আফগানিস্তান থেকে বিদেশি সৈন্য চলে যাওয়ায় এখন তালিবান শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে সেখানে। দেশে বিদেশি সেনার উপস্থিতি সত্যিই আপত্তিকর, কিন্তু তার উল্টো পিঠ? তালিবানি শাসনে ফতোয়ার বেশির ভাগটাই মহিলাদের বিরুদ্ধে। যেমন, পনেরো বছরের বেশি বয়সি মেয়েদের তালিকা বানানো হবে। মেয়েরা একা বাড়ির বাইরে বেরোতে পারবে না। কোনও পুরুষ পাশে না থাকলে প্রকাশ্য স্থানে আসতে পারবে না।
না, মেরিল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে মনস্তত্ত্বের অধ্যাপিকা মিশেল গেলফান্ড কিন্তু আফগানিস্তান দেশটাকে ধর্তব্যের মধ্যে আনেননি। যদি আনতেন, অবশ্যই তিনি ওখানকার সমাজকে ‘টাইট’ হিসাবে এক নম্বরে রাখতেন। নানা দেশের সমাজে সমীক্ষা চালিয়ে তিনি ‘টাইট’ (আঁটোসাঁটো) আর ‘লুজ়’ (ঢিলেঢালা)-এ বিভক্ত করেছেন তাদের। টাইট দেশের পয়লা নম্বরে আছে পাকিস্তান। তার পর মালয়েশিয়া। ভারত? তার পরেই, অর্থাৎ তিন নম্বরে। তার পরে সিঙ্গাপুর। তার পরে দক্ষিণ কোরিয়া নরওয়ে তুরস্ক জাপান চিন। গেলফান্ড এবং তাঁর সতীর্থরা বিশ্বাস করেন, কোন দেশের সমাজ কত আঁটোসাঁটো বা ঢিলেঢালা, তা অনেক কিছুর উপর প্রভাব ফেলে। দেশের মানুষ কতটা সৃষ্টিশীল, দেশে স্বামী-স্ত্রীর বিবাহবিচ্ছেদের হার কী রকম, এই সব।
কিসের ভিত্তিতে এই হিসাব? ছ’টা ফ্যাক্টর ধরেছেন গেলফান্ড। ১) ইন্ডিভিজুয়ালিজ়ম বা ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য, ২) পাওয়ার ডিসট্যান্স: ক্ষমতার বৈষম্য নাগরিকরা কতটা মেনে নেয়, ৩) ম্যাসকুলিনিটি: সমাজ কতটা মেনে নেয় যে, বলপ্রয়োগে প্রশ্নের সমাধান সম্ভব, ৪) আনসার্টেনটি অ্যাভয়ডেন্স: অজানার মুখোমুখি হতে মানুষ কতটা উদ্বিগ্ন হয়; ৫) লং-টার্ম ওরিয়েন্টেশন: অতীত থেকে ভবিষ্যতে চলার শিক্ষা, না কি যখন যেমন তখন তেমন চলা, ৬) ইনডালজেন্স: জীবনকে একটা যুদ্ধ না ভেবে, অন্যের স্বাধীনতাকে মূল্য দেওয়া। বোঝা যাচ্ছে, ওই সব নিরিখে ভারতের পিছিয়ে থাকাই প্রত্যাশিত, ভারতের বর্তমান সরকােরর মন্ত্র তো বহুত্ববাদ নয়, তার ধুয়ো— এক দেশ এক চিন্তা।
এমনকি যে চিন, যেখানে একদলীয় শাসন, প্রতিবাদ নেই কোনও কিছুতে, সে দেশের সমাজও ভারতের তুলনায় ঢিলেঢালা! শোনা যায়, প্রতিবাদ না থাকায় চিনের সরকার যে প্রকল্পে যত খুশি খরচ করতে পারে, তাই সে দেশের সমাজও গেলফান্ডের হিসাবে ভারতের থেকে ঢিলা। ওই ছয় ফ্যাক্টরের মাপে গেলফান্ড এক স্কেল নির্ধারণ করেছেন। মোট মাপ ১২। গড় হল ৬-এর উপরে। এই গড় মাপের সামান্য উপরে আছে ব্রিটেন, ইটালি, অস্ট্রিয়া। একদম গড় মাপ বরাবর জার্মানি। অর্থাৎ, ও দেশের সমাজ আঁটোসাঁটো নয়, আবার ঢিলেঢালাও বলা যাবে না তাকে। ওই গড় মাপের সামান্য একটু নীচে রয়েছে আয়ার্ল্যান্ড, ফ্রান্স এবং পোল্যান্ড। আমেরিকা? গড় মাপের যথেষ্ট নীচে।
১৯৬০-এর দশকেই শুরু হয় ভিন্ন ভিন্ন সমাজ কতটা টাইট বা লুজ়, সেই বিশ্লেষণ। কানেকটিকাট বিশ্ববিদ্যালয়ে নৃতত্ত্বের অধ্যাপক পারটি পেলটো ২১টি সমাজ নিয়ে পরীক্ষা করেন। ওঁর সমীক্ষায় ইউরোপের হাটারাইট গোষ্ঠীর লোকেরা (জ্যাকব হাটার-এর অনুগামীরা) সবচেয়ে বেশি আঁটোসাঁটো। আর, সবচেয়ে বেশি ঢিলেঢালা হল আফ্রিকার কুং জনগোষ্ঠী, যারা ভূতপ্রেতে বিশ্বাস করে। পেলটোর সমীক্ষায় ধরা পড়ে, একটা সমাজ কেমন হবে, তা নির্ভর করে ইকোলজি বা পরিবেশগত কারণে। যেমন, যে জায়গায় জনসংখ্যা প্রতি বর্গকিলোমিটারে বেশি, সে জায়গার সমাজ আঁটোসাঁটো হতে বাধ্য। যেখানে মানুষ জীবনধারণের জন্য কৃষিজাত পণ্যের উপর খুব বেশি করে নির্ভরশীল, সেখানকার সমাজ টাইট। এখন পুরনো দিন নেই, প্রযুক্তি এসেছে। এখন দেশে দেশে মানুষের কৃষির উপর নির্ভরতা কমেছে। প্রযুক্তিজাত পণ্যের উপর নির্ভর করে এখন অনেক মানুষ জীবিকা নির্বাহ করে। এই নতুন পরিস্থিতিতে এখন কোন সমাজ কতটা টাইট বা লুজ়, তা নির্ধারণ করতে গিয়েছিলেন গেলফান্ড। তিনি দেখেন, আধুনিক সভ্যতা আঁটোসাঁটো বা ঢিলেঢালা হওয়ার ব্যাপারে পরিবেশগত দুর্ঘটনা (ভূমিকম্প, দুর্ভিক্ষ) এবং মানুষের তৈরি কারণের (যুদ্ধবিগ্রহ) উপর নির্ভর করে। আঁটোসাঁটো ভাব আসে সমাজের সদস্যদের সমন্বয় থেকে। দুর্ঘটনা ওই সমন্বয় বাড়ায়।
রাজনীতি ফ্যাক্টরটাকে সাধারণত ধর্তব্যের মধ্যে আনা হয়নি। হয়তো, ওঁদের মতে, রাজনীতি সমাজ থেকেই উঠে আসে। ব্যাপারটা সেই ডিম না মুরগি— কে আগে, সে ধরনের প্রশ্ন। সমাজ থেকে রাজনীতি উঠে আসে, না কি রাজনীতি সমাজের জন্ম দেয়? ইতিহাসের দিকে তাকানো যাক। নাৎসিবাদ এবং হিটলার ঘৃণ্য বটেই, কিন্তু মনে রাখা ভাল, দলে দলে জার্মানরাও, এমনকি ইন্টেলেকচুয়ালরাও, হিটলারের অন্ধ ভক্ত হয়ে উঠেছিলেন।
ধরে নেওয়া হয়, নাগরিকের বা ভোটারের দোষ থাকতে পারে না। সে ধোয়া তুলসীপাতা। যত দোষ কতিপয় ব্যক্তির, যেমন হিটলারের। ভারতে এখন যে রাজনীতির জয়জয়কার, তাতে সমাজের ভূমিকা আছে কি নেই, থাকলে কতটা, এটাই প্রশ্ন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy