অর্ধশতাব্দী আগে এক মফস্সলে অ্যানুয়াল পরীক্ষার পর, যখন আর কোনও দায় নেই প্রাত্যহিকের কাছে, সকালে শিশিরভেজা মাঠ পেরিয়ে সেই বালিকা গুটি গুটি চলে যায় কৃষ্ণচূড়া গাছটির তলায়। সেখানে মাদুর পেতে শুরু হয় তার লেখা, কত কী: গল্প, কবিতা, নাটক। চরাচরে বিছিয়ে থাকা এক নিবিড় চুপ, এক শব্দহীন বিপুল তরঙ্গকে সবিস্ময়ে নিজের মধ্যে অনুভব করতে করতে তার যেন মনে হয়, শীতকালটা বেশ জমে গিয়েছে।
অথচ শীত তখনও পড়েইনি। হাওয়ায় শুধু শুকনো টান। খরতেজ রোদ মিঠে হয়ে এসেছে। মতিঝিলের ধারের শ্বেতশুভ্র কাশফুল ধূসর হয়ে ঝরার পালা। রান্নাঘরে রাতভর ভেজানো মটরডাল নরম হয়ে সকালের রোদে বড়ি হওয়ার অপেক্ষায়। সব মিলিয়ে ঝুপসি হয়ে হেমন্তের আগমনকে সেই মুলুকের লোকেরা ঠিক চিনতে পারত না।
কোনওদিনই পেরেছে কি? সাহিত্যে হেমন্ত ঋতুটির উল্লেখ যৎসামান্য। স্বয়ং কালিদাস ঋতুসংহারের চতুর্থ সর্গে হেমন্ত প্রসঙ্গে “নতুন পাতার আবির্ভাবে শস্যগুলি সুন্দর দেখায়… শালিধান পাকে, পদ্মফুল ম্লান হয়ে যায় এবং শিশির ঝরে”, এ সব বলার পরেই পীনস্তনী বিলাসবতী রমণীদের প্রসঙ্গে চলে যান। চর্যাপদে নাহয় কোনও ঋতুই নেই, বৈষ্ণব পদকর্তা লোচনদাসের পদে ‘অগ্রাণে নতুন ধান্য’-এর ছিটেফোঁটা উল্লেখ। ‘কালকেতু’ উপাখ্যানকার মুকুন্দরামও ‘কার্তিক মাসেতে হয় হিমের প্রকাশ’ বলেই হেমন্তের দায় সেরেছেন। পল্লিকবি জসীমউদ্দিনই তাও নকশী কাঁথার মাঠ-এ একটু খেলিয়ে হেমন্তের খেতকে ধরতে চেয়েছেন। বাকিদের ওই ‘লিপ সার্ভিস’টুকুই।
সত্যিই তো, সোনালি ফসল ঘরে তোলা, নবান্ন উৎসব, এ সব নিয়ে গ্রামবাংলার জীবনে হেমন্তের বিশেষ গুরুত্ব ছিল। কিন্তু লক্ষ করুন, বাংলার শ্রেষ্ঠ কবিও হেমন্তের প্রতি কতখানি উদাসীন। বর্ষা আর বসন্তের জন্য যিনি ভূরি ভূরি গান বাঁধলেন, হেমন্তের জন্য তাঁর বরাদ্দ সাকুল্যে চার-পাঁচটি, তাও আবার হেমন্তের পূর্ণশশী দেখেই বসন্তের বাণী মনে পড়ে গেল তাঁর। হেমন্তের ভাগ্যে শুধুই বাছা বাছা বিশেষণ, কুহেলীবিলীন, ভূষণবিহীন। সারা জীবন রবীন্দ্রলালিত হয়েও এখন মনে হয়, এই ঋতুটির ভিতরের সর্বময় শূন্যতা, ধূসরতা, অনির্দেশ্য বিষাদের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ যেন ঠিক মোকাবিলা করতে পারেননি, বুকচাপা অবসাদ আর বিষাদ-কালো তামসীকে জয় করার জন্য প্রায় আর্তনাদের মতো বারংবার দীপালিকায় আপন আলো জ্বালাতে বলেছেন। নতুন সহস্রাব্দের গাঢ় তমিস্রাতে আচ্ছন্ন হতে হতে খানিক বুঝতে পারি রবীন্দ্রনাথের বিপন্নতাকে, এবং নতুন করে চিনতে পারি আর এক জন কবিকে, আঁধারকে আশ্রয় করায় যাঁর কুশলতাকে আমার যৌবনে চর্চিত নাগরিক নৈরাশ্য বলে বোধ হয়েছিল। পরিণত বয়সে এসে বুঝি, আলো-আঁধারির হেমন্তলোক, কার্তিক-অঘ্রানের ম্লান বিকেলের ছায়াচ্ছন্ন বাংলার অন্তরাত্মাকে চিনেছিলেন জীবনানন্দ— রবীন্দ্রনাথের মতো হাঁকপাঁক করে আলোর দিকে যাওয়ার প্রাণান্তকর চেষ্টার বিপরীতে যিনি নিজেকে সম্পূর্ণ সঁপে দেন কুয়াশাঘেরা তামসী পৃথিবীর মধ্যে। সেই বিষাদময় পৃথিবীতে তিনি সুস্থিত চিরকাল। রবীন্দ্রনাথ যদি বর্ষা আর বসন্তের কবি হন, জীবনানন্দ নিশ্চিত ভাবেই হেমন্তের। তাই একই হেমন্তের চাঁদ, যা রবীন্দ্রনাথকে বসন্তের বাণী শোনায়, তা জীবনানন্দের কাছে হয়ে ওঠে মৃত্যুর প্রতীক। তাই, “বাংলার শস্যহীন ক্ষেতের শিয়রে/ মৃত্যু, বড়, গোল চাঁদ;/ গভীর অঘ্রাণ এসে দাঁড়ায়েছে। (‘হেমন্ত’) অথবা প্রথম ফসল গেছে ঘরে,/ হেমন্তের মাঠে মাঠে ঝরে/ শুধু শিশিরের জল/ অঘ্রানের নদীটির শ্বাসে/ হিম হয়ে আসে/ বাঁশ পাতা মরা ঘাস আকাশের তারা/ বরফের মতো চাঁদ ঢালিছে ফোয়ারা।” (‘পেঁচা’)
রবীন্দ্রনাথের হেমন্ত-বৈরাগ্যের অকিঞ্চনতা জীবনানন্দ একাই দশ হাতে পুষিয়ে দিয়েছেন। ‘নির্জন স্বাক্ষর’, ‘পেঁচা’, ‘ধান কাটা হয়ে গেছে’, ‘অঘ্রাণ প্রান্তরে’, ‘হেমন্ত রাতে’, ‘হেমন্ত কুয়াশায়’, ‘হেমন্তের নদীর পারে’, ‘গোধূলি সন্ধির নৃত্য’, হেমন্ত-নামা বাংলাকে উপচে দিয়েছেন কবি।
তবু, অন্য পাঁচটি ঋতু যেমন তাদের নির্ভুল সিগনেচার টিউন নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ত পঞ্চেন্দ্রিয়ের উপর, হেমন্ত কিন্তু সে ভাবে তার নিজস্ব প্রাকৃতিক আকর্ষণ নিয়ে বাঙালির মরমে পশেনি কোনও দিন, তা সে জীবনানন্দ যতই চেষ্টা করুন না কেন। বর্ষা, গ্রীষ্ম, শীত বা ঋতুরাজ বসন্তের কথা ছেড়েই দিন, নীল আকাশে সাদা মেঘের ভেলা, এখানে ওখানে মাথা-তোলা অনাদরের কাশফুল, আর ঝরা শিউলি মিলিয়ে শরতেরও যে মহিমা ছিল, হেমন্তের তার ছিটেফোঁটাও ছিল না। হলফ করে বলুন তো পাঠক, স্কুলে থাকতে ‘আমার প্রিয় ঋতু’ রচনায় কেউ কি কখনও বেছে নিয়েছেন হেমন্তকে? বস্তুত, শরৎ আর শীতের মাঝে ঋতুটি এমন চিঁড়েচ্যাপ্টা, তাকে ঠিক আলাদা করে ঠাহর করা যায় না। অন্য রূপসী ঋতুদের ভিড়ে হেমন্ত যেন ব্রাত্য, অপাঙ্ক্তেয়, সেই ‘সাধারণ মেয়ে’র মতো, শরৎবাবুরাও যাকে নিয়ে লিখতে কদাপি উৎসাহ বোধ করেন না।
বড় হয়ে খেয়াল করলাম, ইংরেজরা যাকে ‘অটাম’ বলেন, আর আমেরিকান সাহেবরা ‘ফল’, তার মধ্যে আসলে শরৎ আর হেমন্ত মাখামাখি হয়ে আছে। প্রতি বছর ‘অটাম’-এর একটা নির্দিষ্ট সময়সীমাও থাকে। উত্তর গোলার্ধে তেইশে সেপ্টেম্বর থেকে একুশে ডিসেম্বর, দক্ষিণে মার্চ থেকে মে। বাঙালি হিন্দুদের মধ্যেও একদা জলবিষুব সংক্রান্তি পালিত হত আশ্বিনের শেষ দিনে, যখন থেকে সূর্যের দক্ষিণায়ন শুরু। নিরক্ষরেখা পেরিয়ে সূর্যের এই চলনের ফলে দিনের ক্রমিক ছোট হওয়া, অগ্রহায়ণ পর্যন্ত। সারা কার্তিক মাস জুড়ে বাঙালির ঘরে যে ব্রত উৎসব পালিত হত, তার প্রধান উপাদান ছিল আকাশপ্রদীপ। একটি বৃহৎ কাঠের বা বাঁশের পুরুষপ্রমাণ দণ্ড নির্মাণ করে তাতে ছিদ্র করে লাগানো হত রক্তবর্ণের পট্টি, যার মধ্যে প্রদীপের স্থাপন। অন্তরিক্ষে অধিষ্ঠিত লক্ষ্মী-নারায়ণের সঙ্গে আবাহন করা হত পিতৃলোকে, প্রেতলোকে থিতু-হওয়া পূর্বপুরুষদেরও, যাতে তাঁরা আকাশপ্রদীপের আলোর পথ চিনে আশীর্বাদ দিতে আসেন উত্তরসূরিদের। আসলে এ হল শীতঋতুর কথা ভেবে মানুষের অগ্নিসঞ্চয়ের অভ্যেস, বহু পরে যা রূপান্তরিত হয়েছে ব্রাহ্মণদের অগ্নিহোত্র রক্ষার আচারে। বাড়ির চাল বা ছাদের উপর বাঁশের মাথায় বাঁধা আকাশপ্রদীপ গ্রামবাংলার একটি চেনা ছবি ছিল। দিনবদলের সঙ্গে, পূর্বজদের আশীর্বাদ যাচ্ঞার তাগিদ এখন আর তেমন কাজ করে না, তাই আকাশপ্রদীপও প্রায় নির্বাপিত।
তবুও গ্রামীণ জীবনে হেমন্ত এখনও রচনা করে চলে নানান উৎসব। এ সময় ঘিরে শুধু বাংলার কৃষকসমাজের দিনলিপিই আবর্তিত হয় না, পশ্চিমের অ্যাপল-পিকিং, পাম্পকিন-কার্ভিং, ফল ফেস্টিভ্যালের হরেক আনন্দ-আয়োজন— যে আয়োজনে শামিল হয় আত্মীয় বন্ধুপরিজন, এক গোটা কমিউনিটি। হয়তো মানুষের সতত মৃত্যুবিমুখতার জন্য বিষাদগন্ধি এই ঋতুর ধূসরতাকে ভুলতে চায় সে, সেখান থেকেই আসে যূথবদ্ধ লৌকিক জীবনচর্যার তাগিদ। “সিন্স ইউ ওয়েন্ট অ্যাওয়ে, দ্য ডে’জ় গ্রো লং/ অ্যান্ড সুন, আই’ল হিয়ার ওল্ড উইন্টার’স সং/ বাট আই মিস ইউ মোস্ট অব অল/ হোয়েন অটাম লিভ্স স্টার্ট টু ফল...”: পঁচাত্তর বছরেরও বেশি আগে লেখা গানটির বিপুল জনপ্রিয়তা বোঝা যায় এই গানের গায়কদের তালিকায় চোখ বোলালে। বিং ক্রসবি, ফ্র্যাঙ্ক সিনাত্রা, ন্যাট কিং কোল, ডরিস ডে, সবাই নিজের মতো করে গেয়েছেন। তাঁদের দেশে, শুধু ঝরে যাওয়ার ডাক এসেছে বলে পাতারা কী অসামান্য রঙের সমারোহে শেষ বারের মতো সাজিয়ে নেয় নিজেদের, আর তার পর টুপটাপ ঝরে পড়ে সামনের বিছানো পথটুকুকে রাঙিয়ে দিয়ে। হেমন্তের সেই পাতা-ঝরা অরণ্য, শীতের প্রত্যাশায় পর্ণমোচী বৃক্ষদের নিষ্পত্র গাম্ভীর্যে দাঁড়িয়ে থাকা দেখতে দেখতে মনে
পড়তে পারে বাংলার হেমন্তের কথা, আমাদের শৈশবের হেমন্ত, যখন পুজোর ছুটিতে বেড়াতে যাওয়ার সময় দূরপথগামী ট্রেনে জানলার ধারে চলে যেত দু’পাশে বিস্তীর্ণ চষাখেতে হলদে হয়ে আসা, হাওয়ায় অল্প অল্প দোলা ধানের শিষ, কাটা হয়ে পড়ে থাকা সোনালি ফসল, স্তূপ করে রাখা খড়ের আঁটি, আর ন্যাড়া, ফসলশূন্য নিস্তব্ধ হেমন্তপ্রান্তরে হামাগুড়ি দেওয়া চাপ চাপ বিষণ্ণতা। সূর্য ডুবছে ও-পাশ দিয়ে।
আস্তে আস্তে কুয়াশা-চাদরে গোধূলির সীমান্ত পেরিয়ে এক অদ্ভুত আঁধার রাতের দিকে এগিয়ে চলেছে চেনা চৌহদ্দি। সেই হেমন্তকেই তো আঁকড়ে ধরা... বার বার।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy