নরেন্দ্র মোদীর মুখে আর ‘রেউড়ি’ শব্দটা শোনা যায় না। ২০২২-এর ১৬ জুলাই উত্তরপ্রদেশের বুন্দেলখণ্ড এক্সপ্রেসওয়ের উদ্বোধন করতে গিয়ে তিনি বলেছিলেন, ‘রেউড়ি সংস্কৃতি’ দেশটাকে গোল্লায় পাঠাবে। আজ সে কথা আর বলেন না।
উত্তর ভারতের মন্দিরে, পুজোপার্বণে চ্যাপ্টা তিলের নাড়ু বিলি করা হয়। তিল ও গুড়ের তৈরি এই মিষ্টির নামই রেউড়ি। নরেন্দ্র মোদী আচমকাই সেই সামান্য রেউড়িকে রাজনৈতিক অভিধানে তুলে এনেছিলেন। ভোটে জিততে রাজ্যে রাজ্যে যে খয়রাতি চলে, গরিব মানুষের কল্যাণের নামে যে নগদ টাকা ছড়ানো হয়, তাকেই তিনি রেউড়ি সংস্কৃতি বলে তোপ দেগেছিলেন। তাঁর দাবি ছিল, মাত্রাছাড়া জনমোহিনী রাজনীতির ফলে রাজ্য সরকারের কোষাগারগুলির হাঁড়ির হাল হচ্ছে। নীতি আয়োগ রাজ্যের মুখ্যসচিবদের ডেকেও সতর্ক করেছিল, এই খয়রাতির ‘রেউড়ি সংস্কৃতি’ চলতে থাকলে আর্থিক দেউলিয়া দশা হবে।
নরেন্দ্র মোদীর আগে আর কোনও রাজনীতিক খয়রাতির বিরুদ্ধে সরব হওয়ার ঝুঁকি নেননি। তবে তাঁর ক্ষোভের কারণ ছিল। ২০২১-এই পশ্চিমবঙ্গে বিধানসভা নির্বাচনে অমিত শাহ দাবি করেছিলেন, বিজেপি ২০০-র বেশি আসনে জিতে ক্ষমতায় আসবে। কিন্তু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সেই ‘রেউড়ি’ দিয়েই বাজিমাত করেছিলেন। বিধানসভা ভোটের আগে তৃণমূল সরকার ‘লক্ষ্মীর ভান্ডার’ প্রকল্প চালু করেছিল। তৃতীয় বার ক্ষমতায় ফেরার পিছনে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রধান অস্ত্র হয়ে উঠেছিল লক্ষ্মীর ভান্ডার প্রকল্পে মাসে এক হাজার টাকার আর্থিক অনুদান প্রকল্প। রেউড়ি সংস্কৃতিকে তোপ দাগার কারণ হিসাবে হয়তো নরেন্দ্র মোদীর এ নিয়ে হতাশাও কাজ করেছিল।
গত দু’তিন বছরে রাজনীতিতে অনেক জল গড়িয়েছে। এই রেউড়ি এখন নরেন্দ্র মোদী ও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে একই রাজনৈতিক অবস্থানে নিয়ে এসেছে। এক দিকে পশ্চিমবঙ্গে আর জি কর হাসপাতালে তরুণী চিকিৎসকের খুন-ধর্ষণের অভিযোগের পরে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে ক্ষোভ আছড়ে পড়েছে। এই পরিস্থিতি থেকে ঘুরে দাঁড়াতে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী লক্ষ্মীর ভান্ডারের মতো প্রকল্পেই ভরসা রাখছেন। তৃণমূলের বিশ্বাস, মাসে মাসে লক্ষ্মীর ভান্ডার-এর মতো প্রকল্পে টাকা পাওয়া মহিলারা ভোট এলে আবার তৃণমূলের পাশেই থাকবেন। রাজ্যের আসন্ন ছ’টি বিধানসভা কেন্দ্রের উপনির্বাচনেই তার প্রমাণ মিলবে।
অন্য দিকে, নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বে বিজেপি মহারাষ্ট্র বিধানসভা নির্বাচনের কঠিন পরীক্ষা উতরোতে সেই লক্ষ্মীর ভান্ডার প্রকল্পেরই আর এক নাম—‘লড়কি বহিন’ বা প্রিয় বোন যোজনা-য় ভরসা করছে। ভোটের আগে মহারাষ্ট্রের বিজেপি, একনাথ শিন্দের শিবসেনা ও অজিত পওয়ারের এনসিপি-র জোট সরকার রাজ্যের আড়াই কোটি মহিলার হাতে মাসে মাসে দেড় হাজার টাকা করে তুলে দেওয়ার প্রকল্প চালু করেছে। বিজেপির বিশ্বাস, পশ্চিমবঙ্গে যেমন লক্ষ্মীর ভান্ডার তৃণমূলকে বিধানসভা ভোট, তার পরে সাম্প্রতিক লোকসভা ভোটের বৈতরণি পার করিয়েছে, তেমনই মহারাষ্ট্রের ভোটের বৈতরণিও ‘লড়কি বহিন যোজনা’-য় হাত ধরে পার হওয়া যাবে।
রাজ্যের তৃণমূল সরকার ও মহারাষ্ট্রের বিজেপির জোট সরকারের মিল, দুই সরকারই মহিলাদের অনুদান দিচ্ছে ধারের টাকায়। পশ্চিমবঙ্গের বাজেটের নথি দেখলে দেখা যাবে, লক্ষ্মীর ভান্ডার, কন্যাশ্রী-র মতো প্রকল্পে রাজ্য সরকারকে ভর্তুকি দিতে যে টাকা খরচ হয়, তার সবটাই ধার করে আসে। উদাহরণ হল, ২০২১-২২ অর্থবর্ষে রাজ্য সরকারের ভর্তুকির বহর ছিল ৪৫ হাজার কোটি টাকা। ওই বছরে পশ্চিমবঙ্গের রাজস্ব ঘাটতির পরিমাণ ছিল ৩৭ হাজার কোটি টাকা। যার অর্থ ভর্তুকি বা খয়রাতির সব টাকাই এসেছে ঋণের থেকে।
মহারাষ্ট্র সরকারের অবস্থাও একই রকম। মহারাষ্ট্রের বিজেপির জোট সরকার লড়কি বহিন যোজনার জন্য বছরে ৪৬ হাজার কোটি টাকা ব্যয় করবে। রাজ্যের রাজস্ব ঘাটতির পরিমাণ ২০ হাজার কোটি টাকার বেশি। অথচ লড়কি বহিন যোজনা-সহ ভোটের আগে চালু করা সাতটি জনমোহিনী প্রকল্পে মহারাষ্ট্রের সরকার প্রায় ১ লক্ষ কোটি টাকা খরচের কথা বলেছে। এর অর্থ হল, এই সব টাকাই আসবে ধার করে।
উপায় কী? মুম্বই দেশের আর্থিক রাজধানী। যেন তেন প্রকারেণ তাই নরেন্দ্র মোদী-অমিত শাহরা মহারাষ্ট্রের সরকার নিজের হাতে রাখতে চান। তার জন্য দল ভাঙিয়ে উদ্ধব ঠাকরের নেতৃত্বে শিবসেনা, কংগ্রেস, এনসিপি-র সরকার ফেলে দিতে কসুর করেনি বিজেপি। উদ্ধবের শিবসেনা থেকে একনাথ শিন্দেকে ভাঙিয়ে এনে মুখ্যমন্ত্রী পদে বসিয়েছে বিজেপি। যদিও সংখ্যার বিচারে বিজেপিরই মুখ্যমন্ত্রী পদ পাওয়ার কথা। সেই সরকার টিকিয়ে রাখতে শরদ পওয়ারের ভাইপো অজিত পওয়ারকেও এনসিপি ভেঙে নিজেদের দিকে টেনে এনেছে বিজেপি। এই দল ভেঙে সরকার তৈরি যে মহারাষ্ট্রের মানুষ ভাল ভাবে নেয়নি, গত লোকসভা ভোটে তার প্রমাণ মিলেছে। মহারাষ্ট্রের ৪৮টি লোকসভা নির্বাচনের মধ্যে এনডিএ মাত্র ১৭টি আসন জিততে পেরেছে। বিজেপি সব থেকে খারাপ ফল করেছে। মহারাষ্ট্রে বিজেপির আসন সংখ্যা ২৩ থেকে ৯-এ নেমে এসেছে। মানুষের সহানুভূতি পেয়েছেন উদ্ধব ঠাকরে। বিজেপির বিরুদ্ধে ক্ষোভ উগরে দিয়েছেন মহারাষ্ট্রের মানুষ।
জনমানসের এই ক্ষোভ মিটিয়ে ২০ নভেম্বরের ভোটের আগে মানুষের মন জয় করতে বিজেপি রাজ্যের মহিলাদের ‘প্রিয় বোন’ বলে আর্থিক অনুদান বিলি করছে। ঠিক যে ভাবে আর জি কর-কাণ্ডে সাধারণ মহিলারা রাস্তায় নেমে বিচার চাইছেন দেখে আতঙ্কিত তৃণমূল নেতৃত্ব বার বার লক্ষ্মীর ভান্ডারের কথাই মনে করিয়ে দিচ্ছেন। বিজেপি ও তৃণমূল, দুই দলের নেতারাই জানেন, হাতে নগদ টাকা দিয়ে মন জয় করার কৌশল পরীক্ষিত সত্য। পশ্চিমবঙ্গের মতো তামিলনাড়ুতেও ডিএমকে সরকার মহিলাদের হাতে এক হাজার টাকা করে অনুদানের পথে সাফল্য পেয়েছে। বামশাসিত কেরলেও একই ধরনের প্রকল্প চলছে। তেলঙ্গানা, কর্নাটকে একই প্রতিশ্রুতি দিয়ে কংগ্রেস ক্ষমতায় এসেছে। গত বছর মধ্যপ্রদেশে বিধানসভা ভোটেও বিজেপি ‘লাডলি বহেন’ সাফল্য পেয়েছে। মধ্যপ্রদেশে তো বিজেপি রীতিমতো নিলাম হেঁকেছিল। কংগ্রেস মাসে এক হাজার টাকা করে দেওয়ার কথা বলায় বিজেপি তা বাড়িয়ে ১,২৫০ টাকা করেছিল। কংগ্রেস দেড় হাজার টাকা বলায় বিজেপি তিন হাজার টাকা দর হেঁকেছিল।
পশ্চিমবঙ্গে গত বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপিকে একই পথ নিতে হয়েছিল। তৃণমূল প্রচার করেছিল বিজেপি রাজ্যে ক্ষমতায় এলে লক্ষ্মীর ভান্ডারের মতো প্রকল্প বন্ধ করে দেবে। তার মোকাবিলায় খোদ অমিত শাহকে রাজ্যে প্রচারে গিয়ে বলতে হয়েছিল, লক্ষ্মীর ভান্ডারে বিজেপি টাকা বাড়িয়ে দেবে। নামকরণ পাল্টানোর কথা বললেও টাকা বন্ধ করার সাহস বিজেপি দেখাতে পারেনি। এমনকি সিপিএম নেতাদের প্রচারে নেমে বলতে হয়েছিল, বামেরা ফের ক্ষমতায় ফিরলে লক্ষ্মীর ভান্ডারের মতো প্রকল্পের সুবিধা আরও বাড়বে। ঘরে বসে ফেসবুক-টুইটারে নিয়মিত বিপ্লবের ডাক দেওয়া কিছু স্বঘোষিত বামপন্থী লক্ষ্মীর ভান্ডারকে উৎকোচ হিসাবে তকমা দিয়েছিলেন। তার খেসারত দিতে হয়েছিল সিপিএমকে। ভোটের ফলের পরে তা সিপিএম নেতৃত্ব তা মেনেও নিয়েছিলেন।
মহারাষ্ট্রের বিজেপির জোট সরকারের মুখ্যমন্ত্রী একনাথ শিন্দে বলেছেন, ফের ক্ষমতায় এলে লড়কি বহিন প্রকল্পের টাকা ভবিষ্যতে বাড়িয়ে তিন হাজার টাকা করা হতে পারে। পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূল সরকারের লক্ষ্মীর ভান্ডারের উপরে নির্ভরতা থেকে আঁচ করা যায়, আর জি কর-কাণ্ডের ক্ষোভের জাল থেকে মুক্তি পেতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারও আগামী বছর বিধানসভা নির্বাচনের আগে মাসিক অনুদান বাড়ানোর কথা ভাববে।
আর জি কর-কাণ্ডের পরে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারের বিরুদ্ধে আমজনতার জমে ওঠা ক্ষোভ বেরিয়ে আসতে দেখে বিজেপি ও বামেরা উল্লসিত। দুই দলই ২০২৬-এর ভোটে ক্ষমতার স্বপ্ন দেখছে। কিন্তু তৃণমূলকে সরাতে বিজেপি যদি অন্য রাজ্যে সেই ‘রেউড়ি’-র পথই নেয়, সেটাও ধারের টাকায়, তা হলে তারা রাজ্যের মানুষকে কী নতুন দিশা দেখাবে?
না কি, এই টাকা ছড়ানোকে বিজেপি আর ‘রেউড়ি’ বলে মনে করছে না? হয়তো সেই কারণেই প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর মুখে আর রেউড়ি শব্দ শোনা যাচ্ছে না।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy