Advertisement
E-Paper

মনের বন্ধু যখন এআই

বেশির ভাগ মানুষ মানসিক সমস্যার কথা কাউকে বলতে লজ্জা পান, বা ভয় পান। চিকিৎসকের কাছে যেতে দ্বিধা বোধ করেন, সময় পান না বা আর্থিক সামর্থ্য থাকে না।

আরণ্যক গোস্বামী

শেষ আপডেট: ০৩ মার্চ ২০২৫ ০৬:৩১
Share
Save

মানসিক স্বাস্থ্যের সুরক্ষা আজ একটা বড় সমস্যা হয়ে দেখা দিয়েছে। উদ্বেগ, হতাশা, ঘুমের সমস্যা, এবং আত্মহত্যার প্রবণতা অপ্রতিহত। ভারতের জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য সমীক্ষা (ন্যাশনাল মেন্টাল হেলথ সার্ভে) অনুযায়ী, প্রতি সাত জন ভারতীয়ের মধ্যে এক জন কোনও না কোনও মানসিক সমস্যায় ভুগছেন, অথচ মানসিক স্বাস্থ্য পরিষেবা এখনও অনেকের নাগালের বাইরে।

বেশির ভাগ মানুষ মানসিক সমস্যার কথা কাউকে বলতে লজ্জা পান, বা ভয় পান। চিকিৎসকের কাছে যেতে দ্বিধা বোধ করেন, সময় পান না বা আর্থিক সামর্থ্য থাকে না। গ্রামীণ এলাকায় এই সমস্যা আরও প্রকট, কারণ সেখানে মানসিক স্বাস্থ্য-বিশেষজ্ঞদের অভাব খুব বেশি। এই সঙ্কট মোকাবিলায় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) এখন নতুন সমাধান হিসেবে উঠে আসছে। এআই-ভিত্তিক চ্যাটবট, মানসিক অবস্থা বিশ্লেষণকারী সফটওয়্যার এবং আত্মহত্যা প্রতিরোধে মেশিন লার্নিং-এর ব্যবহার ধীরে ধীরে বদলে দিচ্ছে চিকিৎসার রীতি।

যখন কেউ মানসিক চাপে থাকেন, হতাশা বা উদ্বেগে ভোগেন, তখন অপর কারও সঙ্গে কথা বলা খুব জরুরি হয়ে ওঠে। কিন্তু সব সময় কাছের মানুষকে বলা সম্ভব হয় না। এই সমস্যার সমাধানে এআই-ভিত্তিক চ্যাটবট এখন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিচ্ছে। অবিকল মানুষের সঙ্গে কথা বলার মতোই কথোপকথন চালায় চ্যাটবট। বরং সেখানে মন খুলে কথা বললেও ভুল-বোঝাবুঝির, বা কাউকে আঘাত করার, ‘মন্দ’ বা ‘গোলমেলে’ বলে গৃহীত হওয়ার আশঙ্কা নেই। ভারতে দু’টি এমন অ্যাপ বেশ জনপ্রিয় হয়েছে। এই দুটোই এআই-চালিত চ্যাটবট, যা উদ্বেগ, হতাশা, ঘুমের সমস্যা এবং মানসিক চাপ (স্ট্রেস) মোকাবিলায় সাহায্য করে। ফোনে কথাবার্তা, বা সমাজমাধ্যমে পোস্ট বিশ্লেষণ করে মানসিক অবস্থা আন্দাজ করতে পারে। গোপনীয়তা রক্ষার সঙ্গে বাড়তি লাভ, সমস্যার সমাধানে ‘কগনিটিভ বিহেভিয়রাল থেরাপি’-ভিত্তিক পরামর্শ। একটি চ্যাটবট বাংলা, হিন্দি-সহ নানা ভারতীয় ভাষাতে কথা বলারও সুযোগ দেয়। এগুলো ‘ডিজিটাল থেরাপিস্ট’-এর কাজ করে। বাড়তি সুবিধে, চব্বিশ ঘণ্টা সহায়তা।

কিন্তু একটা অ্যাপ কী করে মানুষের মনের অবস্থা, তার আবেগ, অনুভূতি ধরতে পারবে? কাজটা অবশ্যই জটিল, কিন্তু এআই মানুষের কণ্ঠস্বর, মুখভঙ্গি এবং লেখার ধরন বিশ্লেষণ করে মানুষের মানসিক অবস্থা অনেকটাই নির্ধারণ করতে পারে। ভারতে কিছু প্রতিষ্ঠান এই প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করছে। গবেষণায় দেখা গিয়েছে, কণ্ঠস্বরের ওঠা-নামা, কথার গতি এবং লয়ের ভিত্তিতে এআই হতাশা বা উদ্বেগের লক্ষণ চিহ্নিত করতে পারে। আপাতত এটি কেবলমাত্র চিকিৎসকদের সহায়তা করার জন্য ব্যবহার করা হয়, যাতে তাঁরা প্রাথমিক পর্যায়ে ঝুঁকিপূর্ণ রোগীদের চিহ্নিত করতে পারেন এবং সময়মতো ব্যবস্থা করতে পারেন।

কিছু হাসপাতাল এবং মানসিক স্বাস্থ্য সংস্থা এআই-ভিত্তিক পূর্বাভাস-মূলক বিশ্লেষণ ব্যবহার করছে। এই প্রযুক্তি রোগীর অতীত চিকিৎসার তথ্য, সামাজিক আচরণ এবং অন্যান্য মাত্রা বিশ্লেষণ করে আত্মহত্যার ঝুঁকি নির্ধারণ করতে সাহায্য করে। আগেই এই প্রবণতা শনাক্ত করতে পারলে চিকিৎক, পরিবার, বন্ধুরা যথাসময়ে সহায়তা দিতে পারবেন বলে আশা করা যায়।

কিন্তু এই সব সম্ভাবনার পাশাপাশি কিছু ঝুঁকিও রয়েছে। যেমন, গোপনীয়তার সুরক্ষা। এআই-ভিত্তিক চ্যাটবট এবং বিশ্লেষণ-মূলক সফটওয়্যার ব্যবহারকারীর ব্যক্তিগত তথ্য সংগ্রহ করে। এটি যথাযথ ভাবে সুরক্ষিত না হলে ব্যক্তিগত তথ্য ফাঁস হওয়ার ঝুঁকি থাকে। প্রশ্ন ওঠে ভারতীয়দের জন্য এআই-এর উপযোগিতা নিয়েও। বেশির ভাগ এআই সফটওয়্যার পশ্চিমের দেশগুলিতে গবেষণার উপর ভিত্তি করে তৈরি। ভারতের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিবেশ অনেকটাই আলাদা। তার সঙ্গে মানানসই এআই-ভিত্তিক মানসিক স্বাস্থ্য পরিষেবা তৈরি করা প্রয়োজন। তা এখনও সম্পূর্ণ হয়নি। যে ‘ডেটাসেট’ ব্যবহার করে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে এআইকে, তার নির্বাচনের কারণেও পক্ষপাত থেকে যেতে পারে এআই-এর প্রয়োগে। গ্রামের দরিদ্র মানুষের কাছেই বা ডিজিটাল মানসিক স্বাস্থ্য পরিষেবা পৌঁছে দেওয়া কতটা সম্ভব? অনেকের তো স্মার্ট ফোন বা নেট-সংযোগই নেই। সেই সঙ্গে, কোনও রোগীর চিকিৎসায় এআই ব্যবহার হচ্ছে কি না সে তথ্য তাঁকে দিতে হবে, তাঁর অনুমতি নিতে হবে, চাইলে এআই-এর ব্যবহার থেকে সরে আসার সুযোগও দিতে হবে।

অবশ্যই, এআই-চালিত মানসিক স্বাস্থ্য পরিষেবা চিকিৎসকের বিকল্প হতে পারে না। চিকিৎসকের বোঝার ক্ষমতা, ব্যক্তিগত যোগাযোগ তৈরির ক্ষমতা, সহানুভূতির জায়গা নিতে পারে না। একে ব্যবহার করা যায় সহায়ক হিসেবে। যা প্রাথমিক ভাবে মানসিক সমস্যা শনাক্ত করতে সাহায্য করবে। ভবিষ্যতে এআই এবং মানুষের মধ্যে এক ধরনের সহযোগিতামূলক সম্পর্ক গড়ে তুলতে হবে, যেখানে প্রযুক্তি রোগনির্ণয় এবং প্রাথমিক সহায়তার ব্যবস্থা করবে, কিন্তু চিকিৎসকের চূড়ান্ত সিদ্ধান্তই বহাল থাকবে। ভারতের দ্রুত ডিজিটালাইজ়েশন এবং প্রযুক্তিগ্রহণের হার দেখলে এটা বোঝা যায় যে, সঠিক নীতি ও উদ্যোগ গ্রহণ করলে, এআই-ভিত্তিক মানসিক স্বাস্থ্য পরিষেবা ভবিষ্যতে আরও কার্যকর হয়ে উঠবে, তার সম্ভাবনা যথেষ্ট।

কম্পিউটেশনাল জীববিজ্ঞান, আরকানসাস বিশ্ববিদ্যালয়

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

AI Mental Stress

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

{-- Slick slider script --}}