Advertisement
E-Paper

কাজের খোঁজে বাংলায়

অনেকেই বিশ্বাস করেন, তে হি নো দিবসা গতাঃ— অভিবাসনের গতি এখন বিপরীত দিকে; কাজের খোঁজে বাংলার মানুষ আজকাল অন্য রাজ্যে চলে যাচ্ছেন।

অভিরূপ সরকার

শেষ আপডেট: ০৩ মার্চ ২০২৫ ০৬:১৯
Share
Save

একটা সময় ছিল যখন সারা দেশ থেকে মানুষ কাজের খোঁজে বাংলায় আসতেন। এই কলকাতা শহরেই গড়ে উঠেছিল মারোয়াড়ি এলাকা, গুজরাতি পাড়া, পঞ্জাবি পাড়া, দক্ষিণ ভারতীয়দের অঞ্চল। গঙ্গার তীরবর্তী কলকারখানাগুলোয় বিহার থেকে আসা শ্রমিকদের উপস্থিতি ছিল চোখে পড়ার মতো। বাঙালির রসনা-নিবৃত্তির ভার ছিল উৎকলবাসী রন্ধন-শিল্পীদের উপরে। অনেকেই বিশ্বাস করেন, তে হি নো দিবসা গতাঃ— অভিবাসনের গতি এখন বিপরীত দিকে; কাজের খোঁজে বাংলার মানুষ আজকাল অন্য রাজ্যে চলে যাচ্ছেন।

পরিযায়ীদের শ্রেণিবিভাগ আছে। যাঁদের প্রশিক্ষণ বা ডিগ্রির জোর রয়েছে তাঁদের অনেকেই যে উচ্চতর রোজগারের আকর্ষণে নয়ডা-গুরুগ্রাম-বেঙ্গালুরু-চেন্নাইয়ে পাড়ি দিচ্ছেন, তাতে সন্দেহ নেই। বস্তুত, কাজের বাজারে প্রবেশ করার ঢের আগে, ইস্কুলের গণ্ডি পেরোবার পরেই, অনেকে ভিন রাজ্যে ডাক্তারি-এঞ্জিনিয়ারিং পড়তে যাচ্ছেন, তার পর উচ্চতর শিক্ষা। তাঁদের একটা বড় অংশ আর এ রাজ্যে ফিরে আসছেন না। উচ্চশিক্ষিত পেশাদারদের মধ্যে যে বিপরীত অভিবাসন একেবারে ঘটছে না, তা অবশ্য নয়— কলকাতার বড় বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে ভিন রাজ্যের ডাক্তার-নার্স কিংবা সেক্টর ফাইভে কর্মরত অন্য রাজ্য থেকে আসা প্রযুক্তিজীবী অবশ্যই দেখা যায়। তবে যাঁরা চলে যাচ্ছেন, তাঁদের তুলনায় যাঁরা আসছেন তাঁদের সংখ্যা সম্ভবত অনেক কম— যদিও এ-বিষয়ে নির্ভরযোগ্য কোনও পরিসংখ্যান বর্তমান প্রতিবেদকের জানা নেই।

মোট পরিযায়ীদের মধ্যে উচ্চশিক্ষিত পরিযায়ীর অনুপাত কিন্তু যৎসামান্য। ভারতে কাজের খোঁজে যাঁরা এক রাজ্য থেকে অন্য রাজ্যে যান, তাঁদের বেশির ভাগই অদক্ষ বা স্বল্পদক্ষ শ্রমজীবী। আন্তঃরাজ্য পরিযায়ীদের গতিপ্রকৃতি বুঝতে গেলে তাঁদের দিকেই তাকাতে হবে। অনেকে বলছেন, স্বল্প-শিক্ষিতরাও দলে দলে ভারতের কোনও বর্ধিষ্ণু রাজ্যে গিয়ে তরি-তরকারি বিক্রি করছেন, ছোটখাটো ব্যবসা করছেন বা নির্মাণশিল্পে কায়িক শ্রমের কাজ করছেন। কথাটা সত্যি হলে মেনে নিতে হবে যে, পশ্চিমবঙ্গে গরিব মানুষদের জন্য জীবনধারণের পরিবেশ নেই।

ভারতের সচ্ছল রাজ্যগুলিতে আজকাল কিছু কিছু বাঙালি শ্রমিক চোখে পড়ে। কিন্তু এ সব অঞ্চলে মোট পরিযায়ী শ্রমিকদের কত জন পশ্চিমবঙ্গের, সেটা চোখে দেখে ঠিক বোঝা যাবে না। তার জন্য পরিশীলিত পরিসংখ্যান প্রয়োজন। ভারতে শেষ জনশুমারি হয়েছিল ২০১১ সালে। তাতে দেখা যাচ্ছে যে, সেই সময় পশ্চিমবঙ্গে ৩.১৪ কোটি মানুষ কাজের প্রয়োজনে বাড়ি ছেড়েছিলেন; কিন্তু তাঁদের মধ্যে ২.৯ কোটিই রাজ্যের ভিতরে কাজ করছিলেন। বাকি ২৪ লক্ষ মানুষকে কাজের তাগিদে রাজ্যের বাইরে যেতে হয়েছে। বঙ্গবাসীদের প্রধানতম পাঁচটি গন্তব্য ছিল ঝাড়খণ্ড (৪.৯৪ লক্ষ), মহারাষ্ট্র (৩.০৯ লক্ষ), উত্তরপ্রদেশ (২.৩৪ লক্ষ), বিহার (২.২৭ লক্ষ) এবং দিল্লি (১.৮২ লক্ষ)। ২০১১ সালের জনশুমারি এটাও জানাচ্ছে যে, বাইরে থেকে পশ্চিমবঙ্গে কাজ করতে এসেছিলেন ৪৪ লক্ষ পরিযায়ী শ্রমিক। তাঁদের মধ্যে বিহার থেকে ১১.০৩ লক্ষ, ঝাড়খণ্ড থেকে ৪.৫৯ লক্ষ, উত্তরপ্রদেশ থেকে ২.৩৮ লক্ষ, অসম থেকে ১.৬৬ লক্ষ এবং ওড়িশা থেকে ১.৪২ লক্ষ সর্বাধিক উল্লেখযোগ্য। অবশ্য, সংখ্যার দিক থেকে সবচেয়ে বেশি ছিলেন সেই শ্রমিকরা, যাঁদের পূর্ববর্তী বাসস্থান ভারতের বাইরে ছিল। এমন ২০.০৫ লক্ষ শ্রমিক বঙ্গে কাজ করতে এসেছিলেন।

দু’টি মন্তব্য। এক, ২০১১ নাগাদ পশ্চিমবঙ্গ থেকে যত মানুষ কাজ করতে বাইরে গিয়েছেন, তার তুলনায় ২০ লক্ষ বেশি মানুষ বাইরে থেকে কাজ করতে পশ্চিমবঙ্গে এসেছেন। কিন্তু যদি ভারতের বাইরে থেকে আসা কুড়ি লক্ষকে এই হিসাব থেকে বাদ দেওয়া যায়, তা হলে দেখা যাবে যে, পশ্চিমবঙ্গ থেকে কাজ করতে যত জন অন্যান্য রাজ্যে গিয়েছেন, মোটামুটি সমানসংখ্যক মানুষ কাজের কারণে অন্যান্য রাজ্য থেকে পশ্চিমবঙ্গে এসেছেন। অর্থাৎ, ২০১১ সালের জনশুমারি অনুযায়ী, পশ্চিমবঙ্গের নিট আন্তঃরাজ্য অভিবাসন প্রায় শূন্য। দুই, অভিবাসনের একটা বড় অংশ ঘটেছে স্বল্প দূরত্বে, নিকটবর্তী রাজ্যগুলির মধ্যে। পশ্চিমবঙ্গের নিকটবর্তী রাজ্যগুলি থেকে যেমন প্রচুর শ্রমিক এখানে কাজ করতে এসেছেন, তেমনই পশ্চিমবঙ্গ থেকেও দলে দলে পরিযায়ীরা গিয়েছেন ও-সব রাজ্যে কাজ করতে। তবে, পশ্চিমবঙ্গ থেকে নিকটবর্তী রাজ্যগুলিতে যত শ্রমিক কাজ করতে গিয়েছেন, ও-সব অঞ্চল থেকে পশ্চিমবঙ্গে এসেছেন তার থেকে খানিক বেশিসংখ্যক শ্রমিক।

২০১১-র পরে আর জনশুমারি হয়নি। ফলে, ছবিটা কতখানি বদলাল, সরাসরি তুলনা করে তা দেখে নেওয়ার উপায় নেই। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর প্রাক্তন প্রধান অর্থনৈতিক উপদেষ্টা সদ্য প্রয়াত বিবেক দেবরায় এবং তাঁর সহযোগী দেবীপ্রসাদ মিশ্র একটি সরকারি গবেষণাপত্রে পরোক্ষ ভাবে ভারতের বর্তমান আন্তঃরাজ্য অভিবাসনের চিত্রটা ধরার চেষ্টা করেছিলেন। ২০২৩ সালে ভারতীয় রেলের অসংরক্ষিত দ্বিতীয় শ্রেণির টিকিট বিক্রির খতিয়ান থেকে তাঁরা আন্তঃরাজ্য অভিবাসনের একটা ছবি নির্মাণ করার চেষ্টা করেছেন। ধরে নেওয়া হচ্ছে, পরিযায়ীদের সিংহভাগ অসংরক্ষিত দ্বিতীয় শ্রেণির কামরায় ভ্রমণ করেন। কাজেই কোনও রাজ্য থেকে যদি অসংরক্ষিত দ্বিতীয় শ্রেণির টিকিট কিনে বেশি যাত্রী অন্যত্র যান, তবে ধরে নিতে হবে যে, সেই রাজ্যটি থেকে বেশি মানুষ কাজ করতে বাইরে যাচ্ছেন। একই ভাবে, যত বেশি অসংরক্ষিত দ্বিতীয় শ্রেণির যাত্রী একটি রাজ্যকে গন্তব্য হিসেবে বেছে নেবেন, ধরে নেওয়া হবে যে, সেই রাজ্যটিতে তত বেশি সংখ্যক ভিন রাজ্যের শ্রমিক কাজ করতে আসছেন। এই অনুমানের সপক্ষে বলা হচ্ছে যে, ২০১১ সালে অসংরক্ষিত দ্বিতীয় শ্রেণিতে ভ্রমণ এবং আন্তঃরাজ্য অভিবাসনের স্রোত, এই দুইয়ের মধ্যে স্ট্যাটিস্টিক্যাল কোরিলেশন বা পরিসংখ্যানগত সম্পর্ক বেশ নিবিড় ছিল। অতএব ২০২৩ সালে এই ভ্রমণের অভিমুখ এবং পরিমাণ দিয়ে আন্তঃরাজ্য অভিবাসনের চিত্রটা ধরা যেতেই পারে।

শ্রমিক পরিযাণের মাত্রা মাপার এই পদ্ধতি নিয়ে বিলক্ষণ প্রশ্ন আছে অনেক রকম। কিন্তু, জনশুমারি না হওয়ায় তথ্যের যে ঘাটতি হয়েছে, তা পূরণ করার ক্ষেত্রে এই সূচক অভিবাসনের একটা মোটামুটি আন্দাজ যে দিতে পারে, তাতে সন্দেহ নেই। বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গ থেকে কত পরিযায়ী শ্রমিক বেরিয়ে যাচ্ছেন, এবং অন্যান্য রাজ্য থেকে কত পরিযায়ী এখানে কাজ করতে আসছেন, তার কিছু ধারণা অসংরক্ষিত দ্বিতীয় শ্রেণির ভ্রমণের পরিসংখ্যান থেকে পাওয়া যাবে।

উক্ত গবেষণাপত্রটি থেকে কয়েকটা দরকারি তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। এক, ২০১২ সালে সারা দেশে মোট অসংরক্ষিত দ্বিতীয় শ্রেণির ভ্রমণের পাঁচ শতাংশের গন্তব্য ছিল পশ্চিমবঙ্গ, ২০২৩ সালে তা বেড়ে হয়েছে ৭.৩৩%। দুই, ২০২৩ সালে দেশের এক রাজ্য থেকে অন্য রাজ্যে যাওয়ার পাঁচটি ব্যস্ততম রুটের একটি হল বিহার থেকে পশ্চিমবঙ্গ। এটা অসংরক্ষিত দ্বিতীয় শ্রেণিতে ভ্রমণের নিরিখে। তিন, ২০১২ সালে অসংরক্ষিত দ্বিতীয় শ্রেণির যাত্রীদের গন্তব্য হিসাবে সারা দেশের স্টেশনগুলির মধ্যে হাওড়ার স্থান তিন নম্বরে ছিল, ২০২৩ সালেও তাই আছে। চার, অসংরক্ষিত দ্বিতীয় শ্রেণির ভ্রমণের উৎস হিসাবে সারা ভারতের প্রথম দশটা জেলার মধ্যে ২০১২ সালে পশ্চিমবঙ্গের কোনও জেলা ছিল না, ২০২৩-এ মুর্শিদাবাদ আছে। কিন্তু যে-হেতু জেলা থেকে জেলা ভ্রমণের তালিকায় মুর্শিদাবাদ-কলকাতা ভারতের ব্যস্ততম রুট, তাই ধরে নেওয়া যায় যে, মুর্শিদাবাদ থেকে যাঁরা সফর শুরু করছেন, তাঁদের বেশির ভাগেরই গন্তব্য কলকাতা।

দু’টি সিদ্ধান্ত। এক, পশ্চিমবঙ্গ থেকে বহির্মুখী অভিবাসন তেমন বাড়েনি। দুই, অন্য রাজ্য থেকে পশ্চিমবঙ্গে এসে কাজ করার প্রবণতা বেড়েছে। একটা সম্ভাব্য ব্যাখ্যা— বর্তমান রাজ্য সরকারের বিভিন্ন জনমুখী নীতি ও প্রকল্পের ফলে বঙ্গের গরিব পরিবারগুলির জীবনধারণ সহজ হয়েছে। ফলে পেটের তাগিদে বাইরে যাওয়ার প্রয়োজন যেমন কমেছে, তেমনই বাইরে থেকে আসা শ্রমিকদের কাছে পশ্চিমবঙ্গ আরও আকর্ষণীয় হয়েছে।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Migration Government Schemes

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

{-- Slick slider script --}}