দহন: অগ্নিপথ প্রকল্পের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ প্রদর্শনের সময় বিহারের দানাপুর রেল স্টেশনে ট্রেনে আগুন লাগানো হল। ১৭ জুন ২০২২। পিটিআই
১৯৯০ সালে তাঁর বিখ্যাত বাবার ততোধিক খ্যাত কবিতার পঙ্ক্তি দিয়ে অমিতাভ বচ্চন কাঁপিয়ে দিয়েছিলেন গোটা দেশ— “তু না থকেগা কভি, তু না রুকেগা কভি, তু না মুড়েগা কভি, কর শপথ, কর শপথ, কর শপথ। অগ্নিপথ! অগ্নিপথ! অগ্নিপথ!” সওয়া তিন দশকের ব্যবধানে শব্দটা আবার ফিরে এল ভারতের জনপরিসরে। এই সরকারের কর্ণধাররা প্রথম সারির বিপণন বিশেষজ্ঞদের সাহায্য নিয়ে চলতেই ভালবাসেন— তাঁদের কাছে সারবত্তার চেয়ে চটকের গুরুত্ব বেশি বলেই মনে হয়। ফলে, সেনাবাহিনীতে চার বছরের জন্য জওয়ান নিয়োগ করার অত্যন্ত বিপজ্জনক সিদ্ধান্তটিকেও তাঁরা চটকে মুড়ে পেশ করেছেন। তবে, প্রশ্ন উঠছে, এত দিন যাঁরা দেশের জন্য রক্ত ঝরালেন, তাঁরা কি (অগ্নি)বীর ছিলেন না?
‘অগ্নিপথ’ প্রকল্প নিয়ে বহু দিক থেকে প্রশ্ন তোলা যায়, তোলা জরুরি। আমি সেনাবাহিনীর জায়গা থেকে কিছু প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করছি। ভারতীয় সেনাবাহিনীতে বায়ু, স্থল এবং নৌবাহিনী মিলিয়ে বারো হাজারের বেশি অফিসার, এবং এক লক্ষ কুড়ি হাজারের বেশি সিপাই, নাবিক ইত্যাদি পদ শূন্য রয়েছে গত দু’বছর। ২০১৮ এবং ২০১৯, এই দু’বছরে বেশ কয়েক লক্ষ প্রার্থী সেনাবাহিনীতে যোগদান করার জন্য বিভিন্ন শারীরিক পরীক্ষা এবং মৌখিক ও লিখিত পরীক্ষা দিয়েছিলেন। তাঁদের মধ্যে বেশ কয়েক হাজার অপেক্ষায় ছিলেন পূর্ণ মেয়াদের চাকরিতে যোগদান করার সুযোগের। অতিমারির কারণে পরের দু’বছর সেনাবাহিনীতে নিয়োগ সম্পূর্ণ বন্ধ ছিল। এখন তাঁরা জানতে পারলেন যে, তাঁদের স্বপ্নের অপমৃত্যু ঘটেছে— আপাতত কেবলমাত্র অগ্নিপথেই নিয়োগ হবে। সে বিষয়ে সরকার কোনও উচ্চবাচ্য করেনি। বরং জানিয়েছে, চুক্তির ভিত্তিতে এক-এক বারে ছেচল্লিশ হাজার করে ছেলেকে সেনাবাহিনীতে নেওয়া হবে। এই মুহূর্তে এক সঙ্গে ছেচল্লিশ হাজার প্রার্থীকে প্রশিক্ষণ দেওয়ার পরিকাঠামো ভারতীয় সেনাবাহিনীর নেই। ধরে নিলাম, বহু টাকা ব্যয় করে সেই পরিকাঠামো তৈরি করা হবে— বহু ব্যয় করে এই অগ্নিবীরদের যে প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে, বারো আনা ক্ষেত্রেই চার বছর পরে তার আর কোনও গুরুত্ব থাকবে না।
কর্মসংস্থানের লক্ষ্যে কেন্দ্রীয় গ্রামোন্নয়ন মন্ত্রকের বৃহদাকার প্রকল্প রয়েছে— দীন দয়াল উপাধ্যায় গ্রামীণ কৌশল যোজনা। এই প্রকল্পে নিরস্ত্র বেসরকারি নিরাপত্তারক্ষীর চাকরির জন্য ছয় মাসের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। সেই প্রশিক্ষণ তাঁদের বেসরকারি নিরাপত্তারক্ষীর আধা দক্ষ কাজের জন্য তৈরি করে। সেনাবাহিনীর জন্য এক জন সিপাইকে মাত্র ছয় মাসের প্রশিক্ষণ দিয়ে কী করে সেনাবাহিনীর নিয়মিত জওয়ানদের সঙ্গে একই শ্রেণিতে রাখা হবে, প্রকল্পের রূপকাররা সেই প্রশ্নের উত্তর দেননি। ভারতীয় সেনাবাহিনীতে এখন বিপুল আধুনিকীকরণের কাজ চলেছে। সেই অত্যাধুনিক সমরাস্ত্র প্রশিক্ষণের জন্য কী ভাবে সময় দেওয়া যাবে এবং ক্রমান্বয়ে আধুনিকীকরণের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে এই চুক্তিভিত্তিক সেনা জওয়ানরা নিজেদের দক্ষতাকে আরও পরিশীলিত করে তুলবেন, তাও মাত্র চার বছরের কার্যকালের মধ্যেই, সেই প্রশ্নের উত্তরও প্রধানমন্ত্রী বা প্রতিরক্ষামন্ত্রীর কাছে আছে কি? সেনাবাহিনীর এক-একটা ইউনিটের দায়িত্বে থাকেন যাঁরা, তাঁরাই বা পুরো মেয়াদের সৈনিক আর অগ্নিবীরদের উপর এক রকম ভরসা করবেন কী করে? দক্ষতা অর্জনের জন্য এক জনকে যতখানি সময় দিতেই হয়, তার কণামাত্র সময় দিয়ে কি সমান দক্ষ সৈনিক পাওয়া সম্ভব?
পৃথিবীর যে কোনও সেনাবাহিনীতেই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল পারস্পরিক বিশ্বাস, ভ্রাতৃত্ববোধ এবং নির্ভরতা। এই চুক্তিভিত্তিক অগ্নিপথের জন্য সেটা আঘাতপ্রাপ্ত হবে; হবেই। যেখানে বলা হচ্ছে যে, মাত্র পঁচিশ শতাংশ অগ্নিবীর চার বছর পরে পুরো মেয়াদের বা অন্তত আরও ১৫ বছরের জন্য সুযোগ পাবেন, বাকিদের হাতে কিছু টাকা তুলে দিয়ে বিদায় করা হবে— সেখানে আশঙ্কা থেকেই যায় যে, যুদ্ধক্ষেত্রে পাশাপাশি লড়তে থাকা চার জন সিপাই-ই ভাবতে থাকবেন যে, আমাদের মধ্যে মাত্র এক জনই আগামী দিনে সেনাবাহিনীতে থাকতে পারবে, বাকিদের কর্মচ্যুত হতে হবে বা তুলনামূলক ভাবে কম সম্মানজনক জীবন বেছে নিতে হবে। এই পরিস্থিতিতে পারস্পরিক বিশ্বাস, নির্ভরতা, ভ্রাতৃত্ববোধ তৈরি হবে কি?
পঞ্জাব, হিমাচল, উত্তরাখণ্ড, উত্তরপ্রদেশ, বিহার, মধ্যপ্রদেশ, মহারাষ্ট্র ইত্যাদি রাজ্যতে গ্রামাঞ্চলে একটি সুস্পষ্ট সামাজিক বিন্যাস রয়েছে— বহু গ্রামেই অনেক মানুষ হয় সেনাবাহিনীতে চাকরি করছেন, অথবা অবসরপ্রাপ্ত সেনাকর্মী হিসাবে সম্মানজনক জীবনযাপন করছেন। এই বার সেখানে এক নতুন সামাজিক বিন্যাস তৈরি হবে— যাঁরা পুরো সময়ের, পুরো মেয়াদের সেনাকর্মী, এবং যাঁরা চার বছরের চুক্তিভিত্তিক তথাকথিত সেনাকর্মী— তাঁদের মধ্যে সামাজিক জীবনেও সংঘাতের সম্ভাবনা থেকেই যাবে। ভারতীয় সেনাবাহিনীতে এক নতুন জাতিভেদ প্রথা চালু হতে চলেছে— পূর্ণ মেয়াদের সৈনিক এবং চার বছরের ভাড়াটে সেনা। এই সংঘাতের পরিণতি কী হবে, নেতারা ভেবেছেন কি?
এতে সন্দেহের কোনও অবকাশ নেই যে, বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকার বিভিন্ন সময়ে সেনাবাহিনী বা রাষ্ট্রীয় সুরক্ষাকে তাদের দলীয় লাভ-লোকসানের অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেছে— সে পুলওয়ামা হোক, বা উরি, অথবা বালাকোট। একটি বিরাট গুজব ভারতীয় নিরাপত্তা বাহিনীর এবং বিশেষ এজেন্সিগুলোর আনাচেকানাচে ঘুরে বেড়াচ্ছে— সামনের লোকসভা নির্বাচনের আগেই একটা বড় অ্যাডভেঞ্চারের আয়োজন চলেছে। হয়তো পাক অধিকৃত কাশ্মীর পুনর্দখলের পরিকল্পনা হচ্ছে। এই অ্যাডভেঞ্চার সত্যিই হলে তা ভারতের সমাজজীবনে, অর্থনীতিতে, বিদেশনীতিতে, দেশের সামগ্রিক ভাবমূর্তিতে কতটা প্রভাব ফেলবে, সেই প্রশ্নের উত্তর এখনও ভবিষ্যতের গর্ভে— কিন্তু, আশঙ্কা হচ্ছে, এই পরিকল্পনারই অংশ নয় তো অগ্নিপথ? উগ্র দেশপ্রেমের হাওয়াকে আগে থেকেই জোরালো করার চেষ্টা?
এই প্রসঙ্গে আরও আশঙ্কার কথা বলি— কারা চাকরি পাবেন অগ্নিপথ প্রকল্পে? কিছু বাচ্চা ছেলেমেয়ে, যাদের বেশির ভাগের মনই এখনও রাজনীতির ভাল-মন্দ বিচারের জন্য তৈরি নয়। এই ফাঁক গলেই সেনাবাহিনীর এত যুগের সযত্নলালিত ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্রটি নষ্ট করার ব্যবস্থা হবে না তো? হিন্দুত্ববাদী রাজনীতি যে ভাবে সেনাবাহিনীকে নিজেদের রাজনৈতিক প্রয়োজনে ব্যবহার করতে অভ্যস্ত, তাতে এই আশঙ্কাটি উড়িয়ে দেওয়ার নয়। এই যে চুক্তিভিত্তিক কয়েক লক্ষ তরুণ এবং যুবককে নেওয়া হচ্ছে এবং হবে, সামান্য প্রশিক্ষণ দিয়ে তাঁদের সেনাবাহিনীর অংশ করে দেওয়ার পরিকল্পনার মধ্যে ইতিহাসের এক কালো অধ্যায়ের ছাপ বড় আশঙ্কাজনক রকম স্পষ্ট। হিটলারের জার্মানিতে এ ভাবেই জন্ম হয়েছিল ‘এসএস’-এর (শুৎজ়স্টাফেল, বা রাজনৈতিক সৈনিকবাহিনী)— যাকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ইতিহাসবিদরা আখ্যা দিয়েছিলেন ‘রাষ্ট্রের ভিতর স্বতন্ত্র রাষ্ট্র’। বা, সেনাবাহিনীর অন্তত পার্শ্বিক বেসরকারিকরণের পথে কি এটা প্রথম ধাপ? তিন বাহিনীর প্রধানকে অগ্নিপথ প্রকল্পের সাফাই গাওয়ার জন্য সাংবাদিক সম্মেলনে বসতে হচ্ছে। আগে কিন্তু কখনও সরকারের সিদ্ধান্তকে সমর্থন করার জন্য সেনাকর্তাদের মাঠে নামতে হয়নি। নামানো হয়নি বলেই। সেনাকে রাজনীতির দৈনন্দিনতার ঊর্ধ্বে রাখার সযত্নলালিত নীতিটি এ ভাবে বিসর্জন দিতে হচ্ছে কেন, ভাবা দরকার।
অতএব, সাধু সাবধান! সেনাবাহিনীকে যে ভাবে সঙ্কীর্ণ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা হচ্ছে, তা ভারতীয় গণতন্ত্রের পক্ষে এক মারাত্মক পর্বের সূচনা। ইতিহাস সাক্ষী দেয় যে, পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে রাষ্ট্রীয় সুরক্ষার নামে সমাজজীবনে রাষ্ট্রের অনুপ্রবেশ ঘটে স্বৈরাচারের রূপ ধরে। সাধারণ নাগরিকরা হঠাৎই এক দিন আবিষ্কার করেন যে, তাঁদের সংবিধানসম্মত গণতন্ত্র নিষ্পেষিত, ভূলুণ্ঠিত, সম্পূর্ণ ভাবে ধ্বস্ত। বর্তমান জমানার অধীনে ভারতের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তার যথেষ্ট কারণ থাকল।
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, Twitter এবং Instagram পেজ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy