Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪
Kazi Nazrul Islam

নজরুল বুঝেছিলেন আইন করে কৃষক-শ্রমিকের অধিকার নিশ্চিত করা কতটা জরুরি

এই বলরামের চেলা হয়েই যেন দেখা দিলেন নজরুল। নজরুলের বাস্তব ‌চেতনা এ সময় যে কতটা পরিণত হয়ে উঠেছিল, তার প্রমাণ লাঙলের ইস্তাহার রচনায়।

কিন্তু হাবিলদার কবি কাজী নজরুল টের পেয়েছিলেন তাঁর কর্মযজ্ঞ আরও বৃহত্তর।

কিন্তু হাবিলদার কবি কাজী নজরুল টের পেয়েছিলেন তাঁর কর্মযজ্ঞ আরও বৃহত্তর।

স্বাতী গুহ
স্বাতী গুহ
শেষ আপডেট: ২৯ অগস্ট ২০২১ ১৪:৩৩
Share: Save:

সব মরণ নয় সমান, বহু ব্যবহারে এ কথা জীর্ণ। তবু কাজী নজরুল ইসলামের মৃত্যুদিনে ভারতীয় নাগরিক হিসাবে তাঁর কাজের দিকে যখন চোখ রাখি, এই ধ্বনিরই প্রতিধ্বনি শুনি। বারবার মনে হয় নজরুলের চেনা অবয়বের বাইরে গিয়ে তাঁকে খুঁজি। তাঁর দূরদৃষ্টি, শ্রমিক অধিকারের দাবিতে একক মানচিত্র তৈরি, আজও লড়াইয়ের সারকথা হতে পারে, এমনই মনে হয় সর্বদা। কেন? উত্তর পাওয়া যাবে নজরুলের নিবিড় পাঠেই।


তখন জনপ্রিয়তার তুঙ্গে কবি নজরুল ইসলাম। পাশাপাশি তাঁকে ঘিরে বিতর্ক, নিন্দামন্দ, কটুবাক্যের বর্ষণ চলছিল অনবরত। কাব্যের শিল্পগুণ, চিরন্তনতা সব কিছু নিয়ে মুখর হয়ে উঠেছিলেন বিশেষজ্ঞের দল। নজরুল যেন নিজের ভূমিকাকে নিজের কাছেই কিছুটা দৃঢ় করে তুলতে চেয়েছিলেন কৈফিয়ৎ-এর মাধ্যমে। লিখলেন, ‘বর্তমানের কবি আমি ভাই, ভবিষ্যতের নই ‘নবী’।’ কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় বর্তমান যেন এক ঘটমান সত্য, এবং তা আজকের নিরিখেও। ১৩৩২-র আশ্বিন সংখ্যার বিজলীতে প্রকাশিত হয় ‘আমার কৈফিয়ৎ’। ‘যারা কেড়ে খায় তেত্রিশ কোটির মুখের গ্রাস’, তাদের বিরুদ্ধে একটা রাজনৈতিক প্রস্থান, নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে চাইছিলেন যেন তিনি। আসলে করাচি থেকে ফেরা অবধি কিছুতেই যেন শান্তশিষ্ট হয়ে থাকতে পারছিলেন না। সাব-রেজিস্টারের চাকরির আহ্বান ফিরিয়ে দেওয়া অন্তত সেই বুভুক্ষু সময়ে খুব সহজ কাজ ছিল না। কিন্তু হাবিলদার কবি কাজী নজরুল টের পেয়েছিলেন তাঁর কর্মযজ্ঞ আরও বৃহত্তর। মুজফফর আহমদ জেলখানার পাঁচিলে আবদ্ধ না থাকলে কমিউনিস্ট পার্টি গড়ে তোলার কাজ যে অনেকটা সঞ্চালিত হত তাতে কোনও সন্দেহ নেই। নজরুল সেই গঠনের কাজে মূল শক্তির আধারও হতে পারতেন। দেশজুড়ে তখন আবেদন-নিবেদনের রাজনীতি। তবুও ১৯২৫ -এ কংগ্রেসের ভিতরে থাকা তরুণ প্রগতিশীলরা লেবার স্বরাজ পার্টি বা শ্রমিক স্বরাজ পার্টি তৈরি করে ফেলেছিলেন।

সমবয়স ও সমমনস্কদের সঙ্গে নজরুল যে এ দলে জুড়ে যাবেন, সেটাই স্বাভাবিক ছিল। মুজফফর আহমেদও জেল থেকে ছাড়া পেয়ে জুড়ে গিয়েছিলেন এই দলে। নজরুলের সৃষ্টি ক্ষমতাকে কার্যকর করার জন্যই এই দলের মুখপত্র হিসেবে প্রকাশিত হল ‘লাঙল’ পত্রিকা।

রবীন্দ্রনাথ ‘লাঙল’-এর জন্য বাণী লিখে পাঠালেন –

‘জাগো জাগো বলরাম, ধরো তব মরু-ভাঙা হল,

প্রাণ দাও, শক্তি দাও, স্তব্ধ করো ব্যর্থ কোলাহল।’

এই বলরামের চেলা হয়েই যেন দেখা দিলেন নজরুল। নজরুলের বাস্তব ‌চেতনা এ সময় যে কতটা পরিণত হয়ে উঠেছিল, তার প্রমাণ লাঙলের ইস্তাহার রচনায়। দলের কর্মনীতি ও সংকল্প হিসেবে উল্লেখ করা হল - ‘এই দল শ্রমিক ও কৃষকগণের স্বার্থের জন্য যুঝিবেন।’

এই বলরামের চেলা হয়েই যেন দেখা দিলেন নজরুল।

এই বলরামের চেলা হয়েই যেন দেখা দিলেন নজরুল।

এই পরিপ্রেক্ষিতে হাল আমলের নানা তথ্য পেশ করে প্রমাণ করা যেতে পারে যে আজও ভারতের স্বাধীনতার ৭৫ বছর অতিক্রান্ত হওয়ার পরও কোনও দলই তাদের কর্মনীতিতে শ্রমিক ও কৃষকের স্বার্থকে যথাযথ সম্মান দিতে পারেননি। এমনকি, প্রতিশ্রুতির ফাঁকা বুলি আজও কৃষকের মৃত্যু বা আত্মহত্যার পরিসংখ্যানে সভ্যতাকে নস্যাৎ করে দেয়। তাঁদের মাথার থেকে ঝরে পড়া ঘাম কিংবা পায়ের নীচে ফুলে ওঠা ফোস্কা, সবই খবরে বিশিষ্ট হয়ে ওঠে স্থিরচিত্র আর ভিডিয়োতে। কিন্তু তাঁদের আসল সত্যিটা চাপা পড়ে থাকে রাজধানীর বিলাস বাহুল্যে। কৃষকের আত্মহত্যা তাই ব্যক্তিগত কারণ মাত্র হয়ে ওঠে। অথচ প্রকৃতি নির্ভর কৃষি ব্যবস্থার উন্নতির নামে যোজনাগুলি চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে, তা দীর্ঘকালীন উন্নয়নের সূচকগুলোকে না মেনেই। তাই মাটির নীচের জল নিঃশেষ হয়েছে হাইব্রিড ফলনের চাপকে কৃষকের ওপর চাপিয়ে দেওয়ায়। ভূমি সংস্কারের ফলে কৃষিজমির আয়তন ছোটো হতে হতে তা চাষযোগ্যতা হারিয়েছে। তাহলে কি সত্যিই আমরা ১৩৩২ -এর উচ্চারণকে শুধুই বর্তমানের কবির বিস্ফোরক মন্তব্য মাত্র বলে এড়িয়ে যেতে পারি?

লেবার স্বরাজ পার্টির ইস্তাহারে লেখা হয়েছিল, ‘জীবনযাত্রার পক্ষে যথোপযুক্ত মজুরির একটা নিম্নতম হার আইনের দ্বারা বাঁধিয়া দেওয়া।’ আজও ন্যূনতম মজুরি নিয়ে বিতর্ক মেটেনি। শুধু নিম্নতম হার নয়, নারী পুরুষের ক্ষেত্রে শ্রমের মূল্য ভিন্নতাও চালু আছে এই একুশ শতকীয় নব্য জীবনে ! আর আশ্চর্যের বিষয় হল এ শুধু খেটে খাওয়া শ্রমিকের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য নয়; বলিউডি নায়ক-নায়িকারা, খেলোয়াড় সম্প্রদায় এখনও এই সমানাধিকার অর্জন করতে পারেননি। ওই ইস্তেহারেই লেখা হয়, ‘শ্রমিকগণের আরাম, কাজের শর্ত, চিকিৎসার বন্দোবস্ত প্রভৃতি বিষয়ে কতকগুলি দাবি মালিকগণকে আইন দ্বারা বাধ্য করিয়া পূরণ করা।’ শ্রমের প্রকারভেদ এবং শ্রমিকের কাজের জায়গায় সর্বনিম্ন নিয়ম-কানুন আজও মানা হয় না। আইন অবশ্য আছে। কাজের শর্ত ইত্যাদি সবই মূলত কিছুটা হলেও মেনে চলা লক্ষ করা যায় সংগঠিত ক্ষেত্রে। কিন্তু অসংগঠিত ক্ষেত্রে শ্রমের প্রকারভেদ লক্ষ লক্ষ কিংবা তারও বেশি। অথচ সুবিধে দেওয়ার ব্যাপারে মোটেই তেমন উদ্যোগ আজও লক্ষ করা যায় না। বরং চাহিদার থেকে যোগান বেশির সূত্র বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই শ্রমিকের লাঞ্ছনাকে আরও তীব্র পর্যায়ে নিয়ে যায়। যে সব দেশে শ্রমিকের জোগানের অভাব, সেখানে হয়ত বাধ্যত কিছু সুযোগ সুবিধে দেওয়ার কথা ভাবতে হয় মালিক কিংবা ঠিকাদারকে।

নজরুল বুঝতে পেরেছিলেন, যত ক্ষণ না মানুষ তার শ্রমদানের ক্ষেত্রে নিজের অংশীদারিকে প্রতিষ্ঠিত দেখতে পারেন, তত ক্ষণ তার অবমাননার শেষ নেই।

নজরুল বুঝতে পেরেছিলেন, যত ক্ষণ না মানুষ তার শ্রমদানের ক্ষেত্রে নিজের অংশীদারিকে প্রতিষ্ঠিত দেখতে পারেন, তত ক্ষণ তার অবমাননার শেষ নেই।

আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলিতে শ্রমিক কিংবা কৃষকের কাজের ক্ষেত্র বেশিরভাগটাই বেসরকারি উদ্যোগে পরিচালিত হয়। তাই নিয়মকানুনগুলো আজও সেখানে সোনার পাথর বাটির মতোই বলা যেতে পারে। আর উৎপাদনের হার বৃদ্ধি কিংবা গুণমান রক্ষার জন্য এসইজেড বা স্পেশাল ইকনমিক জোন তৈরি করে সেখানে নানা ধরণের শ্রম-শোষণের কাজ কারবার চলে প্রতিদিন। কাজের সময় ১২ ঘন্টা বা তার বেশিই চলতে থাকে এক নাগাড়ে। অথচ ভাবলে অবাক হতে হয়, লাঙলের সম্পাদক তথা ইস্তাহার লেখক কাজী নজরুল ইসলাম সেই সময়েই আন্দাজ করতে পেরেছিলেন আইন করে কৃষক-শ্রমিকের অধিকারকে নিশ্চিত করা কতটা জরুরি। তাই আজও যে তাঁর রাজনৈতিক চিন্তাধারা কতটা আধুনিক সে কথা বুঝলে বিস্মিত হওয়া ছাড়া আর কোনও উপায় থাকে না আমাদের।

ওই ইস্তাহারই বলছে, ‘অসুখ-বিসুখ, দুর্ঘটনা, বেকার অবস্থা এবং বৃদ্ধ অবস্থায় শ্রমিকগণকে রক্ষা করিবার জন্য আইন প্রণয়ন’-করার কথা। বলা হয়েছে, সমস্ত বড় কলকারখানায় লাভের ভাগে শ্রমিকগণকে অধিকারী করা। আসলে নজরুল বুঝতে পেরেছিলেন, যত ক্ষণ না মানুষ তার শ্রমদানের ক্ষেত্রে নিজের অংশীদারিকে প্রতিষ্ঠিত দেখতে পারেন, তত ক্ষণ তার অবমাননার শেষ নেই। যে কোনও উৎপাদন ব্যবস্থায় মানুষ লগ্ন হোন না কেন, তার সঙ্গে শুধু পারিশ্রমিকের যোগাযোগ হলে তা কখনই উৎপাদনকেও শ্রেষ্ঠ পর্যায়ে নিয়ে যেতে পারে না। নজরুল খুব স্পষ্ট ভাষায় বলেছিলেন, ‘মালিকগণের খরচায় শ্রমজীবীগণের বাধ্যতামূলক শিক্ষা।’

নজরুলের রাজনৈতিক চেতনায় বৃহৎ সংখ্যক মানুষের উন্নতি নিয়ে যে ভাবনার কথা প্রতিভাত হয়েছিল।

নজরুলের রাজনৈতিক চেতনায় বৃহৎ সংখ্যক মানুষের উন্নতি নিয়ে যে ভাবনার কথা প্রতিভাত হয়েছিল।

‘শ্রমিকগণের আর্থিক অবস্থার উন্নতির জন্য কোনও কো-অপারেটিভ প্রতিষ্ঠান স্থাপন করা’-র কথাও বলেছে নজরুলের সেই ইস্তাহার। আজ কিন্তু গুজরাতের আনন্দ উদ্যোগ প্রমাণ করেছে সমবায় ব্যবস্থাপনায় ক্ষুদ্র উদ্যোগ থেকে শুরু করে দেশব্যাপী বৃহৎ উদ্যোগ চালনা করা সম্ভব। নজরুলের রাজনৈতিক চেতনায় বৃহৎ সংখ্যক মানুষের উন্নতি নিয়ে যে ভাবনার কথা প্রতিভাত হয়েছিল, তা আজও যদি অক্ষরে অক্ষরে পালন করা যেত, তবে মানুষের মৌলিক অধিকার রক্ষার দিকে কিছুটা হলেও আমাদের এগনো সম্ভব হত। পুঁজিবাদী সংস্কৃতি যে ভাবে শুধু উৎপাদনের অন্তিম ফলটুকু ভোগ করে, আর উৎপাদন কাজে নিয়োজিত মানুষের দুর্দশার কারণ হয়, তা আজও আমরা বুঝে উঠলেও সঠিক পরিপ্রেক্ষিত তৈরির কাজ করে উঠতে পারিনি। সমাজতন্ত্রের ধারণা ভেঙে পড়ার ইতিহাসকে সাক্ষী রেখেও আজও বলা যায়, মানুষকে একজোট করার যে ইস্তাহার রচিত হয়েছিল সেদিন, তা মেনে চললেই মানুষের ক্রমমুক্তি সম্ভব। নজরুলের মৃত্যুর পর এতগুলি বছর পেরিয়ে আজ আমরা তাঁকে যদি ভেঙে না গড়তে পারি, পড়তে পারি-তবে বোধহয় দেশের নীচুতলার সঙ্গে দূরত্বটা থেকেই যাবে।

(লেখক ডিরেক্টর, নজরুল সেন্টার ফর সোশ্যাল অ্যান্ড কালচারাল স্টাডিজ, কাজী নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়। মতামত একান্ত ব্যক্তিগত)

অন্য বিষয়গুলি:

Kazi Nazrul Islam Nazrul Islam digital essay
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy