Advertisement
২৩ নভেম্বর ২০২৪
কত নিদ্রা যাবে তুমি
BJP

সুপ্ত, ব্যক্তিগত ফ্যাসিবাদের মোকাবিলায় শিল্পীর বড় কাজ আছে

পশ্চিমবঙ্গে এসে বিজেপির সাম্প্রদায়িক ও বিভেদকামী রথ যে মুখ থুবড়ে পড়েছে, সেটা দেশ-রাজনীতির প্রশ্নে একটি বড় ঘটনা।

সুমন মুখোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ১৯ জুন ২০২১ ০৫:৫১
Share: Save:

সময়টাকে কামড়ে ধরো, বাঘ যেভাবে শিকার ধরে

–কবীর সুমন

বার্ডস আই ভিউ’ বা উড়ন্ত পাখির দৃষ্টি থেকে গঙ্গাতীরবর্তী সাদা বালির উপর পড়ে থাকা যে জ্বলন্ত, অর্ধদগ্ধ বা জ্বলে যাওয়া শয়ে শয়ে মৃতদেহের ছবিগুলো এখনও চোখের সামনে নিরন্তর ভাসছে, আমাদের অবসাদগ্রস্ত করছে, মনে জাগিয়ে তুলছে এক ভয়ার্ত হাহাকার, সেগুলি দেখে মনে পড়ে যাচ্ছে সোমনাথ হোরের ‘উন্ডস’ বা ‘ক্ষত’ চিত্রাবলি। নিজের হাতে তৈরি পেপার পাল্পের সাদা কাগজের উপর নানা ক্ষতের চিহ্ন। আবার কিছু কিছু ক্ষেত্রে কাগজের উপর গেঁথে থাকা চিরস্থায়ী ক্ষতের স্থাপত্যের উপর লাল রঙের হালকা ছোঁয়া। এই সব ক্ষত সময়ের অভিঘাতে আমাদের ব্যক্তিগত শরীরে, দেশের শরীরে, গভীর অবচেতনে খোদাই হয়ে যাওয়া এক অবিচ্ছেদ্য স্মৃতিসঙ্কেত। বাবরি মসজিদ ধ্বংস, গুজরাতের দাঙ্গা, এনআরসি, সিএএ, কাশ্মীরে ৩৭০ রদ, কৃষি আইন— ক্রমাগত কণ্ডূয়নে সেই ক্ষত আজ হয়ে উঠেছে আমাদের গায়ে দগদগে ঘা। সমাজ-রাজনীতির অনুষঙ্গে আমাদের সময়কাল একাধিক দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত। এক দিকে কোভিড অতিমারি, অন্য দিকে অশুভ ক্ষমতাতন্ত্র কখনও হাস্যমুখে, কখনও ছলছলে চোখে নির্লজ্জ মিথ্যাচারের এক ভয়ঙ্কর দৃষ্টান্ত স্থাপন করছে।

সোমনাথবাবুর মতো এক জন শিল্পীকে নিয়ে কথা শুরুর অবকাশ যখন পাওয়া গেল, তখন একটু ফিরে দেখা যাক তাঁর কাজের ইতিহাস। তিনি তেতাল্লিশের মন্বন্তর এবং ছেচল্লিশের তেভাগা আন্দোলনের চিত্রভাষ্যকার। চিত্তপ্রসাদ ভট্টাচার্যের পাশাপাশি সোমনাথ হোর রেখে গিয়েছেন সমকালীন বাস্তবের এক অমূল্য চিত্রবয়ান। অনেক দৃষ্টিভঙ্গিতেই অমূল্য— ইতিহাসের দিক থেকে, চিত্রকলার ভাষার দিক থেকে এবং সময়ের প্রতি শিল্পীর দায়বদ্ধতা ও দায়িত্বের প্রশ্নে। বাংলার ইতিহাসের দু’টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তকে চিত্রনথিতে বিন্যস্ত করে সোমনাথ হোর নিজের শৈল্পিক দায়বদ্ধতার ও দায়িত্বের যেমন এক ধারাবাহিক অভিজ্ঞান নির্মাণ করেছেন, যুগপৎ ওঁর প্রকাশের মাধ্যমকেও দিয়েছেন এক রাজনৈতিক মাত্রা এবং চিত্রভাষকে দিয়েছেন নতুন স্বর। দায়বদ্ধতার আবেগটি শিল্পমানের উৎকর্ষ ছুঁতে না পারলে তা নেহাতই প্রচারমূলক বা ‘প্রোপাগান্ডা’ হয়ে যায়। দায়বদ্ধ শিল্পী মানেই তাঁর কীর্তি শিল্পগ্রাহ্য নয়। শিল্পীর দায়বদ্ধতা আর দায়িত্বের প্রসঙ্গটি নিয়ে তর্কবিতর্কের শেষ নেই। এই বিতর্কের নিরসন সহজে হবে না। কিন্তু আজ দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে যে অশনিসঙ্কেত ঘনীভূত হয়েছে, তা যেন এক সর্বগ্রাসী আকালে পরিণত না হয়, সেই সূত্রেই এ বিষয়টি নিয়ে নতুন করে আলোচনা হবে। কারণ, এই সামাজিক ও রাজনৈতিক অবনমন আটকাতে এবং ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে শিল্পীদের গুরুত্বপূর্ণ একটা ভূমিকা আছে। অন্তত পৃথিবীর ইতিহাস সেই সাক্ষ্য দেয়।

পশ্চিমবঙ্গে এসে বিজেপির সাম্প্রদায়িক ও বিভেদকামী রথ যে মুখ থুবড়ে পড়েছে, সেটা দেশ-রাজনীতির প্রশ্নে একটি বড় ঘটনা। কিন্তু এখানে থেমে গেলে চলবে না। আত্মতৃপ্তির কোনও অবকাশ নেই। রন্ধ্রে রন্ধ্রে পুঁতে দেওয়া হচ্ছে ঘৃণার বীজ, সাম্প্রদায়িকতার আফিম। নির্বাচনের মধ্যেই বাংলা মঞ্চে দু’টি নতুন নাটক মঞ্চস্থ হয়েছে— কৌশিক সেনের নির্দেশনায় কবির বন্ধুরা এবং আমার মেফিস্টো। দু’টি নাটকই বলতে চেয়েছে যে, স্বৈরতন্ত্রকে এক ইঞ্চি জমি ছাড়া যাবে না। বলতে হবে অন্তত আর দু’টি উদ্যোগের কথাও— ‘নো ভোট টু বিজেপি’ প্রচার এবং ‘আমরা এই দেশেতেই থাকব’ সঙ্গীত-ভিডিয়ো। এই সময়ে নিশ্চয়ই আরও অনেক শিল্পী স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে কাজ করেছেন নিজের নিজের মাধ্যমে।

এই সবের প্রভাব জনমানসে কতটা পড়েছে বলা মুশকিল, হয়তো শুধু শহরের মানুষদের একটা নির্দিষ্ট অংশই দেখেছেন এগুলি। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, শহরের শিক্ষিত শ্রেণির ভিতরে ভিতরে এক গোপন ও ব্যক্তিগত ফ্যাসিবাদ দানা বেঁধেছে। সেই শ্রেণির সঙ্গে কথা বলাটাও অত্যন্ত জরুরি। এবং তার পরে বৃহত্তর ক্ষেত্রে ছড়িয়ে পড়া। কিন্তু এই মুহূর্তে একটা বড় পরিসরে যেতে পারছি না বলে হাহুতাশ করে হাত গুটিয়ে বসে থাকলে তো শিল্পীর চলে না। যে ভূমি অবিলম্বে পাওয়া যাচ্ছে সেখানেই সাধ্যমতো কাজ করে যেতে হবে। ১৯৬০ সালের প্যারিসে জঁ পল সার্ত্রের পত্রিকা মডার্ন টাইমস পনেরো বছর চলার পর বিক্রি ছিল মাত্র কুড়ি হাজার। একটা সময় শৈল্পিক কাজ ছড়িয়ে দেওয়ার একটা বড় অবলম্বন ছিল রাজনৈতিক দল। মূলত একটা সময়ের কমিউনিস্ট পার্টি।

দুর্ভাগ্যের বিষয়, আজকের পশ্চিমবঙ্গে সেই পার্টিকেই শূন্যগর্ভে পড়ে ভাবতে হচ্ছে কী ভাবে নিজেদের অস্তিত্ব বাঁচিয়ে রাখা যায়। যদিও শিল্পীদের সঙ্গে কমিউনিস্ট পার্টির বিরোধের ইতিহাসও ভীতিপ্রদ। কিন্তু তৎসত্ত্বেও এই প্রশ্ন কখনও পিছু ছাড়ে না— কী ভাবে শিল্পী তাঁর কাজকে আরও বৃহত্তর ক্ষেত্রে বিন্যস্ত করতে পারবেন, কবিতা, গান, চলচ্চিত্র, নাটক, ছবি দিয়ে গড়ে উঠবে ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে এক দুর্ভেদ্য ব্যারিকেড এবং সব মাধ্যমের শিল্পীদের মধ্যে একটি সমন্বয়ক্ষেত্র জন্ম নেবে। নোম চমস্কি তাঁর ষাটের দশকে লেখা প্রবন্ধে আলোচনা করেছেন ‘বুদ্ধিজীবীর দায়িত্ব’ নিয়ে। তিনি বলছেন, “সত্যি কথা বলা এবং মিথ্যেকে প্রকাশ করাই বুদ্ধিজীবীর দায়িত্ব।” এই উক্তি করেই উনি বিখ্যাত জার্মান দার্শনিক মার্টিন হাইডেগার-এর ১৯৩৩ সালে হিটলারের পক্ষে লেখা একটি ঘোষণা থেকে উদ্ধৃতি দিচ্ছেন: “সত্য হল তারই প্রকাশ, যা মানুষের কাজ আর জ্ঞানকে নিশ্চিত করবে, স্পষ্টতা দেবে, শক্তিশালী করবে।” আদতে ‘সত্য’ তো তা-ই। কিন্তু বরেণ্য বুদ্ধিজীবী যখন হিটলারের পক্ষে দাঁড়িয়ে এ কথা বলছেন তখন তো ‘সত্য’-এর অস্তিত্ব বিপন্ন। আসলে ‘সত্য’ যে কোথায়, তা গুলিয়ে দেওয়ার সব ব্যবস্থা তৈরি করা আছে। ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে লড়াই সহজ কথা নয়। উন্মুক্ত ফ্যাসিবাদ চেনা যায়, কিন্তু গোপন ও ব্যক্তিগত ফ্যাসিবাদকে চেনা দুষ্কর। ফ্যাসিবাদী নেতাদের প্রচার যন্ত্রের কাছে সবচেয়ে বড় ঘৃণার বস্তু হচ্ছে ‘সত্য’, কারণ সেই যন্ত্রের মতে, ‘সত্য’ বস্তুটি নির্ভর করে সেই মহাক্ষমতাবান ব্যক্তির উপর যিনি সত্যের উদ্ভাবন ঘটাতে পারেন। আমাদের দেশের স্বৈরতন্ত্র গণতন্ত্রকে ব্যবহার করে গণহত্যাকে সাংবিধানিক করার চেষ্টায় মেতে রয়েছে। গণতন্ত্র যে ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে প্রতিরক্ষার পক্ষে যথেষ্ট, সেটাও জোর দিয়ে বলা যাচ্ছে না, কারণ আমাদের এই সুবিশাল গণতান্ত্রিক কাঠামোর ভিতরেই ফ্যাসিবাদ ডিম পেড়ে চলেছে।

আজ শিল্পীকে এই জটিল পরিসর মেনে নিয়েই ‘সত্য’ কথাটা মানুষের কাছে নিয়ে যেতে হবে। একমাত্র উপায় হচ্ছে সত্যকে যাচাই করে নিতে হবে ইতিহাসের পরিপ্রেক্ষিতে। বার বার মুখ ফেরাতে হবে বহুমাত্রিক ইতিহাসের দিকে। শৈল্পিক উদ্ভাবনে আর উৎকর্ষে তৈরি করতে হবে মানুষের সঙ্গে সংলাপ। খুঁজে নিতে হবে মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ার ফন্দি-ফিকির। যেমন কাগজের বুকে ক্ষতের চিহ্নে ভেসে ওঠে ‘রামরাজ্যে শববাহিনী গঙ্গা’র কূলে অগ্নিশয্যা। গোপন আর ব্যক্তিগত ফ্যাসিবাদের অঞ্চলেই শিল্পীর প্রধান কাজ। কারণ শিল্প কাজ করে অবচেতনে। এ-বছর সত্যজিৎ রায়, সুকুমারী ভট্টাচার্য, অমলেশ ত্রিপাঠী এবং সোমনাথ হোরের জন্মশতবর্ষ, এবং টিনের তলোয়ার নাটকের পঞ্চাশ বছর। সব কোলাহল ভেদ করে শোনা কি যাচ্ছে নাটকের শেষে বিবেকের গান? “শুন গো ভারতভূমি, কত নিদ্রা যাবে তুমি, উঠ ত্যজ ঘুমঘোর...”।

অন্য বিষয়গুলি:

BJP Fascism
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy