Advertisement
২৫ নভেম্বর ২০২৪
Bangladesh Cuisine

কলকাতার কন্যা, বাংলাদেশের বধূ, বাঙালি রান্না শেখাতে যান ব্যাংককে! রসনাই নয়নার আবেগ

কলকাতার বাঙালি রেস্তরাঁ মানে সেখানে বাংলাদেশি খাবার থাকাটা এক রকম দস্তুর হয়ে দাঁড়িয়েছে। শুক্তো, ঘন্ট, ডালনা, রসা, চচ্চড়ির পাশাপাশি চিতল মাছের মুইঠা, কচুপাতা বাটা চিংড়ি, ভর্তা, ইলিশ পোলাও, জর্দা পোলাও, ঢাকাই পরোটাও থাকছে মেনুতে। আর ভাল রেস্তরাঁ তাদের বাংলাদেশি মেনুকে খাঁটি বানাতে চাইলেই তলব করছে তাঁকে। তিনি নয়না আফরোজ়।

নয়না আফরোজ়।

নয়না আফরোজ়। গ্রাফিক — শৌভিক দেবনাথ।

ঐন্দ্রিলা বসু সিংহ
কলকাতা শেষ আপডেট: ২৫ নভেম্বর ২০২৪ ১১:২১
Share: Save:

কলকাতার গড়িয়াহাটের মেয়ে। বাংলাদেশের মেহেরপুরের বৌমা। সেই তিনি কিনা দিন কয়েক আগে রান্নাবান্না শিখিয়ে এলেন ব্যাংককে খাস মিশেলিন গাইড রেস্তরাঁর শেফেদের!

খাবার নিয়ে একটু বেশি খোঁজখবর রাখেন যাঁরা, তাঁরা জানেন রেস্তরাঁর নামের পাশে ‘মিশেলিন’ জুড়ে যাওয়ার মাহাত্ম্য কী! যাঁরা জানেন না, তাঁদের জন্য বলা দরকার, ‘মিশেলিন গাইড’ রেস্তেরাঁ হল তারাই, যারা খাওয়াদাওয়া সংক্রান্ত সমস্ত বিষয়ে সেরা। কোনও ‘মিশেলিন স্টার’ বা ‘মিশেলিন গাইড’ রেস্তরাঁয় বসে আপনি খাচ্ছেন মানে সেটা হতে হবে একটা ভুলতে না পারা দারুণ অভিজ্ঞতা। রান্নার পদ্ধতি হোক, স্বাদ হোক, খাওয়ার পরিবেশ হোক বা খাবারের ‘খাঁটিত্ব’— সব কিছুতেই তাদের গুণমান হবে সাধারণের থেকে অনেক উপরে। বহু বছর আগে দুনিয়ার খাদ্যপ্রেমীদের জন্য একখানা রেস্তরাঁর গাইড বই তৈরি করার কথা ভেবেছিল ফরাসি টায়ার প্রস্তুতকারী সংস্থা মিশেলিন। কালক্রমে সেই মিশেলিন গাইড বই-ই হয়ে উঠেছে খাবারের দুনিয়ার শেষ কথা। মিশেলিনের বিচারে ‘স্টার’ পাওয়া রেস্তরাঁকেই এখন মনে করা হয় বিশ্বের সেরা রেস্তরাঁ। মিশেলিনের গাইড বইয়ে নামের উল্লেখ পাওয়ার জন্য প্রতিযোগিতা চলে বিভিন্ন রেস্তরাঁর মধ্যে। খ্যাতনামা শেফ গর্ডন রামসে তো তাঁর রেস্তরাঁর মিশেলিন স্টার খোয়ানোর পর প্রকাশ্যে ভেঙেই পড়েছিলেন। আর গড়িয়াহাটের মেয়ে, মেহেরপুরের বৌমা কিনা সেই মিশেলিন রেস্তরাঁর রাঁধুনিদের রান্না শিখিয়ে এলেন! কে তিনি?

 তিনিই আপাতত খাঁটি বাংলাদেশি রান্নার ‘শেষ কথা’।

তিনিই আপাতত খাঁটি বাংলাদেশি রান্নার ‘শেষ কথা’। —নিজস্ব চিত্র।

নাম নয়না আফরোজ়। অথচ ‘প্রথাগত শেফ’ বলতে যা বোঝায়, তা তিনি নন। নিজেকে রন্ধনশিল্পী বা রান্নাবান্নার প্রগাঢ় অনুরাগী বলতে ভালবাসেন নয়না। যদিও ইদানীং বাঙালি রান্নার দুনিয়ায় তাঁকে ছাড়া মেনু সাজানোর কথাও ভাবতেই পারছে না নামী বাঙালি রেস্তরাঁগুলি। কলকাতার বাঙালি রেস্তরাঁ মানে সেখানে বাংলাদেশি মেনু থাকাটা এক রকম দস্তুর হয়ে দাঁড়িয়েছে। শুক্তো, ঘণ্ট, ডালনা, রসা, চচ্চড়ির পাশাপাশি চিতল মাছের মুইঠা, কচুপাতা বাটা চিংড়ি, ভর্তা, ইলিশ পোলাও, জর্দা পোলাও, ঢাকাই পরোটাও থাকছে মেনুতে। আর ভাল রেস্তরাঁ তাদের বাংলাদেশি মেনুকে খাঁটি বানাতে চাইলেই তলব করছে নয়নাকে। কারণ, তিনিই আপাতত খাঁটি বাংলাদেশি রান্নার ‘শেষ কথা’। ফলে শুধু কলকাতা নয়, রান্না শেখানোর তলব পেয়ে বাংলাদেশ থেকে এসে বরোদা, এমনকি বেঙ্গালুরুও ঘুরে যাচ্ছেন নয়না। কোথাও শেফদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন, তো কোথাও সাজিয়ে দিয়ে আসছেন বাংলাদেশি মেনু। অথচ এই নয়নাই খাঁটি ‘বাঙাল’ পরিবারের মেয়ে হয়েও বাংলাদেশি রান্নাবান্না তেমন জানতেন না।

বাংলাদেশে গিয়ে প্রেমে পড়ে বিয়ে করলেন। আর তার পরেই তাঁর রান্নার পাঠ শুরু।

বাংলাদেশে গিয়ে প্রেমে পড়ে বিয়ে করলেন। আর তার পরেই তাঁর রান্নার পাঠ শুরু। ছবি: ইনস্টাগ্রাম।

বাবা গোপালগঞ্জ। মা যশোরের। বাঙালদের সুনাম রান্নাবান্নায়। কিন্তু মডার্ন হাই স্কুল এবং গোখলে কলেজে পড়া গড়িয়াহাটের সেনগুপ্ত বাড়ির বড় মেয়ে নয়নার রান্নাঘরে ঢোকারই অনুমতি ছিল না। মেয়েকে একটু বেশিই আদরযত্নে রাখতেন বাবা-মা। সেই মেয়ে হঠাৎ বাংলাদেশে গিয়ে প্রেমে পড়ে বিয়ে করলেন। আর তার পরেই তাঁর রান্নার পাঠ শুরু। নয়না বলছেন, ‘‘আমার স্বামী চট্টগ্রামে থাকতেন। স্বামী অফিসে বেরিয়ে গেলে একা একাই সময় কাটত। সেই সময়ে যাঁদের বাড়িতে ভাড়া থাকতাম, তিনিই আমাকে হাতে ধরে রান্না শেখান। আমি ওঁকে খালাম্মা বলে ডাকতাম। উনিই ডেকে ডেকে রান্না শেখাতেন আমাকে।’’ সেই রান্না শিখতে শিখতেই বাংলাদেশি রান্নার প্রতি অনুরাগ নয়নার। পরে সেই অনুরাগ গাঢ় প্রেমে বদলায়। নিজের চেষ্টাতেই বাংলাদেশের নানা জেলায় ঘুরে ঘুরে রেসিপি সংগ্রহ করে আনতে শুরু করেন নয়না। এখন তাঁর সংগ্রহে বাংলাদেশের বহু প্রান্তিক অঞ্চলের অজানা রান্নার প্রণালীও রয়েছে। সেই সব রান্নার ঝাঁপি প্রয়োজন হলেই খুলে বসেন নয়না। যেমন খুলেছিলেন ২০১৪ সালে এই কলকাতাতেই।

শহুরে বাঙালির সঙ্গে বাংলাদেশি ভর্তার পরিচয় করিয়েছিলেন নয়না।

শহুরে বাঙালির সঙ্গে বাংলাদেশি ভর্তার পরিচয় করিয়েছিলেন নয়না। — নিজস্ব চিত্র।

১০ বছর আগে তখন বাংলাদেশি রান্নার সঙ্গে সবে ফেসবুকে মোলাকাত হতে শুরু করেছে এ পার বাংলার জনগণের। নয়না সেই সময়ে কলকাতায় আয়োজন করেছিলেন বাংলাদেশি ভর্তার উৎসব— ‘ভর্তা কাহন’। শহুরে বাঙালির সঙ্গে বাংলাদেশি ভর্তার পরিচয় সেখান থেকেই। চিকেন, বেগুন, আলু ভর্তার বাইরেও কত রকম ভর্তা হতে পারে, তা জেনেছিলেন কলকাতার বাঙালিরা। মুগ্ধ হয়েছিলেন বাঙালি রান্নায় বিশেষজ্ঞ শেফেরাও। পরে তাঁরা বিস্মিত হয়েছিলেন নয়নার রেসিপি সংগ্রহের পদ্ধতি জেনে। রান্নার প্রতি এমন অনুরাগ সচরাচর চোখে পড়ে না। কারণ, নয়না বাংলাদেশের জেলায় জেলায় ঘুরে ঘুরে প্রান্তিক মানুষজনের সঙ্গে কথা বলে ভরিয়েছেন তাঁর রেসিপির খাতা!

নয়না বাংলাদেশের ৬২টি জেলায় ঘুরে স্থানীয় মানুষের হেঁশেল থেকে তুলে এনেছেন খাঁটি এবং স্বাদু রান্নার প্রক্রিয়া।

নয়না বাংলাদেশের ৬২টি জেলায় ঘুরে স্থানীয় মানুষের হেঁশেল থেকে তুলে এনেছেন খাঁটি এবং স্বাদু রান্নার প্রক্রিয়া। ছবি: ইনস্টাগ্রাম।

বাংলাদেশের মোট জেলা ৬৪টি। প্রতিটি জেলা সংস্কৃতিতে, খাওয়াদাওয়ার অভ্যাসে আলাদা। নয়না তার মধ্যে ৬২টি জেলাতেই ঘুরেছেন এবং স্থানীয় মানুষের হেঁশেল থেকে তুলে এনেছেন খাঁটি এবং স্বাদু রান্নার প্রক্রিয়া। শুধু রান্নার জন্য ভ্রমণ! না। নয়না ছিলেন এক পেশাদার দোভাষী। কাজের সূত্রেই ঘুরতে হত তাঁকে। স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের হয়ে কাজ করতেন। বিদেশ থেকে যাঁরা অর্থসাহায্য পাঠাতেন, তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দিতেন প্রান্তিক মানুষজনকে। তার আগে নিজে ঘুরে ঘুরে তাঁদের সঙ্গে আলাপ করতেন। নয়না বলছেন, ‘‘যাঁদের কথা বলব, তাঁদের সঙ্গে আগে পরিচয় করতে চলে যেতাম। আর সুযোগ পেলেই ঢুকতাম ওঁদের রান্নাঘরে। ওঁরাও দেখতাম ব্যাপারটা পছন্দই করত। নতুন খাবার দেখলেই রেসিপি জেনে খাতায় লিখে নিতাম।’’ সেই পরিশ্রমেরই সুফল পাচ্ছেন বাংলাদেশি পদের ভক্তেরা। সুফল পাচ্ছে বাঙালি রেস্তরাঁগুলিও।

অ্যাস্টরে চলছে রন্ধনশিল্পী নয়না আফরোজ়ের ভাবনায় অনুপ্রাণিত খাদ্যোৎসব।

অ্যাস্টরে চলছে রন্ধনশিল্পী নয়না আফরোজ়ের ভাবনায় অনুপ্রাণিত খাদ্যোৎসব। — নিজস্ব চিত্র

দিন কয়েক আগেই যেমন নয়না এসেছেন কলকাতার অ্যাস্টর হোটেলের বাংলাদেশি খাবারের একটি উৎসবের মেনু সাজিয়ে দিতে। ২২ নভেম্বর থেকে ১ ডিসেম্বর— ন’ দিন ধরে ধরে চলবে উৎসব। নয়না রেস্তরাঁর এগ্‌জ়িকিউটিভ শেফকে সঙ্গে নিয়ে তাঁর হেঁশেলেই বানালেন ঢাকাই পরোটা, বাংলাদেশি বিয়েবাড়ি পোলাও, চিংড়ি মাছের পাটোরা, চোইখোল মটন, বিটের হালুয়া। তাঁর দেওয়া রেসিপি বানানোর তদারকিও করলেন। তাঁকে প্রশ্ন করা গেল, বাংলাদেশের এখনও এই পরিস্থিতি। এর মধ্যে ঢাকা থেকে কলকাতায় আসতে অসুবিধা হচ্ছে না? শুনে নয়না বললেন, ‘‘অসুবিধা এখনও হচ্ছে না। যদিও বাংলাদেশের পরিস্থিতি এখনও বেশ তপ্ত। মানুষজন খুব দরকার ছাড়া বাইরে বেরোচ্ছেন না। ঘুরতে যাওয়া, বা কথায় কথায় রেস্তরাঁয় খেতে যাওয়া কমে গিয়েছে অনেক। খেতে ইচ্ছে করলে বাড়িতেই আনিয়ে নিচ্ছেন বেশির ভাগ মানুষজন। তবে কাজের সূত্রে আমাকে প্রায়ই ভারতে আসতে হয়। অন্য দেশেও যেতে হয়। এই তো কিছু দিন আগে বেঙ্গালুরুতে বাংলাদেশি খাবারের একটা উৎসব করে এলাম। কিছু দিন আগে ব্যাংককেও গিয়েছিলাম। এখনও তেমন অসুবিধা হচ্ছে না।’’

অ্যাস্টর হোটেলে বাংলাদেশি খাদ্যোৎসবে নয়নার সাজানো মেনু।

অ্যাস্টর হোটেলে বাংলাদেশি খাদ্যোৎসবে নয়নার সাজানো মেনু। — নিজস্ব চিত্র

ব্যাংককে কী জন্য গিয়েছিলেন প্রশ্ন করতেই জানা গেল নয়নার মিশেলিন গাইড রেস্তরাঁয় রান্না শেখানোর কথা। নয়নাই বললেন, ‘‘আমাকে ওঁরা আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন রান্নার একটা অনুষ্ঠানে। ওখানে যাওয়ার পর ওদের প্রধান শেফ আমার সঙ্গে খাঁটি বাংলাদেশি মেনু নিয়ে কথা বলতে শুরু করলেন। আমিও ওঁদের আমার জানা খাঁটি বাংলাদেশি খাবারের কথা শোনালাম। শুনে তিনি তো অভিভূত। আমাকে বললেন, ‘আপনি প্লিজ় আমাদের রান্নাঘরে আসুন আর আমার শেফদের একটা ক্লাস নিন।’ আমার তো রান্না করতে ভালই লাগে। আমিও ওদের চিকেন তেহারি, বেগুন-টম্যাটোর ভর্তা, দই ভেটকি এই সব শিখিয়ে দিয়ে এলাম। ওঁরা পরের বছর আমার কাছে একটা রান্নার প্রশিক্ষণ নেওয়ার কথাও বলেছে।’’ নয়না যে রেস্তরাঁর কথা বলছেন, সেটি ব্যাংককের একটি ভারতীয় রেস্তরাঁ। তারা ভারতীয় উপকূল এলাকার রান্নাবান্নার বিশারদ। তবে এর পরে সেখানে গেলে হয়তো কলকাতার মেয়ের শেখানো পদও পাতে পাবেন খাদ্যরসিকেরা। নয়নাকে প্রশ্নটা করতে তিনি বললেন, ‘‘সে আমি জানি না! তবে আমার কাছে রান্নার প্রতি এই আবেগ আর ভালবাসাটুকুই আসল। ওটার জন্যই সব কিছু।’’

অন্য বিষয়গুলি:

Bangladesh Cuisine
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy