একটা অর্থবর্ষে কোনও দেশ মোট যত অর্থমূল্যের পণ্য রফতানি করে, তার থেকে সেই অর্থবর্ষে দেশে মোট আমদানির খরচকে বাদ দিলে যা পড়ে থাকে, তার নাম ট্রেড সারপ্লাস বা বাণিজ্য খাতে উদ্বৃত্ত। অন্য দিকে, রফতানির চেয়ে আমদানির অর্থমূল্য বেশি হলে তৈরি হয় ট্রেড ডেফিসিট বা বাণিজ্য খাতে ঘাটতি। পঞ্চদশ থেকে অষ্টাদশ শতকে ইউরোপে একটি অর্থনীতিবাদ চালু ছিল, যাকে বলে মার্কেন্টিলিজ়ম— তার বিশ্বাস ছিল, আমদানির চেয়ে যত বেশি রফতানি করা যায়, দেশের আর্থিক সমৃদ্ধির পক্ষে তা ততই ভাল। আমদানির চেয়ে রফতানির পরিমাণ বেশি হলে উল্টো দিকের ঘাটতিতে থাকা বাণিজ্য-সঙ্গী দেশের থেকে বাণিজ্য-উদ্বৃত্ত দেশে স্বর্ণমুদ্রা আসত। এই নিয়ম অবশ্য এখন পাল্টে গিয়েছে— স্বর্ণমুদ্রা দিয়ে এখন আর জিনিসপত্র সওদা হয় না। আজকের উদার বাণিজ্যের অর্থনীতিবাদ বলে যে, দেশের নাগরিকরা যদি বিদেশি দ্রব্য পছন্দ করেন, তাঁরা সেটাই কিনবেন। যে দেশ যে পণ্য উৎপাদন করতে পারদর্শী, তারা সেটিতেই উৎকর্ষ দেখাবে। এবং, এই পথেই আর্থিক সমৃদ্ধি আসবে।
তা হলে বাণিজ্যিক ঘাটতি নিয়ে আমেরিকান প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের এত মাথাব্যথা কেন, যে তিনি কার্যত গোটা দুনিয়ার বাণিজ্যব্যবস্থা উলটপালট করে দিচ্ছেন? যে-হেতু ট্রাম্প পেশায় ব্যবসায়ী, তিনি হয়তো ভাবেন যে, বাণিজ্যিক ঘাটতিতে দেশের ক্ষতি। কিন্তু, জাতীয় আয়ের পরিসংখ্যান নিয়ে সামান্য হিসাব করলেই নির্ধারণ করা যায় যে, দেশে যদি আমদানির অর্থমূল্য রফতানির চেয়ে বেশি হয়, তার অর্থ হল, দেশের সরকার বা নাগরিকরা আয় বা কর সংগ্রহের তুলনায় বেশি ব্যয় করছেন। অর্থাৎ, সেই দেশের জাতীয় সঞ্চয় তাদের জাতীয় বিনিয়োগের চেয়ে কম। তার ফলে দেশে বাণিজ্যিক ঘাটতি হলে বহির্বিশ্ব থেকে ঋণ করতে হবে ঘাটতি মেটাতে। বাণিজ্যিক ঘাটতি দেশের একটি মৌলিক সমস্যার প্রতিফলন। সেটি হল দেশে সঞ্চয়ের অভাব।
জাতীয় সঞ্চয় হল দেশের নাগরিকদের সঞ্চয় আর সরকারি সঞ্চয়ের যোগফল। নাগরিকদের সঞ্চয় হল তাঁদের আয় থেকে কর এবং ব্যয় বাদ দিয়ে যা উদ্বৃত্ত থাকে, সেই অঙ্কটুকু। কর সংগ্রহের পর সরকারি ব্যয় বাদ দিলে যা পড়ে থাকে, তা হল সরকারি সঞ্চয়, যেটিকে বলব বাজেট সারপ্লাস। গত ডিসেম্বরের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, আমেরিকার নাগরিকদের ব্যক্তিগত সঞ্চয়ের হার কর প্রদানের পর অবশিষ্ট আয়ের ৩.৮%। ২০১৫ সালের পর থেকেই এই সঞ্চয়ের হার নিম্নগামী। আমেরিকাতে ২০২৪-এ সরকারি বাজেট ঘাটতির হার জাতীয় আয়ের ৬.৩%, যা গত পঞ্চাশ বছরের গড় বাজেট ঘাটতির প্রায় দ্বিগুণ।
জাতীয় সঞ্চয়ের এই মৌলিক খামতির সমস্যা বিবেচনা না করে, ট্রাম্প আমদানি শুল্ক বাড়িয়ে চটজলদি এক ঢিলে বহু পাখি শিকার করার কথা ভাবছেন। এক দিকে যেমন বিভিন্ন দেশকে বিভিন্ন কারণে শায়েস্তা করার পরিকল্পনা, তেমনই ট্রাম্প আমদানি শুল্ক বাড়িয়ে সরকারি বাজেট ঘাটতি পূরণ করার কথাও ভাবছেন, যাতে আয়কর বাড়াতে না হয়। তিনি মনে করছেন, আমদানি শুল্ক বসলে দেশের শিল্প চাঙ্গা হবে। এ প্রস্তাবও করেছেন যে, কোনও দেশ আমেরিকার মাটিতে উৎপাদনকেন্দ্র তৈরি করলে তারা আমদানি শুল্ক-সহ অন্যান্য কর-ছাড় পাবে। এতে দেশে বৃদ্ধির জোয়ার আসবে।
কিন্তু ট্রাম্পের এই ‘ট্যারিফোনমিক্স’ কি এত সহজ হবে? শুল্ক বাড়লে আমদানি করা জিনিসের দামও বাড়বে। সেই কারণে লোকে বিদেশি পণ্য কেনা তাৎপর্যপূর্ণ হারে কমালে শুল্কবাবদ রাজস্ব কমেও যেতে পারে। যে দেশগুলোর উপরে শুল্ক আরোপ করা হবে, তারাও আমেরিকা থেকে রফতানি পণ্যের উপরে পাল্টা চড়া শুল্ক চাপাতে শুরু করবে, যেমন কানাডা এবং মেক্সিকো ইতিমধ্যেই করার কথা ভাবছে। এর ফলে আমেরিকার রফতানি শিল্পগুলি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।
এই বাণিজ্যিক যুদ্ধে কে জিতবে বলা কঠিন। আমেরিকার সঙ্গে কানাডা এবং মেক্সিকোর বাণিজ্য-সম্পর্ক বহু দিনের। ব্যুরো অব ইকনমিক অ্যানালিসিস-এর তথ্য থেকে পাচ্ছি, ২০২৪-এ আমেরিকার রফতানির ৩৩% গিয়েছে কানাডা এবং মেক্সিকোতে; আর সে দেশ দু’টি থেকে আমেরিকার মোট আমদানির ২৮% এসেছে। অন্য দিকে, একই বছরে আমেরিকার চিনের সঙ্গে আমদানি রফতানির পরিমাণ অনেক কম, ১৩% আর ৭%। সুতরাং, এই শুল্কযুদ্ধে, চিনের থেকে কানাডা আর মেক্সিকোর সঙ্গে লড়াইতে আমেরিকার ঝুঁকি অনেক বেশি।
সরকারি বাজেট ঘাটতি কমানোর জন্য দু’টি পথ খোলা আছে— কর বাড়ানো, বা সরকারি ব্যয় কমানো। প্রথম পথটি ট্রাম্প অবশ্যই নেবেন না, যখন ভোটারদের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন কর-হ্রাসের। পড়ে রইল দ্বিতীয় পথ। নির্বিচারে ব্যয় কমানো সরকারি সঞ্চয় বাড়ানোর একটি চটজলদি পথ। ট্রাম্প সরকারের আয়তন কমানোর কথা ভাবছেন। প্রচুর সরকারি কর্মী চাকরি হারাতে পারেন।
প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প আন্তর্জাতিক সহযোগিতায় বিশ্বাস করেন না। তাঁর কাছে এই পৃথিবী একটি হারজিতের ফুটবল প্রাঙ্গণ। আমদানি শুল্ক ট্রাম্পের কাছে একটি কৌশল-অস্ত্র। তবে এই অস্ত্রের প্রভাব আন্তর্জাতিক ভূ-রাজনীতিতে সুদূরপ্রসারী হতে পারে। চিন হয়তো আমেরিকার সঙ্গে সম্পর্ক হ্রাস করে এশিয়ার দেশগুলির সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধবে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের রাষ্ট্রগুলি আমেরিকার থেকে দূরে হাঁটার কথা ভাবছে— ট্রাম্পের পরিবেশ দূষণরোধের অসহযোগিতা আর বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে। এখনও ট্রাম্প ভারতের উপরে বিশেষ আমদানি শুল্ক বসাননি, যদিও হুমকি দিচ্ছেন। সে রকম কিছু ঘটলে ভারতও চিন আর রাশিয়ার দিকে ঝুঁকবে। আমেরিকা একটি নিঃসঙ্গ রাষ্ট্রে রূপান্তরিত হতে চলেছে। গ্রেট আমেরিকা কি এই নিঃসঙ্গতা চেয়েছিল?
অর্থনীতি বিভাগ, ডারহ্যাম ইউনিভার্সিটি
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)