—প্রতিনিধিত্বমূলক ছবি।
বন্ধই করে দিয়েছিলাম যাওয়া। সেই একই ভাবনায় যা বইমেলা সমালোচকদের আলোচনায় প্রায় লব্জ হয়ে উঠেছে। তাই বইমেলা নামক খাদ্যমেলায় যাওয়ার থেকে কলকাতার ফুটপাথে খাদ্যসন্ধানই শ্রেয় এই আছিলায় ওই মাঠের ধুলো থেকে নিজেকে দূরেই রাখতে শুরু করেছিলাম। কত বছর? হিসাব নেই।
ভুলটা ভাঙল গত বছর। প্রয়োজনেই গত বইমেলায় পা রাখতে হয়েছিল একদিন। বইমেলা শেষে দেখলাম তা গড়িয়ে বহু বার হয়ে গিয়েছে। আর “বই তো অনলাইনেই কিনি, তার জন্য বইমেলার কী দরকার?” এটাকেও মিথ্যাচার প্রমাণ করে প্রায় প্রতি দিনই কিছু না কিছু সংগ্রহের ঝোলায় উঠে এসেছিল যা চট করে অনলাইনে পেয়ে ওঠা দুষ্কর— যেমন এশিয়াটিক সোসাইটির অনেক গুরুত্বপূর্ণ প্রকাশনা। এ বছরটাও ব্যতিক্রমী ছিল না।
বদলেছে তো বটেই। বইমেলার আজকের ভিড়ের প্রায় ৯০ শতাংশই ‘সেই’ বইমেলা দেখেননি যা তরুণ বয়সে আমাদের উদ্বেল করে রাখত। বইবাজার, খোলা মাঠে যত্রতত্র গানের আসর। কেউ আঁকছেন, কেউ কবিতা আবৃত্তি করছেন। কেউ বা শুধুই বসে আছেন এক ঝোলা বই ও একরাশ ক্লান্তি নিয়ে। অনলাইন বাজারের কথা তখন ভাবাই যেত না। তাই এক মাঠ বইই ছিল আমাদের কাছে দুনিয়া দেখার জানালা।
কিন্তু সময় বদলায়। দুনিয়া দেখার চশমার চরিত্রও বদলে দেয় প্রযুক্তি। আমরা কি ভাবতে পারতাম যে ‘অডিয়ো বুক’ বলে কিছু হবে যা লোকে গাড়ি চালাতে চালাতে শুনে নিতে পারবে, পড়ার বদলে? মানুষ বড় ব্যস্ত। তাই তারই মাঝে তাকে পড়িয়ে (শুনিয়ে) নেওয়ার কেতাবি আয়োজন। এবং তার জন্য মিশেল ওবামা দু’দুবার গ্র্যামি পাবেন! বই লেখার জন্য নির্দিষ্ট বুকার বা পুলিৎজ়ার নয়!
যাঁদের নাক সিঁটকোনোর তাঁরা নাক সিঁটকোবেনই। কিন্তু ভাবুন তো আমাদের শৈশবের কথা। তখন পড়তে পারতাম না। তাই বড়রা গল্প পড়ে শোনাতেন। সেই তো আমাদের রোমান্সের শুরু। এর পর পড়তে শিখলাম। কিন্তু সময় নেই পড়ার। তাই তো শোনার ব্যবস্থা। কিন্তু তাতে কি মূল ব্যাপারটা বদলায়? মনে করে দেখুন কথক ঠাকুরদের কথা। তাতে যে বই লেখা আটকে গিয়েছিল, তা-ও নয়। মিশেল ওবামার ‘বিকামিং’ বা ‘দ্য লাইট উই ক্যারি’ কিন্তু বেস্ট সেলার লিস্টে দীর্ঘকাল নিজেদের ধরে রেখেছিল।
আসলে সমালোচনা আমাদের মজ্জায়। এবং অতীতটা আমাদের কাছে সব সময়ই অনেক ভাল বর্তমানের থেকে। বইমেলার সমর্থকেরা নিন্দকদের মুখের উপর জবাব দিতে বোধ হয় এই লাইনটাই নেবেন। দেশে যে হেতু এখনও গণতন্ত্র আছে, তাই এই লড়াই চলবেই। তবে বইমেলার উপযোগিতার আলোচনা করতে গেলে তো তার প্রাথমিক ভূমিটা স্পষ্ট করে দিতেই হবে।
আমার কাছে এই ভূমিটা খুব পরিষ্কার। বইমেলা এখনও আমার কাছে দুনিয়ার জানালা। অনেকেই বলবেন, ইন্টারনেটের যুগে এটা একটু বাড়াবাড়ি হয়ে গেল। এটা বাড়াবাড়ি কি না, তার সপক্ষে বা বিপক্ষে প্রমাণ করার যথেষ্ট তথ্য আমার কাছে নেই। তাই আমি বিরুদ্ধ মতকে সম্মান করেই বলি, বই পড়ার অভ্যাস এতই যদি কমে যায় তা হলে বই নিয়েই বা এত আলোচনা হয় কী করে?
বইমেলার সভাপতি, ত্রিদিবকুমার চট্টোপাধ্যায় জানালেন বাংলা বইয়ের বর্তমান বাজারের পরিসর নাকি ১০ হাজার কোটি টাকা। তার মধ্যে সাত হাজার কোটি টাকার বাজারই নাকি পাঠ্যপুস্তকের দখলে। নিন্দকেরা বলবেন, “দেখুন পড়ার বইয়ের পাশে অন্য বইয়ের বাজারের অবস্থা।” তাঁরা বলতে চান, “আজকাল ক’জনই বা অন্য বই কেনেন? কিন্তু ত্রিদিববাবুর দাবি, বাজার বাড়ছে ২০ শতাংশ হারে!
আচ্ছা আগেই বা ক’জন কিনতেন? আমার এক বন্ধুর বাড়িতে বই বলতে ছিল পাঁচালি আর গীতা। আমরা তখন সদ্য আঁতেল। পাকছি। শক্তি চট্টোপাধ্যায়কে শক্তি আর সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে সুনীল বলতে শিখে গিয়েছি। সেই বন্ধু আমাদের সঙ্গে ময়দানের বইমেলায় গিয়ে লাফিয়ে পড়ে ক্যামুর ‘মেটামরফসিস’ কিনে ফেলল। বরাহনগরের ওই বাড়িতে তাদের তিন ভাই-বোনের পাঠ্যপুস্তকের বাইরে সেই প্রথম ‘অন্য’ বই ঢুকল। সেই যে তার বই কেনার নেশা ধরল, অকালমৃত্যুর আগের দিন পর্যন্ত তা তাকে তাড়া করে ফিরেছিল। শুরু হল ক্যামুর বই থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে আড্ডায় নজর কাড়ার চেষ্টা। আর তার পরে আরও অন্য কোনও বই, অন্য কোনও বই থেকে উদ্ধৃতি— এই ভাবে তা নেশায় দাঁড়িয়ে গেল। আবারও বলি, বইবাজারের নির্ভরযোগ্য পরিসংখ্যান মেলা খুব দুষ্কর আজও। তখনকার তথ্য পাওয়া তো আরও কঠিন।
বই পড়া তো নেশা। অন্য নেশার মতোই, প্রথমে চেখে দেখা। তার পর তা নিয়ে কেতা। আর তার পর তাতেই ডুবে যাওয়া। বাঁচোয়া একটাই, বই পড়ার নেশায় কেউ মরে না। এই নেশা ওই পাহাড় চড়ার মতো। মনের পরিসর বাড়ানোর দৌড়।
ষাট বা সত্তরের দশক আমার কৈশোর এবং তারুণ্যের দশক। আমাদের বাড়িতে প্রতিবেশীরা অনেকেই আসতেন শুধু বইয়ের পাহাড় দেখতে। অনেককেই বলতে শুনেছি আমার মায়ের উপর নাকি খুব চাপ। ওই সব বই পরিষ্কার রাখার। তাঁরা ভাবতেই পারতেন না যে, আমাকে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে পরিচয় করিয়েছিলেন মা। আমি স্কুল এবং বাবা অফিস বেরিয়ে গেলে তাঁর সঙ্গী হত রবীন্দ্র রচনাবলী। কিন্তু বরাহনগরের ওই পাড়ায় আমাদের বাড়ি ছাড়া আর মাত্র গোটা দুয়েক বাড়িতে ছিল বই, যা পাঠ্যপুস্তক নয়।
আবার এটাও ঠিক যে তখন বিয়েতে বই উপহার দেওয়ার রেওয়াজ ছিল। যে রেওয়াজ আজ শিক্ষিত সমাজে ব্রাত্য। শোনা যায়, শঙ্খ ঘোষ নাকি বিয়েতে বই উপহার দিতেই পছন্দ করতেন। কিন্তু শঙ্খ ঘোষ আর ক’জন হন?
আরও একটা প্রশ্ন ইদানীং খুব ঘুরছে সমাজমাধ্যমে। এত রান্নার বই কেন? পূর্ণিমা ঠাকুরের লেখা ‘ঠাকুরবাড়ির রান্না’ বইটির কথা জানতাম। কিন্তু কেনার কথা আগে ভাবিনি। গতবারের বই মেলায় নেহাতই কৌতূহলের বশে বইটা ওল্টাতে শুরু করি বইটির প্রকাশকের স্টলে। তার পর কিনেই ফেললাম। আর অদ্ভুত এক পরিচয় ঘটল ঠাকুরবাড়ির কৃষ্টির সঙ্গে। তাঁদের জীবনের শোনা অন্য একটা দিক যেন প্রত্যক্ষ করার সুযোগ ঘটে গেল। রান্নার বই যদি বিক্রি হয়, লেখা হয়, তা কিন্তু আগামী প্রজন্মের জন্য ইতিহাসের অধ্যায় হয়েই থাকে।
আসলে বই পড়াও কিন্তু অন্য দেশ দেখার মতোই নিজের মতো করে অজানাকে জানার নেশা। শুরু করা এবং করানোটাই চ্যালেঞ্জ। তবে এটাও ঠিক অতীতে ট্রেনে ওঠার আগে প্ল্যাটফর্মের বইয়ের দোকান থেকে বই বা সাময়িক পত্র কেনা যেত। কিন্তু এখন সে সুযোগ আর নেই বললেই চলে। উল্টো দিকে কিন্তু এয়ারপোর্টে বইয়ের দোকানের অভাব নেই। যত্রতত্র যাত্রীদেরও দেখা যায় প্লেনের অপেক্ষায় কফির কাপ নিয়ে বা না নিয়ে বইয়ে ডুবে থাকতে। এই পরিবর্তন কী এবং কেন, তা অবশ্যই আলোচনার অপেক্ষা রাখে। কিন্তু বইমেলার বিরুদ্ধে যে যত তিরই ছুড়ুন, আমার কাছে এই মেলা এখনও এক অ্যাডভেঞ্চারের রসদ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy