গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
কলকাতা পুজোর যাঁরা উদ্যোক্তা, তাঁরা এক এক জন এক একটা চরিত্র। কেউ নিজের সমস্ত পুঁজি উজাড় করে দিচ্ছেন পুজোর জন্য। কেউ বন্ধক রাখছেন মা, বৌয়ের গয়না। কেউ অবসরের পরে মোটা টাকার পেনশন পাচ্ছিলেন। সন্তানেরা চাকরি করেন। কিন্তু সুখ সইল না। প্রাণ কেঁদে উঠল পাড়ার পুজোর জন্য। পাড়ার পুজোকে ভালবাসেন বলে বিদেশ-বিভুঁইয়ে পাড়ি দিয়েছেন চাকরি করতে। হাত পুড়িয়ে খেয়েছেন। ওই চাকরির পুরো টাকাটা খরচ করেছেন পুজোর পিছনে।
শিল্পীদের মধ্যেও নানা চরিত্রের সমাগম। কেউ কোনও একটা পুজোকে ভালবেসে নিজের পকেট থেকে টাকা খরচ করে সেই পুজোকে উতরে দেন। কেউ এমন থিম তৈরি করেন, যেখানে ৫০ জনের অন্ন সংস্থানের ব্যবস্থা হয়। কোনও শিল্পী আবার ঝোপ বুঝে কোপ মেরে উদ্যোক্তাদের পকেট ফাঁকা করে দেন।
কোনও কোনও উদ্যোক্তা আবার বছর বছর শিল্পী, ডেকরেটরদের পাওনা ফেলে রাখেন। অথচ পুজোর আয়োজনে খামতি নেই।
পুজো উদ্যোক্তা ও শিল্পীদের কয়েক জনকে নিয়ে সাজিয়েছি নকশার ফোঁড়। এই নকশার ফোঁড় লেখা হয়েছে কলকাতার এমন দু’টি পুজোকে নিয়ে, যার জনপ্রিয়তা এতটুকুও কমেনি কখনও। উদ্যোক্তাদের মধ্যে রয়েছেন এমন দু’জন রয়েছেন, যাঁরা জনপ্রিয়তায় উত্তম কুমারের কাছাকাছি। জোড়া উত্তম কুমার। এক জন প্রয়াত। কিন্তু পুজো চলেছে স্বমহিমায়। অন্য জন ব্যাটন তুলে দিয়েছেন ছেলের হাতে।
এক জন দক্ষিণের। অন্য জন উত্তরের। একডালিয়া এভারগ্রিনের সুব্রত মুখোপাধ্যায় আর সন্তোষ মিত্র স্কোয়ার বা লেবুতলা পার্কের প্রদীপ ঘোষ। দুটো পুজোর ভৌগোলিক অবস্থান সাহায্য করলেও, পুজোর প্রতি ওই দুই প্রবীণ রাজনীতিকের দায়বদ্ধতাই সব পুজোর প্রতিযোগিতার ঊর্ধ্বে নিয়ে গিয়েছে ওই দু’টি পুজোকে।
একটা সময়ে খুব কাছ থেকে আমি ওই সব পুজোর মূল উদ্যোক্তাদের দেখেছি। সুব্রত মুখোপাধ্যায়কে পুজোর সময় পাওয়া খুব সোজা ছিল। রাতের কয়েক ঘণ্টা ঘুম ছাড়া, সুব্রতবাবুকে সর্ব ক্ষণই পাওয়া যেত একডালিয়া এভারগ্রিনের মণ্ডপে। কর্তা হয়ে মঞ্চে বসে থাকতেন না সুব্রত মুখোপাধ্যায়, পুজোর খুঁটিনাটির দিকেও নজর রাখতেন। ৩০ বছর ধরে এমনটাই দেখেছি ওই প্রবীণ নেতাকে।
আর এক জন সন্তোষ মিত্র স্কোয়ারের প্রদীপ ঘোষ। পুজোর এক মাস আগে থেকে ঘুম থেকে উঠে আর ঘুমোতে যাওয়ার আগে পর্যন্ত মণ্ডপেই কাটত মানুষটির। পারলে স্নান-খাওয়াটাও নির্মীয়মান মণ্ডপেই হয়। আর পুজোর চার দিন ভরদুপুরে কিংবা মাঝরাতে ভিড় ঠেলে মণ্ডপে ঢুকে মঞ্চে প্রদীপদার কাছে পৌঁছে যেতে পারলেই হল। বাকিটা ‘কেয়ার অফ প্রদীপদা’।
গড়িয়াহাট রোডের পশ্চিম দিকে একডালিয়া এভারগ্রিন। পূর্ব দিকে সিংহি পার্ক। সেটাও বড় পুজো। কিন্তু দীর্ঘ দিনের অভিজ্ঞতায় দেখেছি রাতে ভিড়ের তুল্যমূল্য বিচারে একডালিয়ার থেকে অনেকটাই পিছিয়ে সিংহি পার্ক। কেন? কারণটা খুব সরল। অধিকাংশ দর্শনার্থী একটা পুজোর আশপাশে সব পুজো ঘুরে দেখতে চান। কিন্তু রাতের কলকাতায় যান নিয়ন্ত্রণের দুর্বিপাকে এক বার একডালিয়ার পুজোর ভিড়ে ঢুকে পড়লে, নিজের ইচ্ছায় বার হওয়া শক্ত। সেই ভিড়টা দর্শনার্থীদের এমন জায়গায় নিয়ে গিয়ে ফেলবে যে, সেখান থেকে অনেকটা ঘুরে সিংহি পার্কের পুজো দেখার উৎসাহ আর থাকে না মানুষের। মাঝখান থেকে পোয়াবারো ফাল্গুনী সংঘের। একডালিয়া পার্কের ঠাকুর দেখে বেরোনোর পথে ওই পুজোটি সবাইকে দেখতেই হয়।
আমরা যখন পুজো নিয়ে লেখালেখি শুরু করি তখন শিয়ালদহ অঞ্চলে দু’জন প্রদীপ ঘোষ ছিলেন। এক জন রেলের ট্রেড ইউনিয়ন করতেন। তাঁকে আমরা বলতাম রেল প্রদীপ। আর আর এক জন লেবুতলার কংগ্রেস নেতা প্রদীপ ঘোষ। প্রথম যে দিন ওই প্রদীপ ঘোষের সঙ্গে কথা বলে অফিসে এলাম, অগ্রজেরা জানতে চাইলেন কোন প্রদীপ? রেল প্রদীপ না গালকাটা প্রদীপ? পরে ভাল ভাবে নজর করে দেখেছি, লেবুতলার প্রদীপ ঘোষের গালে একটা লম্বা কাটা দাগ!
দুই প্রদীপই জাঁকজমক করে দুর্গাপুজো করতেন। এক জন শিয়ালদহ স্টেশন সংলগ্ন কাইজ়ার স্ট্রিটে। অন্য জন লেবুতলা পার্কে। পোশাকি নাম সন্তোষ মিত্র স্কোয়ার।
আনন্দবাজারে আমরা মণ্ডপে ভিড়ের লড়াইয়ের একটা প্রতিযোগিতা করতাম। কলকাতা পুলিশের কাছ থেকে তথ্য নিয়ে রাতের তিন সময়ে ঘড়ির কাঁটা ধরে ভিড়ের হিসাব দিতাম। সেরা পুজো জিতত উৎসব কাপ। প্রথম কয়েক বছর ওই লড়াইয়ে প্রথম দু’টি জায়গায় থাকত সন্তোষ মিত্র স্কোয়ার আর একডালিয়া পার্ক। খুব কাছাকাছি থাকত রেল প্রদীপদার পুজো, কলেজ স্কোয়ার আর মহম্মদ আলি পার্ক। অন্যেরা কেউ তালিকায় ঢুকতেই পারত না। আমরা তাই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, ওই চারটি পুজোকে বাদ দিয়েই আমরা উৎসব কাপের প্রতিযোগিতা করব।
তাতে অবশ্য সুব্রত মুখোপাধ্যায় বা প্রদীপ ঘোষের কিছু যায় আসেনি। সুব্রতদা আমাকে মজা করে বলেছিলেন, ‘‘একডালিয়ার পুজো দেখতে মানুষ আসবেই। কে লিখল বা না-লিখল তাতে কিছু যায় আসে না।’’ একই প্রতিক্রিয়া প্রদীপ ঘোষেরও ছিল। দু’জনের আর একটা ব্যাপারে ছিল দারুণ মিল। দু’টি পুজোই কিন্তু কোনও পুরস্কারের ধার ধারে না। তাই কোনও প্রতিযোগিতাতেই নেই ওঁরা দু'জন। সেই সময় অতীন ঘোষ, অরূপ বিশ্বাস, দেবাশিস কুমার, ববি হাকিমেরা তেমন ভাবে পুজো সংগঠনে আসেননি। থিম পুজো সবে হাঁটি হাঁটি পা পা। বেহালায় সবে মানুষ যেতে শুরু করেছেন। দড়ি দিয়ে মণ্ডপের সামনে মানুষকে আটকে কিংবা সরু গলিতে একসঙ্গে ঢুকিয়ে ‘মেকি’ ভিড় দেখানোর কারসাজির প্রয়োজন হয়নি।
আর একটা বিষয়ে দু’জনের বড় মিল। দু’জনের মনের গভীরতার তল পাওয়া ভার। তখন আমাদের পুজোর তিন দিন (দশমী বাদ দিয়ে) অফিস খোলা থাকত। আমরা পালা করে ডিউটি দিতাম। যারা পুজো রিপোর্টিং করতাম, তাদের তিন দিনই অফিসে আসতে হত। তবে আমাদের সারা দিনের খাবারের চিন্তা থাকত না। সৌজন্যে সুব্রত মুখোপাধ্যায় এবং প্রদীপ ঘোষ। সপ্তমী আর অষ্টমীর দুপুরে গাড়ি এসে থামত অফিসের গেটে। সেখান থেকে নামত একের পর এক প্যাকেট। এক দিন পাঠাতেন সুব্রতদা। অন্য দিন প্রদীপদা। নবমীর খাবার কখনও আসত অবসর, কখনও হিন্দুস্তান পার্ক, কখনও বা খিদিরপুর ২৫ পল্লি থেকে। ৫৬ ভোগ আসত কাশী বোস লেন থেকে। ঘুরিয়ে ফিরিয়ে। ২৪ ঘণ্টাই মণ্ডপে ভিড় উপচে পড়ছে। নাওয়া-খাওয়ার সময় পাওয়া যাচ্ছে না। ভিভিআইপি সামলাতে হচ্ছে নিজেদের। কিন্তু দুপুরে একটা ফোন আসত, ‘‘কাউকে নীচে পাঠাও।’’ একডালিয়া আর সন্তোষ মিত্র স্কোয়ায়ের দুই দাদা কিন্তু আদি ও অকৃত্রিম। কখনও ভুল হত না।
থিম পুজো একটু একটু জনপ্রিয় হওয়ার পরে অনেকে ভবিষ্যৎবাণী করেছিলেন, পুজোর ভিড়ের অভিমুখ অন্য দিকে ঘুরল বলে! ৫ বছর গেল, ১০ বছর গেল, ২০ বছর গেল— পুজোর ভিড়টা গোটা শহরে, শহরতলিতে ছড়িয়ে পড়ল। ওই একই ঘরানার সুজিত বসুর শ্রীভূমি স্পোর্টিং ক্লাব এখন সুপারডুপার হিট। তবুও উত্তর ও দক্ষিণের ওই দুই দাদার পুজোকে ভিড়ের লড়াইয়ে পিছনে ফেলতে পারল না কেউ। জনপ্রিয়তার নিরিখে ওঁরা দু’জন এখনও উত্তম কুমার।
(মতামত নিজস্ব।)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy