ফাইল চিত্র।
খুব অস্বস্তি হয় ঋতুপর্ণ ঘোষকে নিয়ে লিখতে। একেবারেই চাই না।
কথাটা শুনতে অদ্ভুত লাগলেও তা সত্যি। সকলেই ভাবেন আমি ঋতুর কলেজের প্রিয় বন্ধু আর পরবর্তীকালে ভ্রাতৃবধূ হওয়ার সুবাদে নিজের প্রচারের জন্য ঋতুকে নিয়ে সংবাদমাধ্যমে কলম ধরি। এ অত্যন্ত অন্যায়। ঋতু নিজে এক জন খ্যাতনামী। ওর প্রচারের প্রয়োজন নেই। আর ওকে নিয়ে লিখে আমার নতুন করে কী হবে? আমার স্বামী ইন্দ্রনীল ঘোষ আর আমি দু’জনেই বরং ঋতুপর্ণ ঘোষের আত্মীয় বলে অনেক ঝামেলায় পড়েছি। তা-ও আনন্দবাজার অনলাইনের সম্পাদকের অনুরোধে এই লেখা লিখতে বসা। ঋতুকে নিয়ে ভাবতে গেলেও আজও মনটা বড্ড শক্ত হয়ে আসে।
তখন কলেজবেলা। ঋতুর সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়েছিল। কোঁকড়ানো চুল, চোখভর্তি মেধা আর মনভর্তি নানা গল্প! প্রথম যখন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে এলাম, দেখলাম ছেলেরা এক জনকে নিয়ে ঠাট্টা করছে। ছেলেরা তো খুব নির্মম হয়। সে দিক থেকে মেয়েরা অনেক বেশি নরম। সে দিনই ওর সঙ্গে আলাপ করেছিলাম। অনেক গল্প করেছিলাম। আমাদের দলে মীনাক্ষীও ছিল। মীনাক্ষী শান্ত, একটু রক্ষণশীল। কিন্তু তাও আমাদের সঙ্গে জুটে গিয়েছিল। আমি আর ঋতু সব অদ্ভুত কাজ করতাম। আর মীনাক্ষী আমাদের বারণ করত। বেশ মিলেছিল আমাদের তিন জনের।
আমি আনন্দমেলা-য় এক বার পেলের ছবি দেখে যাদবপুরে বলেছিলাম, ‘‘পেলে কী সুপুরুষ!’’ সবাই একমত হয়নি। তখন ‘সুপুরুষ’ বলতে যা বোঝাত, তা সত্যি পেলের সঙ্গে মেলে না। সেখানে আমাদের বন্ধুদের মধ্যে একমাত্র ঋতু বলেছিল, “পেলে সত্যিই সুপুরুষ। তোরা কী বুঝিস!” ঋতু কাউকে ছেড়ে দিত না। এই জন্যই ঋতু আমার এত বন্ধু ছিল।
এমনই ঋতু। যা মনে হবে ঠিক, সেটাই করবে। আমি আর ঋতু এক সঙ্গে বার্গম্যান-এর ছবি ‘সাইলেন্স’ দেখেছিলাম। ওই ছবির একটি দৃশ্যে দেখলাম, ময়দার তালের উপর দিয়ে ব্যাঙ চলে গেল! সেটা যে ধর্ষণের মেটাফর, তা ঋতুই আমায় চিনিয়েছিল। ও একটু এগিয়েই ছিল। সব কিছুর দেখার একটা আলাদা চোখ ছিল ওর।
ওর জন্মদিনে আমরা কেক কাটতাম না। সারপ্রাইজ গিফট দেবার জন্যে প্রাণ হাতে করে যে কোনও জায়গা থেকে পছন্দসই অথচ দাম কম হবে, এমন কিছু কিনতে চলে যেতাম। তবে ঋতুকে উপহার দেওয়া তো! তা নিয়ে খুব ভাবতে হত। ও খুব খাওয়াতে ভালবাসত। আর জন্মদিনের একটা বেলা আমরা তিন জন ঘুরে বেড়াতাম। ভাল কোনও সিনেমা বা নাটক দেখতাম। সাধারণভাবে আমরা তিন জন এক সঙ্গে থাকতাম। আমি, ঋতু আর মীনাক্ষী। আমিনিয়া বা সিরাজ, এই রকম রেস্তরাঁয় খেতাম। বাসে করে ডায়মন্ড হারবার বা দক্ষিণেশ্বর চলে যেতাম।
বিখ্যাত হওয়ার পর একটাই দাবি ছিল। ওর বয়স নিয়ে প্রেসের কাছে ও যা বলেছে, আমি যেন সেটাই বলি। সবাই জানে আমরা এক ব্যাচ। কত কমিয়েছে বয়েস? এক বছর। আমি বলতাম, ‘‘এক বছরে কী হবে? সামনের বছরই তো পৌঁছে যাবি এই বয়সে।’’ তা-ই সই। সময়ের সঙ্গে বয়সেও পৌঁছে গেল, খ্যাতিও হল ঋতুর। একটু নাম হওয়ার পর থেকে ওর বাড়িতে প্রায়ই কিছু লোক আসত। আমি আর চিঙ্কু (ইন্দ্রনীল) যেতাম। আর আমি বাড়ির বৌ হয়ে আসার পরে রান্না করে পাঠাতাম ওকে। খুব খুশি হত ঋতু। অনেক লোকজন থাকলেও কোনও একটা সময় গিয়ে দেখা করতাম আমরা।
এক বারের কথা খুব মনে আছে। ওর জন্মদিন এল। তখন আমার শ্বশুর-শাশুড়ি কেউ নেই। অত বড় বাড়িতে ও একা। বললাম, “তোর সব আছে। কী দেব বল তো তোকে?” ও বলেছিল, “ তুই অনেকটা পাঁঠার মাংস রান্না করে পাঠা। আর টুকরো গুণে পাঠাবি।’’ আমি বলেছিলাম, “দেড় কেজি মাংস রান্না করে পাঠাচ্ছি। তবে টুকরো গুণতে পারব না।’’ আসলে তখন বাড়িতে শুধু ভৃত্যদের রাজত্ব। কোন জিনিস কোথায় যায়, ঋতু ধরতেই পারে না। তাই এমন করে বলেছিল।
ঝলমলে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের খোলা প্রান্তর। আমাদের মনও তাই। বিপ্লব, বিশ্ব, তত্ত্ব — এ সব নিয়েই তখন মন স্বপ্ন দেখতে চায়। কিন্তু ঋতু? ‘তিতলি’ গল্পটা লিখে শুনিয়েছিল আমাকে। তখন খুব বন্ধু আমরা। আজ আর বলতে দ্বিধা নেই, আলাপের বেশ কিছু দিন পরে ঋতু এসে আমাকে বলেছিল, “আমার এক পুরুষ প্রেমিক আছে। এটা জানার পর কি আমার সঙ্গে বন্ধুত্ব রাখবি?” আটের দশকের মাঝ সময়ে এই কথাটা বলা এবং শোনাটা সহজ ছিল না একেবারেই। সমকামিতাকে তখনও গ্রহণ করতে শেখেনি সমাজ। তবু আমার মনে হয়েছিল, ‘তাতে আমার কী!’ ঋতু নিশ্চিন্ত হয়েছিল সেই দিন। ওর সম্পর্ক ভাঙলেও এসে আমায় বলত। পুরুষে-পুরুষে সম্পর্ক কি আজও খুব সহজে মেনে নেওয়া হয়? যাই হোক, সেই বন্ধুত্বর জায়গা থেকেই ‘তিতলি’ পড়ে শুনিয়েছিল। আমি ছোটবেলা থেকে যেমন মানুষকে শুধু মানুষ হিসেবেই দেখতাম, তেমনই ঋতুকে লিঙ্গ দিয়ে বিচার করিনি। মানুষ ভাবতাম। সেটা ও বুঝেছিল। ওর যে কোনও কথা আমায় বলতে পারত, জানত, আমি আঁতকে উঠে মরে পড়ে যাব না। ‘হয় না’ বলে যে আমার কাছে কিছু নেই, সেটা ও জানত। আমি দেখতাম ও কেমন করে ‘ছবি’ দেখতে পায়।
ওর প্রথম ছবি কী? কেউ জানেই না। সমরেশ বসুর গল্প ‘মোক্তার দাদুর কেতুবধ’ নিয়ে প্রথম চিত্রনাট্য লেখে ঋতু। আনন্দমেলা-য় প্রকাশিত হয়েছিল সেই ছোটদের গল্প। ও সেটার চিত্রনাট্য লিখেছিল। কিন্তু ওর পাকামো যাবে কোথায়? সেই গল্পের এক অন্য আধার রচনা করেছিল। সেখানে এক বিকিনি পরা মেয়ের ন্যারেটিভ তৈরি হয়েছিল। আমি চিত্রনাট্য শুনে সতর্ক করেছিলাম, এই লেখার জন্য কেউ পয়সা দেবে না। ওকে বলেছিলাম, “হয় বড়দের ছবি কর, নয় বাচ্চাদের ছবি কর। পাকামি করিস না।’’ সেটাই ওর প্রথম চিত্রনাট্য লেখা। তার আগে অবশ্য ও ‘অমৃত কুম্ভের সন্ধানে’ বলে একটি ছোট ছবি করেছিল। এই যে গঙ্গাজলে লোকে কুম্ভ স্নান করে, সেটা কতটা দূষিত, সেই বিষয়টা একজন চিকিৎসকের মাধ্যমে ও দেখাতে চেয়েছিল।
আমার মনে আছে লাইট হাউজের উপরে একটা ছোট্ট প্রেক্ষাগৃহ ছিল। সেখানে গঙ্গা নিয়ে আমার শ্বশুরমশাইয়ের একটি তথ্যচিত্র দেখান হয়েছিল। সঙ্গে ওর এই ছবি। ঋতু বলেছিল,‘‘আসিস না রে আমার ছবি দেখতে। প্রেসও আসবে।’’ আমি হেসে বলেছিলাম, “তোর আবার ছবি! তার জন্য আবার প্রেস আসবে!” আমার সঙ্গে সম্পর্কটা এমনই ছিল। ছবিটা দেখতে গিয়েছিলাম। ছবি দেখে দু’জনে গঙ্গার ধারে গিয়েছিলাম। আমরা প্রায়ই যেতাম গঙ্গার ধারে।
আমরা জানতাম, ঋতু ছবির পরিচালক হবেই। আর অন্য কিছু হতে পারে না ও! ‘তিতলি’ নিয়ে তর্ক শুরু হল আমাদের। আমি বলেছিলাম, “তুই শুধু প্রেমের গল্প না লিখে বিশ্বের প্রেক্ষিতে একটা ছবি বানা।’’ ও বলেছিল, “ধরে নে এক জন সেলিব্রিটি। যাঁকে সব জায়গায়, সব সময় দেখা যায়। কিন্তু এখন তাঁকে তোর দেখতে ইচ্ছা করছে না। তবু তুই বাধ্য হচ্ছিস তাঁকে দেখতে! এই পরিস্থিতিটা যে কতটা যন্ত্রণার, এটা হয়ত বুঝতে পারবি!”
সে দিন বুঝিনি। কিন্তু ঋতু চলে যাওয়ার বেশ কিছু দিন পরে আমি আমার দু’জন সহকর্মীর সঙ্গে কলেজ থেকে ট্যাক্সিতে ফিরছি। এফএম-এ বাজছে, ‘সখী হাম মোহন অভিসারে...’। আমার এক সহকর্মী জানতে চেয়েছিলেন, ‘‘এই গানটা ঋতুপর্ণর লেখা?’’ আমি সম্মতি দেওয়ার পর দেখি, অন্য এক সহকর্মী নেট থেকে সেই গানটা আবার চালালেন। আর হুট করে ঋতুর ছবিটা মোবাইলে ভেসে উঠল। উফ্ফ! তখন এক দম ঋতুকে দেখতে চাইছিলাম না আমি। কিছুতেই না! কিন্তু উপায় নেই, ওদের কি আর বলতে পারি গানটা থামাও!
পঞ্চাশ পেরিয়ে আমার মনে হয়, ঋতু নিশ্চয়ই ‘মহাভারত’ বা ‘রাধাকৃষ্ণ’ নিয়ে ছবি করার কাজে হাত দিত। একটা কথা আজ বলি, ছবি করার ক্ষেত্রে যা যা করার, ঋতু ওর ইচ্ছে অনুসারে সব করে গিয়েছে। তবে ‘মহাভারত’ করতে চেয়েছিল। জনশ্রুতিকে ইতিহাস বানানোর ক্ষমতা ওর মধ্যে ছিল! সেটা হল না।
জন্মদিনে এখন আর ওর বাড়ি যাই না। এত লোক সে দিন বাড়িটাকে ঘিরে রাখে, আমাদের দেখলেই ঋতুকে নিয়ে যত উদ্ভট প্রশ্ন করতে চায়…ভাল লাগে না। যাই না। যাবও না। তর্ক করেছি ঋতুর সঙ্গে বহু বার, কিন্তু কোনও দিন ঝগড়া হয়নি আমাদের। তর্কতেও ও বরাবর জিতে যেত। শেষেও তাই হল। সংসার থেকে চলে গেল জেদ করে। জিতে গেল।
আচ্ছা, ওর জন্মদিনেও আমার ওর চলে যাওয়ার কথাই মনে পড়ল?
(লেখিকা অর্থনীতির অধ্যাপিকা। মতামত একান্ত ব্যক্তিগত)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy