Advertisement
২২ ডিসেম্বর ২০২৪
সাংবাদিকের সমব্যথী যাঁরা নন, তাঁদেরও প্রতিবাদ করা চাই
Protest

বোকার মতো প্রশ্ন

সমাজমাধ্যমে ঝলসায় বিদ্রুপের বাঁকা ছুরি। যাদের কোলে ঝোল টেনে খবর করছে অমুক কাগজ, তমুক চ্যানেল, তাদের হাতেই তো মার খেয়েছে তার রিপোর্টার।

সমস্বর: কলকাতার এসপ্ল্যানেডে সাংবাদিক নিগ্রহের প্রতিবাদ, ১১ এপ্রিল ২০১৮।

সমস্বর: কলকাতার এসপ্ল্যানেডে সাংবাদিক নিগ্রহের প্রতিবাদ, ১১ এপ্রিল ২০১৮। —ফাইল চিত্র।

স্বাতী ভট্টাচার্য
শেষ আপডেট: ০৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ০৮:৫৫
Share: Save:

ধরুন, হাসপাতালে যখন রোগী দেখা চলছে, তখন বাঁশ-লাঠি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল কিছু লোক। উন্মত্ত প্রহারে চোদ্দো জন চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মী আহত হলেন। কিংবা ভাবা যাক, স্কুলের শ্রেণিকক্ষে শিক্ষকরা যখন পড়াচ্ছেন, তখন কিছু লোক এসে এমন তাড়া দিল যে চোদ্দো জন শিক্ষক স্কুল ছেড়ে দৌড় দিলেন। অথবা কল্পনা করুন, এক দল নারী-পুরুষ তুমুল গালাগালি করতে করতে ঢুকল নানা এজলাসে, সওয়ালরত আইনজীবীদের হাত থেকে ছিনিয়ে নিল নথিপত্র, ভাঙচুর করল চোদ্দো জন আইনজীবীর গাড়ি। ভাবলেই অস্থির হয় নাগরিক-মন। বিচারের দাবিতে মুঠো হাত উপরে ওঠে নির্বিবাদী মানুষটিরও।

শেখ শাহজাহানের বাড়িতে ইডি-র তদন্তকারী দলের হানা দেওয়ার ঘটনার খবর করতে গিয়েছিলেন যে চোদ্দো জন সাংবাদিক ও সংবাদকর্মী, তাঁরাও গিয়েছিলেন ডিউটিতে— যে যাঁর সংবাদ সংস্থার নির্দেশে। তাঁদের রাস্তায় ফেলে বাঁশ পেটা, মোবাইল ছিনতাই, ক্যামেরা ভাঙা, গাড়ি ভাঙচুর— এ সবই দুষ্কৃতীরা করেছে প্রকাশ্যে। এক-এক জন একাধিক বার আক্রান্ত হয়েছেন, বার বার ভাঙা হয়েছে গাড়ি। প্রাণে বেঁচে যে ফিরেছেন, তা স্রেফ মেরে ফেলার নির্দেশ ছিল না বলে। আকাশে উঠেছে কি কোনও মুঠি?

পুলিশ-প্রশাসনের কোনও কর্তা একটি শব্দও খরচ করার কষ্ট করেননি দুঃখপ্রকাশ করে। ক্ষমাপ্রার্থনা তো দূরস্থান। সাংবাদিকের ফাটা মাথা, রক্তাক্ত নাক, মোচড়ানো হাত, আছড়ানো ক্যামেরা, গাড়ির ভাঙা কাচ— এ সব কিছুর সামনে দাঁড়িয়ে নেতা, আধিকারিক, পুলিশের নীরব উচ্চারণ, “এমন তো কতই হয়।” তা হয় বটে। কিন্তু যত বার ঘটে, তত বার অপরাধই তো ঘটে। না কি, বার বার ঘটলে গুরুতর অপরাধ লঘু হয়ে যায়? কেমন সন্দেহ হয়, সাংবাদিকের গায়ে হাত তোলাকে জলভাত করে তোলার একটা সম্মিলিত চেষ্টা যেন চালু রয়েছে। তার পদ্ধতি আর লক্ষ্য, দুটোই নির্দিষ্ট।

পদ্ধতি হল সাংবাদিকের গাড়ি আটকে, মারধর করে, ধমকে-চমকে, ক্যামেরা ভেঙে, মোবাইলের ছবি ডিলিট করিয়ে তাঁকে এলাকা থেকে বার করে দেওয়া। কখনও ফেসবুক লাইভে ‘যা বলেছি মিথ্যা বলেছি, অমুকদা এলাকার ভগবান’ গোছের কথা বলিয়ে নেওয়াও হয়। মোটের উপর সাংবাদিককে আহত, অপদস্থ করে, বাইক-ক্যামেরা ভেঙে তাঁর যারপরনাই ক্ষতি করে, দুর্নীতির অপবাদের ‘ড্যামেজ কন্ট্রোল’ করার জন্য নিযুক্ত থাকে নেতা-ঘনিষ্ঠ বাহিনী। নানা জেলার সাংবাদিকদের অভিজ্ঞতা, প্রতিবাদ করে তাঁরা ধর্না-মিছিল করলে পুলিশ ধরে ল্যাজার দিকের দু’চার জনকে, অথবা নিরীহদের।

আর লক্ষ্য? লক্ষ্য রাজ্যের মধ্যে কিছু ‘নো গো জ়োন’ তৈরি করা। শেখ শাহজাহানের সরবেড়িয়া এলাকা, কার্যত মালঞ্চের পর থেকেই, এমন নিষিদ্ধ এলাকা হয়ে রয়েছে কোভিড অতিমারির কিছু আগে থেকেই। সন্দেশখালিতে কর্মরত এক সাংবাদিক জানালেন, ‘ভাইজানের’ অনুমতি না পেলে এলাকায় ঢোকা নিষেধ। ওই সাংবাদিক নিজে আমপানের পর এলাকায় ত্রাণ-দুর্নীতির খবর করার জন্য মারধর খেয়েছেন। শাহজাহানের বিপুল অবৈধ সম্পত্তির কথা এলাকায় কারও অজানা নয়, তবু ‘স্টোরি’ হতে পারেনি, যত দিন না ইডি-র পিছনে ঢুকলেন সাংবাদিকরা। ওই সাংবাদিকের বিশেষ আফসোস, একটি সেতুতে পৌঁছনোর রাস্তার ছবি তিনি তুলতে পারেননি। সে রাস্তার কাজ চার-পাঁচ বছরেও শেষ হয়নি। কারণ, সেতু ব্যবহার শুরু হলে নৌকা প্রতি এক টাকা ‘নজরানা’ আর মিলবে না শাহজাহানের। এ খবর সত্যি কি না, বোঝার উপায় নেই, যদি না যাওয়া যায় ‘নো গো জ়োন’-এ। নানা জেলায় সাংবাদিকরা মার খেয়ে চিনিয়ে দিয়েছেন নিষিদ্ধ এলাকার সীমানা।

সমাজমাধ্যমে ঝলসায় বিদ্রুপের বাঁকা ছুরি। যাদের কোলে ঝোল টেনে খবর করছে অমুক কাগজ, তমুক চ্যানেল, তাদের হাতেই তো মার খেয়েছে তার রিপোর্টার। বেশ হয়েছে। সাংবাদিকের মধ্যেও হীনতার বোধ কাজ করে বইকি। উৎসব এলে টাকার খাম পৌঁছয় অনেক সাংবাদিকের কাছে, জামা-কাপড়ের ‘প্রীতি উপহার’ আসে। আসে নানা সুযোগ-সুবিধার হাতছানি। অতীতে যা ছিল ব্যতিক্রম, তা ক্রমে নিয়ম হয়ে উঠেছে। ছাপোষা সাংবাদিকের নতুন আইফোনের লোভ আছে, নেতার ‘কাছের লোক’ বলে নিজেকে জাহিরের ইচ্ছে আছে, আবার ভয়ও রয়েছে। রাতে ফোন যায়, ‘তোমার মেয়ে টিউশনির পর একা বাড়ি ফেরে, কিছু হলে আমরা জানি না।’

তবু। তবু সত্য বলা সাংবাদিকের ধর্ম। ভয়, লোভ, ‘স্টোরি’ পাওয়ার তাগিদ, সব কিছুর উপরে উঠে অকপটে যাবতীয় জরুরি খবর তুলে ধরা তার পেশাদারিত্ব। কিন্তু তেমন খবর লিখে সে যাতে বাড়ি ফিরে, চাট্টি খেয়ে নিশ্চিন্তে ঘুমোতে পারে, সেটা নিশ্চিত করা কার দায়িত্ব? সত্যবাদীর সুরক্ষার দায়িত্ব কার? পক্ষপাতহীন সত্য শোনার ধৈর্য আছে ক’জনের? খবর সমাজ গড়ে, সমাজও খবর গড়ে।

সাংবাদিকের মার খাওয়াকে ‘অকুপেশনাল হ্যাজ়ার্ড’ বা পেশাগত ঝুঁকি বলে তাচ্ছিল্য করার একটা চেষ্টাও দেখা যায়। কথাটা অর্ধসত্য। যুদ্ধ, দাঙ্গা, বন্যার খবর করতে গিয়ে সাংবাদিক যদি আহত বা নিহত হন, নালিশ করা চলে না। কিন্তু যখন পরিকল্পিত ভাবে সাংবাদিককে লক্ষ্য করে হিংসা হয়, তা সে পুলিশের হোক বা গুন্ডার, তখন তা ‘অপরিহার্য বিপত্তি’ হল কোন যুক্তিতে? মনোনয়ন জমার দিন বিরোধীর উপর আক্রমণ, বা ছাপ্পা ভোটের ছবি তুললে ক্যামেরা ভাঙা, ছবি ডিলিট করতে বাধ্য করা, ঘটনার জায়গায় যেতে না দেওয়া— এগুলো পেশাগত ঝুঁকি নয়, পেশার উপরে আক্রমণ। নির্বাচন কি যুদ্ধ, না দাঙ্গা, যে সেখানে আইনের শাসন থাকবে না? ‘শান্তিপূর্ণ নির্বাচন’ তকমার আড়ালে অঘোষিত যুদ্ধে রাষ্ট্রশক্তির বিপরীতে থাকে বিরোধী আর সাংবাদিক, দু’জনেই। তাই সাংবাদিকদের বার বার ‘বিরোধী’ বলে দেখেন শাসক।

২০১৭ সালের মে মাসে বামফ্রন্টের নবান্ন অভিযানের ছবি তোলার সময়ে সাংবাদিকদের উপর পুলিশের যথেচ্ছ লাঠিচালনার সম্মিলিত প্রতিবাদ করেছিলেন সাংবাদিকরা। অভিযুক্ত পুলিশকর্মীরা শাস্তি পাবেন কি না, প্রশ্ন করতে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় (২৫ মে) বলেছিলেন, “আমি এই প্রশ্নের জবাব দেব না।” অতঃপর সাংবাদিক হামলার মুখে প্রশাসনের নীরবতাই ক্রমশ নিয়ম হয়ে উঠেছে। বরং সম্মিলিত প্রতিবাদ জোর হারিয়েছে, শাসক-বিরোধী ফাটল চওড়া হয়েছে সাংবাদিকদের মধ্যে।

সাংবাদিকের দুর্বলতা অনেক, সীমাবদ্ধতাও প্রকট। পাঠক-দর্শকের যথেষ্ট কারণ রয়েছে সাংবাদিকের উপরে বিরক্ত হওয়ার। নাহয় সমব্যথী না-ই হোন, তবু নিজের গরজেই সাংবাদিক-নিগ্রহের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে হবে তাঁকে। সন্দেশখালি তো একটা নয়। পশ্চিমবঙ্গের নানা জেলায় কত ‘নো গো জ়োন’-এর অর্থনীতি চলে প্রশ্নহীনতার শর্তে। ‘ওখানে কী জ্বলছে?’ সাংবাদিকের এই একটা প্রশ্ন আগুন লাগিয়ে দিয়েছিল হিন্দুত্ববাদী রাজনীতিতে। সাংবাদিক সিদ্দিক কাপ্পানের উপর উত্তরপ্রদেশ সরকার ইউএপিএ আরোপ করার পরে হাথরসের সেই দলিত মেয়ের উপরে উচ্চবর্ণের গণ-নির্যাতনের প্রশ্নটি নিঃশব্দে সরে গেল রাজনীতির আলোচনা থেকে। তেমনই, ও কাদের ভেড়ি, ওটা কার জমি, ওই বস্তায় কী যাচ্ছে, আবাস প্রকল্পের ওই বাড়ি কার, কিসে খরচ হচ্ছে মিড-ডে মিলের টাকা— এ সব প্রশ্ন রাজ্যের সীমান্তে, খাদানে, ভাটায়, ভেড়িতে মাথা কুটছে। মার খাবে, হুমকি আসবে, পাবে না বাইকের তেলের খরচ, জেনেও এ সব প্রশ্ন করে কে? সেই সাংবাদিকই তো।

অন্য বিষয়গুলি:

Protest Journalists attack
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy