পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা নির্বাচনের ফল প্রকাশের পরে দু’মাস অতিক্রান্ত। সিপিআইএম এখনও নিজেদের ব্যর্থতার পর্যালোচনা চালিয়ে যাচ্ছে। শুধু দলের অন্দরমহলে নয়, বৃহত্তর সমাজেও পার্টির নির্বাচনী অবস্থান ও প্রচার সম্পর্কে যে সব আপত্তি শোনা গেছে, দলনেতারা গত দু’মাসে ক্রমশ তার গুরুত্বকে স্বীকার করেছেন, তাঁদের আত্মসমালোচনার সুর ক্রমশ স্পষ্ট হয়েছে। গত সপ্তাহে দলের রাজ্য সম্পাদক সূর্যকান্ত মিশ্র সমাজমাধ্যম মারফত যে বক্তব্য পেশ করেছেন, তা এক অর্থে সেই আত্মসমালোচনার বিশদ এবং সম্পূর্ণ বয়ান। নতুন করে ভাবার এই উদ্যোগ গণতান্ত্রিক রাজনীতির পক্ষে সুলক্ষণ।
প্রশ্ন উঠতে পারে, যাদের ভোটের হার পাঁচ শতাংশের নীচে, আসন শূন্য, তাদের আত্মবিশ্লেষণ নিয়ে আদৌ মাথা ঘামাব কেন? রাজনীতি এবং গণতন্ত্রকে নির্বাচনের সঙ্গে সমার্থক মনে করলে এই প্রশ্ন তোলাই স্বাভাবিক। অধুনা তেমন সমীকরণের দাপট প্রবল। এই মানসিকতাও সংখ্যাগুরুবাদের একটি রূপ, যা সিংহনাদে ঘোষণা করে: ভোটে হেরে গেছ, ঘরে ঢুকে বসে থাকো, স্পিকটি নট। এবং শুধু সেই কারণেই, গণতন্ত্রের স্বার্থেই এই সংখ্যার দাপটকে অমান্য করে ভোটলব্ধ ‘বাইনারি’র বাইরে দাঁড়িয়ে ভাবা দরকার। কিন্তু সেটা একটা দিক মাত্র। সিপিআইএমের আত্মসমীক্ষার প্রকৃত তাৎপর্য এখানেই যে, তা পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নকে সামনে এনেছে। কী সেই প্রশ্ন?
নিজেদের নানা ভ্রান্তির কথা স্বীকার করেছেন দলনেতারা। তার একটি হল: রাজ্য সরকারের ‘জনমোহিনী’ প্রকল্পগুলির জনপ্রিয়তা বুঝতে তাঁদের ভুল হয়েছে, এটা তাঁদের প্রতি সাধারণ মানুষের বিরূপ হওয়ার একটা কারণ। এই মূল্যায়ন অসঙ্গত নয়। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পপুলিস্ট বা জনবাদী রাজনীতির ইমারতটি নানা বর্গের মানুষকে নানা ভাবে সাহায্য করার রকমারি প্রকল্প দিয়েই তৈরি, এবং সেই ইমারতে ক্রমাগত নতুন নতুন প্রকল্প জুড়ে চলেছে তাঁর সরকার। কোন প্রকল্প কতটা যুক্তিযুক্ত, প্রতিশ্রুতি আর প্রাপ্তির মধ্যে ফারাক কত দূর, সরকার কত দিন সেগুলি চালাতে পারবে, তাদের খরচ মেটাতে গিয়ে অন্য নানা জরুরি বরাদ্দে কী হারে কাটছাঁট করতে হচ্ছে, তাতে রাজ্যের অর্থনীতির কতখানি ক্ষতি— এই সমস্ত প্রশ্নই যুক্তিযুক্ত। কিন্তু জনবাদ অঙ্ক কষে চলে না, জনপ্রিয়তার পিঠে সওয়ার হয়ে ঘোড়া ছুটিয়ে দেয়, তার পর ছোটাতেই থাকে, থামবার উপায় নেই তার। পশ্চিমবঙ্গের বহু মানুষ মনে করেছেন, ঘোড়া ছুটছে, অন্তত আপাতত। সিপিআইএম সেটা বুঝতে পারেনি।
সম্ভবত না-বোঝার একটা গূঢ় কারণ আছে। কেতাবি বামপন্থার বেঁধে দেওয়া কাঠামোর বাইরে গিয়ে চিন্তাভাবনা করা এই দলের স্বধর্ম নয়। পশ্চিমবঙ্গে রাজ্যপাট চালানোর সুদীর্ঘ পর্বে জনপ্রিয়তার রাজনীতি তারাও কব্জি ডুবিয়ে অনুশীলন করেছে, কিন্তু সেই রাজনীতিকেও তারা বরাবর ওই কাঠামোয় ফেলেই দেখতে অভ্যস্ত। যেমন, নবীন বামফ্রন্ট সরকার যখন এ-রাজ্যে বেকার ভাতা চালু করে, তাদের কাছে সেটা ছিল নিছক ‘রিলিফ’, তার বেশি কিছু নয়, তাদের আর্থিক নীতির পূর্বনির্ধারিত কাঠামোয় সেই সাময়িক ত্রাণের কোনও স্থান ছিল না। একে এক আনা, ওকে দু’আনা, তাকে দু’পয়সা— এই বিতরণী জনবাদকেই সরকারি নীতি বলে চিনে নেওয়া এ-দলের পক্ষে কঠিন বইকি।
সমস্যা কেবল চিনে নেওয়ার নয়। কী ভাবে জনবাদের মোকাবিলা করা হবে, সমস্যা তা নিয়েও। এ বিষয়ে দলের রাজ্য সম্পাদক জানিয়েছেন, “আমরা শ্রেণির পার্টি, শ্রেণি সংগ্রামকে তীব্র করাই আমাদের চ্যালেঞ্জ।” তাঁদের সদিচ্ছা নিয়ে সন্দেহ করি না, কিন্তু ইচ্ছা থাকলেই কি উপায় হয়? মনে রাখতে হবে, গত এক দশকে এ-রাজ্যের শাসকরা নানা প্রকল্প, কর্মসূচি, পরিষদ ইত্যাদির মাধ্যমে নানা জনগোষ্ঠীর সমর্থন অর্জনে তৎপর হয়েছেন। সেই চেষ্টা সর্বদা সফল হয়নি, অনেক সময় সাফল্য স্থায়ী হয়নি, কিন্তু চেষ্টা জারি থেকেছে। এই বহুরূপী সতত সঞ্চরমাণ জনবাদের সহস্রধারা যে ভাবে তৃণমূল অবধি পৌঁছে গেছে, তার মোকাবিলায় শ্রেণি-রাজনীতির পুরনো ধারণাটি কত দূর কাজে লাগবে? সে-ধারণাকে কিছুটা প্রসারিত করার প্রয়োজন হয়তো দলনেতারা বুঝেছেন, কিন্তু তাঁরা এটাও পরিষ্কার করে দিয়েছেন যে, ‘গরিব আদিবাসী, তফসিলি, সংখ্যালঘু’ ইত্যাদি বিভিন্ন বর্গকে তাঁরা শ্রেণি-কাঠামোর অঙ্গ হিসেবেই দেখেন। অর্থাৎ, শ্রেণির কাঠামোটি প্রসারিত হতে পারে, কিন্তু সেটিকে আগে থেকে নির্দিষ্ট করে নিতে হবে, এবং সমস্ত ধারণা ও নীতিকে তার মধ্যে বসাতে হবে। অর্থাৎ কিনা— কাঠামো আগে, তার পরে ‘কী করিতে হইবে’। জনবাদী রাজনীতি চলে উল্টো বাগে। চলতে চলতে সে লহমায় নতুন বাঁক নেয়, নতুন রাস্তা ধরে, দরকার হলে উল্টো রাস্তা ধরতেও সে দ্বিধা বোধ করে না। এই ভাবে পথ চলার কথা বামপন্থী কেতাবে লেখা নেই।
এখানেই আসল প্রশ্নটা ওঠে। ব্যাখ্যা তো অনেক হল, নিজেদের পাল্টানোর কী ব্যবস্থা হবে? রাজ্য সম্পাদক বলেছেন নীচের স্তর থেকে শক্তিশালী সংগঠন তৈরি করে শ্রেণি ও গণআন্দোলন গড়ে তোলার কথা। সেটা অবশ্যই জরুরি। শাসকের অন্যায়, নিপীড়ন এবং দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ, তাদের প্রতিশ্রুতি পূরণের দাবি তোলা, সেই বিষয়ে মানুষকে সচেতন ও সংগঠিত করা— এ-সব গণতান্ত্রিক রাজনীতির একেবারে আটপৌরে দায়িত্ব। কিন্তু জনবাদী শাসনতন্ত্রের জবাব তৈরি করতে চাইলে শুধু এই দৈনন্দিন দায়িত্ব পালন করলেই চলবে না, রাজনীতির একটা প্রতিস্পর্ধী ধারণা নির্মাণ করতে হবে বামপন্থীদের, যে ধারণা তাঁদের মূল নীতি ও আদর্শের অনুসারী, একই সঙ্গে যা রাজ্যের বাস্তবকে স্বীকার করে তার ভিতর থেকেই নিজেকে গড়ে তোলার রসদ সংগ্রহ করতে পারে।
এই রাজনীতির ভিত্তিতে যে ধারণাটিকে রাখা দরকার, তার নাম অধিকার। পশ্চিমবঙ্গের শাসকদের জনবাদী রাজনীতি সেই অধিকারের সামাজিক বোধটিকে অনেকখানি দুর্বল করে দিয়েছে। বিভিন্ন বর্গের লোকের জন্য নতুন নতুন প্রকল্প ঘোষণা করার সঙ্গে সঙ্গে তাঁরা ক্রমাগত বলে চলেছেন, “সব তো দিয়েছি, সবাইকে দিয়েছি, আর কত দেব?” পাইয়ে দেওয়ার রাজনীতি তাঁরা শুরু করেননি, ‘সরকার মা-বাপ’ কথাটাও আজকের নয়, কিন্তু রাজনীতির জনবাদী তৎপরতার পাশাপাশি তার ভাষা ও ভঙ্গিকে তাঁরা এক অভূতপূর্ব মাত্রা দিয়েছেন। এবং জনসমাজের চিন্তায় তার একটা বড় রকমের প্রভাব পড়েছে। এক তরুণ সহনাগরিক সম্প্রতি তাঁর একটি অভিজ্ঞতার কথা শোনালেন। মফস্সলে থাকেন তিনি। কোভিডে আক্রান্ত তাঁর এক প্রতিবেশীকে চিকিৎসার জন্য কলকাতায় নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে সেই প্রবীণা সরকারি হাসপাতালের প্রভূত প্রশংসা করেন, যেমন প্রশংসা আমরা গত কয়েক মাসে অনেক শুনেছি, শুনে ভরসা পেয়েছি। কিন্তু তার সঙ্গে সঙ্গে তিনি বলেন, “সরকার আর কত করবে? এত ব্যবস্থা, এত খরচ, আমাদেরও তো কিছু দেওয়া উচিত।” শুনে গা ছমছম করে উঠল, কারণ ওই প্রবীণা তো শাসকদের কথারই প্রতিধ্বনি করছেন! তাঁকে বিচ্ছিন্ন ব্যতিক্রম মনে করার কারণ দেখি না, বহু লোকের মনেই ক্রমশ এই ধারণা জোরদার হয়েছে যে, সরকারের সঙ্গে তাঁদের সম্পর্কটা দাতা আর গ্রহীতার। জনচেতনায় শাসকের চিন্তার এই আধিপত্য ভাঙতে না পারলে রাজনৈতিক প্রতিস্পর্ধা গড়ে তোলা সম্ভব নয়।
অতএব, অধিকারের ধারণাটিকে নাগরিকের চেতনায় ফিরিয়ে আনাই এখন একটি বড় কাজ। কেবল শ্রেণি-অধিকার নয়, শ্রমজীবী মানুষের বিভিন্ন অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অধিকার, যা জাস্টিস বা ন্যায্যতার ধারণার উপরে প্রতিষ্ঠিত। সেই ন্যায্যতার দাবিকে হয়তো অনেক সময়েই সরাসরি শ্রেণি-কাঠামোর মধ্যে— ‘প্রসারিত’ শ্রেণি-কাঠামোর মধ্যেও— ধরানো যাবে না। এই কারণেই নানা ধরনের সামাজিক আন্দোলনের সঙ্গে বামপন্থী রাজনীতির সংযোগ তৈরি করা জরুরি। আগে কাঠামো পরে রাজনীতি— এই ছক ভেঙে, শ্রেণি এবং শ্রমিক-এর পুরনো ধারণাকে অতিক্রম করে সমস্ত বর্গের শ্রমজীবী মানুষের বিভিন্ন অধিকারের বহুমাত্রিক দাবির সঙ্গে নিজেকে মেলানোর মধ্যে দিয়েই বামপন্থী রাজনীতির নবনির্মাণ হতে পারে।
তবে তার জন্য নির্মাতাদের অনেক বেশি সহিষ্ণু হতে হবে, মুষ্টিবদ্ধ হাত আকাশে ছুড়ে দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই মুঠো খুলে হাতটিকে অনেক দূর অবধি প্রসারিত করতে হবে, সংগ্রামী স্লোগান উচ্চারণের পাশাপাশি অপরের কথা শোনার জন্য কান পেতে রাখতে হবে। এটাই এখন কাজ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy