনের প্রাণ ছিল মেয়ে। এই নিয়ে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে কিছু বিবাদও হয়। এক বার মেয়ে মাকে কামড়াতে যাওয়ায় অশান্তি চরমে ওঠে। মেয়েকে অন্যত্র কোথাও রেখে আসা যায় কিনা, সেই নিয়ে পরিবারে দীর্ঘ আলোচনা হয়। কিন্তু স্বজন মেয়েকে কাছছাড়া করতে
চায়নি।’’
আগে একটি সংস্থায় চাকরি করলেও সেই কাজ ছেড়ে লকডাউনের পর থেকে নিজের চিমনি, জল শোধন যন্ত্র সারানোর ব্যবসা শুরু করেন স্বজন। সেই জন্যই তিনি বেহালার হো চি মিন সরণির ঘরটি ভাড়ায় নেন।
আত্মীয় এবং প্রতিবেশীদের সূত্রে পুলিশ জেনেছে, দিন কয়েক আগেই স্বজনের এক শ্যালকের স্ত্রীর মৃত্যু হয়। দীর্ঘদিন অসুস্থ থাকা সেই মহিলাকে চিকিৎসার জন্য ভেলোরে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। সেই সময়ে মেয়েকে নিয়ে তাঁদের সঙ্গে ভেলোরে গিয়েছিলেন
স্বজনও। কিন্তু ফিরে এসে মৃত্যু হয় সেই শ্যালকের স্ত্রীর। গত বৃহস্পতিবারই সেই মহিলার শ্রাদ্ধানুষ্ঠান ছিল।
স্বজনের স্ত্রী জলি বলেন, ‘‘বৌদির মৃত্যুর পরে আরও কেমন যেন হয়ে গিয়েছিল স্বজন। বলতে শুরু করে, বৌদি বাঁচল না, আমাদের মেয়েরও কিছু লাভ হবে না। কিন্তু তার জন্য এই পথ বেছে নেবে ভাবিনি।’’ জলির আরও বক্তব্য, ‘‘মেয়েকে নিয়েই সর্বক্ষণ ভাবত স্বজন। ছেলের সব দায়িত্ব আমার উপর ছেড়ে দিয়েছিল। সামলাতে না পেরে কখনও কিছু গোলমাল হয়েছে। কিন্তু তার মানে এই ভাবে সব শেষ করে দিয়ে চলে যাবে, ভাবিনি।’’ পুলিশ সমস্ত বক্তব্যই খতিয়ে দেখছে।
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)