কৌশলী: আলোচনারত উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ ও প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। শাহজাহানপুর, ১৮ ডিসেম্বর ২০২১। পিটিআই।
জওহরলাল নেহরু, গোবিন্দবল্লভ পন্থ, হেমবতীনন্দন বহুগুণা, কমলাপতি ত্রিপাঠী, ইন্দিরা গান্ধী, চৌধুরী চরণ সিংহ, ভি পি সিংহ, নারায়ণ দত্ত তিওয়ারি, মুলায়ম সিংহ যাদব— সকলেই বড় মাপের রাজনৈতিক নেতা। সকলেরই শিকড় উত্তরপ্রদেশে— লোকসভার ৫৪৩ সদস্যের মধ্যে ৮০, রাজ্যসভার ২৪৫ সদস্যের মধ্যে ৩১ জন সদস্য যে রাজ্য থেকে আসেন। উত্তরপ্রদেশের ২৪ কোটি ভোটারের সামনে এখন, ২০২২-এর বসন্তে, ৪০৩ সদস্যের বিধানসভার জন্য নতুন মুখ্যমন্ত্রী বেছে নেওয়ার কাজ। জনবিন্যাসের দিক থেকে দেখলে বোঝা যায়, ভারতের পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী কে হবেন, তা স্থির করার ক্ষেত্রে এই বিরাট রাজ্যটির ভূমিকা কেন ও কতটা গুরুত্বপূর্ণ।
উত্তরপ্রদেশ যেন এক মহাসমুদ্র, বৈপরীত্যের বিশাল সমাহার। রাজ্যের জনসংখ্যার ৮০ শতাংশ হিন্দু— সেই হিন্দুসমাজ আবার বিভক্ত জাতি-বর্ণের বিভাজনে। ব্রাহ্মণ, ঠাকুর ও বানিয়া, এই তিন তথাকথিত উচ্চবর্ণ হিন্দুদের ১৮ শতাংশ, দলিত বা তফসিলি জাতিভুক্ত মানুষরা আরও ২৫ শতাংশ। হিন্দুদের মধ্যে বাকিরা অন্যান্য অনগ্রসর জাতি-গোষ্ঠীভুক্ত (ওবিসি)। সেগুলির মধ্যে অনেক জাতিই আর অনগ্রসর নয়— যেমন জাঠ, বা বহু যাদব গোষ্ঠী— কিন্তু তারা গুরুত্বপূর্ণ ভোট ব্যাঙ্ক, ফলে এই জাতগুলিকে ‘সংরক্ষিত’ শ্রেণির বাইরে ঠেলে দেওয়ার সাহস কোনও দলেরই নেই। উত্তরপ্রদেশে সর্বত্রই এই বৈপরীত্য। এই রাজ্যে প্রতি পাঁচ মাইল অন্তর স্থানীয় ভাষা পাল্টে যায়, উত্তরপ্রদেশের পশ্চিমাংশের জাঠদের হিন্দি বারাণসী বা প্রয়াগবাসী তাঁদের ভাই-বেরাদরদের থেকে আলাদা।
স্বাধীনতার ৭৫ বছর পরে, ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধান দ্বারা পরিচালিত হয়েও উত্তরপ্রদেশের হিন্দু গোষ্ঠীগুলি এই জাতপাতের নিগড়েই বাঁধা। রাজনীতির কৌশলীরাও তা ভাল করেই জানেন। তাই প্রতি বার নির্বাচনের আগে জাতপাতের জটিল অথচ নিখুঁত ভোট ব্যাঙ্ক-কে হাওয়ায় ভাসিয়ে দেওয়া হয়। ২০১৯-এ যেমন উত্তরপ্রদেশের পশ্চিমাংশ পুরোপুরি বিজেপি-কে সমর্থন করেছিল। কিন্তু এ বারের বিধানসভা নির্বাচন আর এই জাতপাতের রাজনীতি দিয়ে জেতার উপায় নেই— এ বার সমীকরণটা হিন্দু-মুসলমানের। ‘হিন্দু খতরেঁ মে হ্যায়,’ সম্প্রতি হরিদ্বারে ধর্ম সংসদে এই রবই উঠেছে। মনে রাখা প্রয়োজন, কী ভাবে এই রাজ্যটি প্রতি বিধানসভা নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দলকে দরজা দেখিয়ে এসেছে। যোগী আদিত্যনাথ সেই প্রবণতাকে সামলে আবারও ক্ষমতায় আসতে পারবেন কি?
ঠাকুর ও ব্রাহ্মণদের দ্বৈরথ উত্তরপ্রদেশে অনেক পুরনো। আশির দশক অবধি এই দুই জাত থেকেই সবচেয়ে বেশি সংখ্যক জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হয়েছেন। তার পরে পালা আসে ওবিসি ও দলিতদের। গোড়ার দিকের বছরগুলিতে ব্রাহ্মণ ভোটাররা— সারা রাজ্যের ভোটারদের মধ্যে যাঁরা ১২% (রাজ্যের পূর্ব দিকের জেলাগুলিতে ২০%)— ছিলেন ক্ষমতার নির্ধারক। তখনকার বড় আসনগুলির নেতারা— নেহরু, পন্থ, কমলাপতি ত্রিপাঠী— সকলেই ছিলেন ব্রাহ্মণ; কাশ্মীরি পণ্ডিতের উত্তরসূরি হওয়ার সুবাদে ইন্দিরা গান্ধীও। ষাটের দশকের শেষ দিকে অ-কংগ্রেসি জমানার হাত ধরে শক্তিশালী অব্রাহ্মণ নেতা, যেমন চৌধুরী চরণ সিংহ, রামমনোহর লোহিয়া, রাজ নারায়ণ প্রমুখ উঠে আসেন। ইন্দিরা গান্ধীর আমলে কংগ্রেসের তিন ব্রাহ্মণ নেতা— কমলাপতি ত্রিপাঠী, হেমবতীনন্দন বহুগুণা ও নারায়ণ দত্ত তিওয়ারি উত্তরপ্রদেশ শাসন করেন। কিন্তু জরুরি অবস্থার পরবর্তী সময়ে ওবিসি নেতা রামনরেশ যাদব উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী হন। কংগ্রেসের অধীনে ঠাকুর নেতা ভি পি সিংহের হাতেও ক্ষমতা আসে, কিন্তু তাঁর মেয়াদ পূর্ণ হয়নি, তার আগেই তাঁকে কেন্দ্রে ডেকে নেওয়া হয়।
এর পর আসে মণ্ডল জমানা, শক্তিশালী ওবিসি যাদব নেতা মুলায়ম সিংহ যাদব মুখ্যমন্ত্রী হন। কিছু বছর পর ক্ষমতায় আসেন দলিত নেত্রী মায়াবতী। সেই থেকে ওবিসি (৪০%-এরও বেশি) ও দলিত-আধিপত্যই পালা করে উত্তরপ্রদেশ শাসন করে এসেছে। কিন্তু রাজ্যের ভোটারদের উপরে চরণ সিংহের বিপুল প্রভাবে গ্রামাঞ্চলের ধনী ও বিপুল জমির অধিকারী জাঠরা মাত্র ২% উপস্থিতি সত্ত্বেও রাজ্যে শক্তিশালী হয়ে ওঠে। জাটভ গোষ্ঠীর দলিত নেত্রী মায়াবতীর রাজনৈতিক গুরু ছিলেন রামদাসি শিখ কাঁসিরাম। ২০১২ অবধি মুলায়ম ও মায়াবতী পর্যায়ক্রমে উত্তরপ্রদেশে ক্ষমতায় থাকেন, তার পরেই মন্দির-রাজনীতির সূত্রে বিজেপির উত্থান।
আডবাণীর রথযাত্রা বিজেপিকে বিরাট সুবিধা করে দিয়েছিল বটে, কিন্তু ২০১৪-তে নরেন্দ্র মোদী প্রধানমন্ত্রী হওয়া ইস্তক উত্তরপ্রদেশে বিজেপির প্রভাব ছিল মূলত বানিয়াদের এবং ব্রাহ্মণদের একাংশের মধ্যে। ব্রাহ্মণ নেতা অটলবিহারী তখন শয্যাশায়ী, আডবাণীর সঙ্গে আর এক ব্রাহ্মণ নেতা মুরলীমনোহর জোশীকে পাঠানো হল মার্গদর্শক মণ্ডলীর হিমঘরে। উত্তরপ্রদেশেও শুরু হল এক নতুন অধ্যায়। ২০১৭ সালে বিজেপি ক্ষমতায় এল, মোদী মুখ্যমন্ত্রী করলেন গোরক্ষপন্থী গোষ্ঠীপ্রধান যোগী আদিত্যনাথকে। জাতপাতের সমীকরণ-দ্বন্দ্বে জটিল উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রীর মসনদ এর আগে দেখেছে, অধিকাংশ অব্রাহ্মণ মুখ্যমন্ত্রীই পাঁচ বছরের মেয়াদ পূর্ণ করতে পারেননি। কিন্তু মোদীর আশীর্বাদধন্য যোগী তা পেরেছেন। বিজেপির কৌশলীরা অবশ্য রাজ্য রাজনীতিতে ব্রাহ্মণদের গুরুত্বও নতুন করে বুঝছেন। সে জন্যই কাশীতে এত ধুমধাড়াক্কা, অযোধ্যার রামমন্দির নিয়ে পাহাড়প্রমাণ প্রচার, পা ছুঁয়ে প্রণামের ঘটা ইত্যাদি। মুলায়ম সিংহ যাদবের পুত্র, মুখ্যমন্ত্রী পদপ্রার্থী অখিলেশ যাদব সম্প্রতি পরশুরামের পুজো দিলেন, বিজেপি-ও তড়িঘড়ি লখনউয়ে পরশুরামের বিগ্রহ উন্মোচন করল, এও বলল, সমাজবাদী পার্টির নেতা নাকি তাদের নকল করছেন। প্রিয়ঙ্কা গান্ধীর মন্দির-দর্শনকেও বলা হল রাজনৈতিক গিমিক, কেননা ‘সনাতন ধর্ম’ সম্পর্কে তিনি অজ্ঞ, উপরন্তু এক অ-হিন্দুর ঘরনি।
গত পাঁচ বছরে দলিতদের উপর একের পর এক আক্রমণ ও হেনস্থা, বিশেষত দলিত মেয়েদের ধর্ষণের ঘটনা বুঝিয়ে দেয়, যোগী জমানায় দলিতদের ক্ষমতা ও গুরুত্ব বেশ কমে গিয়েছে। কাঁসিরাম ও মায়াবতীর গড়া দলিত ও মুসলিম সমর্থনের ভিত্তিকে বিজেপি অনেক কালই হাত করার চেষ্টা করছে, মায়াবতীকে কট্টর জাটভপন্থী হিসাবে দেখিয়ে, এবং দুসাধ, মাল্লা ও অন্যান্য দলিত গোষ্ঠীর প্রতি তাঁর অবহেলাকে তুলে ধরে। বিপক্ষ দলের মধ্যে ভাঙন ধরানোয় বিজেপির প্রতিভা সম্প্রতি দেখা গিয়েছে পশ্চিমবঙ্গেও, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে ঘর সামলাতে কম ঝক্কি পোহাতে হয়নি। কিন্তু অন্যত্র, বিশেষত উত্তরপ্রদেশে জাঠ-মুসলিম, ঠাকুর-ব্রাহ্মণ, জাটভ-যাদব সমীকরণের ক্ষেত্রে বিজেপি ক্রমে তোল্লাই দিয়ে গেছে তরুণ উচ্চাকাঙ্ক্ষী নেতাদের উত্থানকে, যাতে সময়মতো এঁদের দলে টেনে নেওয়া যায়।
কিন্তু এ বার কোভিডের তৃতীয় তরঙ্গ, অতিমারিজনিত দারিদ্র ও বেকারত্বে ধ্বস্ত উত্তরপ্রদেশে ঠাকুর-ব্রাহ্মণ জাতপাতের পুরনো সমীকরণের সাঁকো বিপজ্জনক ভাবে দুলছে। ব্রাহ্মণ-সমাজে এমনও কানাঘুষো, গোরক্ষপন্থী গোষ্ঠীপ্রধান যোগী আদিত্যনাথ আদতে এমন এক গোষ্ঠীর প্রতিনিধি, ‘সনাতন ব্রাহ্মণ’রা যাকে বলেন ‘ভেদ বাহ্য’, বৃত্তের বাইরে যাঁদের স্থান। কাশীর আরতি, অযোধ্যার ভূমিপূজন, এই সব কিছুই করা হয়েছিল কোন্দলের ফাটল ভরাতে। হরিদ্বারে ধর্ম সংসদেরও মূল বার্তা এই: উত্তরপ্রদেশের মহাভারতের যুদ্ধ জাতপাতের হবে না, হবে হিন্দু বনাম ‘ম্লেচ্ছ’-র।
উৎপাদনের ক্ষেত্রগুলি যত দিন উচ্চবর্ণ, জাতি বা আমলাতন্ত্রের হাতে থাকবে; মিডিয়া ও অন্যান্য সরকারি এজেন্সিতেও জায়গায় জায়গায় যথেষ্ট সংখ্যক ব্রাহ্মণ, ঠাকুর, বৈশ্য ও কায়স্থের উপস্থিতি থাকবে, অসাম্য বা জাতপাত-ভিত্তিক নির্বাচনতন্ত্রের বিরুদ্ধে উদারপন্থীদের সরব প্রতিবাদ কার্যত নিষ্ফল হবে। জাতপাতের মেরুকরণ ছাড়াও দ্বিতীয় একটি প্রতি-মেরুকরণ প্রক্রিয়া উত্তরপ্রদেশের সর্বত্র দেখা যাচ্ছে— সংখ্যার দিক থেকে হাতে গোনা অথচ অতি ধনী কিছু মানুষ, এবং দারিদ্রসীমার নীচে বসবাসে বাধ্য হওয়া সাধারণ মানুষের মধ্যে তীব্র, চোখে পড়ার মতো ব্যবধান। একে নিষ্ঠুর, আগ্রাসী ছদ্ম-পুঁজিবাদ বলা যাবে কি না তা অন্য আলোচনা, কিন্তু রাজ্যের সুস্থিত ও ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক ‘এলিট’দের পক্ষে তা এক চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy