গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ
অগস্ট মাস। ১৯৪৭ সাল। প্রায় ২০০ বছরের শাসন, দুঃশাসন, অপশাসনের পর ভারতবর্ষের মাটি থেকে পাততাড়ি গোটাতে বাধ্য হয়েছিল ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ শক্তি। তবে যাওয়ার আগে শেষ ছোবলটি দিয়ে গিয়েছিল তারা। কিংবদন্তির ভারতভূমিকে দুই ভাগ, মতান্তরে তিন ভাগ করে দিয়ে। যার অধিকাংশ অধিবাসীই তাকে তখন ভুল করে ‘স্বাধীনতা’ বলেই ভেবেছিলেন। ১৪ তারিখ জন্ম নিল স্বাধীন পাকিস্তান রাষ্ট্র। আর তার পরের দিন ১৫ তারিখ অভ্যুদয় ঘটল স্বাধীন ভারত রাষ্ট্রের। এর ঠিক ২৮ বছর বাদে, ১৯৭৫ সালের অগস্ট মাসের এই দুই নিয়তিতাড়িত দিন, ১৪ এবং ১৫ তারিখের একেবারে ছেদনরেখাটি ধরেই যেন ঘটে গেল ইতিহাসের অন্যতম নৃশংস, বর্বর ও বেদনাদায়ক হত্যাকাণ্ডটি। স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্নদ্রষ্টা ও স্থপতি শেখ মুজিবর রহমান, বাংলার মানুষ যাঁকে আদর করে ‘বঙ্গবন্ধু’ ডাকতেই পছন্দ করে বেশি, একযোগে, একবারে সপরিবার, মানে শিশুপুত্র ও অন্তঃসত্ত্বা পুত্রবধূ-সহ নিহত হলেন বাঙালি ও বাংলাদেশ বিরোধী প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠীর হাতে। সেই পৈশাচিক হত্যাযজ্ঞের ঐতিহাসিক তারিখটি হতে পারে নিছক কাকতালীয়। কিন্তু আমার ব্যক্তিগত বিশ্বাস, এই দিনটিকে বেছে নেওয়ার মাধ্যমে হত্যাকারীরা একটি বিশেষ বার্তা পৌঁছে দিতে চেয়েছিল বাংলাদেশ ও বাঙালির শত্রু-মিত্র দু’পক্ষের কাছেই।
আমি তখন একটি নিশ্ছিদ্র দেওয়াল ঘেরা আধাসামরিক, আবাসিক বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির ছাত্র। দিনের শুরুতেই এ রকম একটি অপ্রত্যাশিত, অকল্পনীয় দুঃসংবাদে হতচকিত, বিহ্বল হয়ে পড়েছিলাম আমরাও। আর সকলেরই মতো। তবে এর বৃহত্তর ভূরাজনৈতিক প্রেক্ষাপট ও পরিণামটুকু বুঝে ওঠার মতো মানসিক পরিপক্বতা তখন আমাদের ছিল না। এর আগে এমন নির্বিচার হত্যা ও মৃত্যুর মিছিল দেখেছিলাম ১৯৭১-এ। যার অন্যতম বলি হয়েছিলেন এক অতি প্রিয়জন— আমার আপন কনিষ্ঠ মাতুল। কিন্তু সেটা তো ছিল একটি পরাধীন দেশের স্বাধীনতার জন্য লড়াই ও আত্মত্যাগের অংশ। একটি স্বাধীন দেশে সেই দেশেরই কিছু মানুষ খোদ তার স্বাধীনতার প্রবক্তা ও জাতির পিতাকে কী করে এমন নির্মম ও ন্যাক্কারজনক ভাবে সবংশে খুন করে ফেলতে পারে? সেটা কিছুতেই বুঝতে পারছিলাম না আমরা। পরে আরও একটু সাবালক হয়ে ইতিহাস, রাজনীতির কিছু বইপত্র পড়ে আর দেশের আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক গতিধারা গভীর ভাবে পর্যবেক্ষণ করে বুঝতে আর বাকি থাকে না যে, সেই অভাবিতপূর্ব হত্যাকাণ্ডটি ছিল এক বৃহৎ, বৈশ্বিক ষড়যন্ত্রেরই ফল। সেটি আর কিছুই নয়। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের পরাজিত শক্তির প্রতিহিংসা ও প্রতিশোধপরায়ণতাকে কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশ নামক একটি আধুনিক, অসাম্প্রদায়িক ও প্রগতিশীল রাষ্ট্রের সম্ভাব্য উত্থানকে চিরতরে থামিয়ে দেওয়া।
এখন এই ২০২১ সালে দাঁড়িয়ে আমাদের মনে করার কোনও কারণ নেই যে, সেই ষড়যন্ত্র একেবারে থেমে গিয়েছে বা ষড়যন্ত্রকারীদের সম্পূর্ণ বিনাশ ঘটেছে। বাংলাদেশে দীর্ঘ ১৫ বছরের সেনা ও স্বৈরশাসনের পর নয়ের দশকের গোড়া থেকে গণতন্ত্রের সু-বাতাস পুনরায় বইতে শুরু করলেও তার ভিত্তিটুকু পুরোপুরি পোক্ত ও প্রতিষ্ঠিত হওয়ার আগেই ফের শুরু হয়ে যায় দেশি ও বিদেশি নানাবিধ ষড়যন্ত্রের জাল বোনা। কখনও ঘোষিত বিরাজনীতিকরণের মন্ত্রণা, কখনও জাতীয় অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে সরাসরি বৈদেশিক হস্তক্ষেপ আবার কখনও বা ধর্মান্ধ উগ্রবাদী গোষ্ঠীর সহিংস রাজনীতির নগ্ন চেহারায় প্রকাশিত হতে দেখেছি আমরা এই সব ষড়যন্ত্রের হিংস্র নখদন্তরাজিকে। ফলত, স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পরে এখনও বঙ্গবন্ধুর দেখা সেই সোনার বাংলার স্বপ্নটুকু অধরাই রয়ে গিয়েছে আমাদের কাছে। কিছু কিছু অর্থনৈতিক ও সামাজিক নিক্তিতে বাংলাদেশ অনেকটাই এগিয়েছে সন্দেহ নেই। কিন্তু বঙ্গবন্ধু নিজে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির চেতনায় জারিত যে গণতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ, অসাম্প্রদায়িক ও বৈষম্যহীন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেছিলেন সারাজীবন, তা কি ক্রমশ দূরে সরে যাচ্ছে?
বিগত বছরগুলোয় প্রকাশিত বঙ্গবন্ধু রচিত তিনটি গ্রন্থ ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’, ‘কারাগারের রোজনামচা’ ও ‘আমার দেখা নয়া চীন’ পাঠ করে তাঁর প্রগতিশীল ও অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক ধ্যানধারণার যে-পরিচয়টুকু আমরা পাই, সেই সঙ্গে তাঁর আজন্মলালিত স্বপ্ন ও সাধনার যে-বাংলাদেশ, তার ছবিটিও আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে। তখনই আমরা বুঝতে পারি, ১৯৭৫ সালের ১৫ অগস্টের মধ্যরাতে সেই হন্তারক অপশক্তি শুধু একজন মানুষ নয়, একজন রাষ্ট্রনেতা নয়, তাঁর আজীবনের স্বপ্নটিকেই হত্যা করতে তৎপর হয়েছিল। তৎকালীন আর পাঁচটি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশের বিপরীতে বাংলাদেশ যে একটি আধুনিক, ধর্মনিরপেক্ষ, সভ্য ও সুসংস্কৃত রাষ্ট্র হিসাবে বিশ্বের মানচিত্রে দৃষ্টান্তমূলক অবস্থান তৈরি করে নিতে চেয়েছিল, তাঁর সেই আকাঙ্খার চারাটিকে তারা অঙ্কুরেই বিনষ্ট করে দিতে বদ্ধপরিকর ছিল। তাদের সেই সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনায় তারা কি সফল হয়েছিল? আমাদের রাষ্ট্র ও সমাজের সর্বত্র রক্ষণশীলতা, ধর্মান্ধতা, উগ্রবাদ, অশিক্ষা, অসহিষ্ণুতা, বিজ্ঞানবিরোধিতা, নারীবিদ্বেষ ইত্যাকার পশ্চাৎপদ চিন্তার প্রকোপ বাড়ছে। শুধু বাংলাদেশই বা কেন? ভারত, পাকিস্তান, নেপাল, শ্রীলঙ্কা, মায়ানমার— কোথায় নেই এহেন পশ্চাৎপদতা ও রক্ষণশীলতার রমরমা, ধর্মরক্ষার নামে হৃদয়হীন হিংসা ও হানাহানি, কুসংস্কার ও কুশিক্ষার জয়জয়কার? আফগানিস্তানে আবারও মধ্যযুগীয় তালিবান শাসনের হাতছানি কিসের বার্তা দিচ্ছে আমাদের?
বার্তাটি এই যে, বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য যে মূলমন্ত্র সমূহের ওপর আস্থা রেখেছিলেন, সে সবের অন্তত তিনটি স্তম্ভ— গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার সত্যিই এখনও কোনও বিকল্প নেই। শুধু বাংলাদেশের জন্য নয়, উপমহাদেশের প্রতিটি দেশের জন্যই তা কমবেশি প্রযোজ্য। আমরা যদি সত্যি একটি শান্তিপূর্ণ, সম্প্রীতিময়, সমৃদ্ধ সমাজ গড়তে চাই, তা হলে অবশ্যই পরিবার থেকে রাষ্ট্রের প্রতিটি স্তরে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও পরমতসহিষ্ণুতার চর্চাকে গুরুত্ব দিতে হবে। সম্পদের সুষম বণ্টন তথা সামাজিক ন্যায়বিচার ও বৈষম্য দূরীকরণ নিশ্চিত এবং সর্বোপরি সংগঠিত ধর্মচর্চাকে যথাসম্ভব ব্যক্তিগত পরিসরে সীমাবদ্ধ রেখে সমাজের বৃহত্তর পরিমণ্ডলে সাম্প্রদায়িক ও শ্রেণিগত সম্প্রীতির বাতাবরণ প্রতিষ্ঠা করতে হবে। এক কথায়, ১৯৭৫-এর ১৫ অগস্টে বঙ্গবন্ধুকে সশরীর হত্যা করার নামে ঘাতকেরা তাঁর যে মহতী স্বপ্নটিকেই আসলে খুন করেছিল; একটি সত্যিকারের গণতান্ত্রিক, সম্প্রীতিময়, বৈষম্যরহিত পৃথিবী গড়ার তাঁর সেই আজন্মলালিত স্বপ্নটিকে আমাদের প্রত্যেকের নিজস্ব স্বপ্ন হিসেবেই গ্রহণ ও লালন করে যেতে হবে আজীবন। নইলে, যে অন্ধকারের জীব, সে-রাতের সেই ঘৃণিত ঘাতকেরাই জিতে যাবে শেষে।
(লেখক অনুবাদক ও শিল্পসংগঠক। মতামত একান্ত ব্যক্তিগত)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy