কাজের সূত্রে দেশের নানা প্রান্তের স্কুলে যাওয়ার অভিজ্ঞতা হয়েছে— প্রত্যন্ত গ্রামে, ছোট শহরে, আবার বড় বড় শহরের বস্তিতেও। প্রতিটি স্কুলের একটি নিজস্ব পরিচিতি রয়েছে, যা তারই বিশিষ্ট রূপ। ক্লাসঘরে কী ঘটছে, শিশুরা কেমন গল্প করছে, ভাগ করে নিচ্ছে এটা-ওটা, খেলার মাঠে পরস্পর কেমন বোঝাপড়া, স্থানীয় পরিবেশ কেমন, এই সব দিয়ে স্কুলের নিজস্ব চরিত্র তৈরি হয়। তেমনই একটা স্কুল দেখেছিলাম মালদহে।
‘মালদহ’ শুনলেই পশ্চিমবঙ্গের বাইরের মানুষের চোখে ভেসে ওঠে আমের ছবি। সত্যিই, ট্রেন মালদহ স্টেশনে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গেই চার দিকে দেখা যায় আমের বাগান। যে স্কুলের কথা বলছি, সেটা জেলা সদর থেকে খুব দূরে নয়— ঘণ্টাদুয়েকের মধ্যেই পৌঁছে যাওয়া যায় সেখানে। রাস্তাও ভাল। একেবারে শেষে মহানন্দা নদীর কাছে যাওয়ার জন্য খানিকটা হেঁটে যেতে হয় সরু একটা রাস্তা দিয়ে, কাদায় যা বেশ পিছল হয়ে থাকে। সেখানে অপেক্ষা করছে একটা লম্বা কাঠের নৌকা। তাতে করে যেতে হবে অন্য ধারে। সবাই সেই নৌকায় উঠে পড়ে ব্যাগ, বস্তা, বাক্স নিয়ে। সাইকেল, ছাগলও উঠে পড়ে সেই নৌকায়। স্কুলের সময় অবশ্য নৌকা ভরে থাকে স্কুলের ইউনিফর্ম পরা, পিঠে ব্যাগ-নেওয়া ছেলেমেয়েদের ভিড়ে।
ও পারে পৌঁছে, ঢালু জমি বেয়ে উঠে, আমবাগানের মধ্যে দিয়ে খানিক হাঁটলেই এসে পড়ে স্কুলের অঙ্গন। স্কুলবাড়িটা ছোট, নীল আর সাদায় পরিপাটি রং করা। বোঝা যায় যে, এই বাড়িটা তৈরি হয়েছে আর এর রক্ষণাবেক্ষণ হচ্ছে, যত্নে, ভালবাসায়, খুব মনোযোগের সঙ্গে। স্কুলের গেট থেকে স্কুলবাড়ি পর্যন্ত রাস্তায় নীল আর সাদা চৌখুপি আঁকা। প্রতিটি চৌকোনা বাক্সের মধ্যে ইংরেজি এবং বাংলার এক-একটি অক্ষর লেখা আছে। বারান্দা ঘিরে ফুলগাছ আর ঝোপ। শান্ত, সুন্দর পরিবেশ।
কিন্তু সব সময়ে স্কুলটার এমন অপরূপ চেহারা ছিল না। ষাট বছর আগে এই স্কুলটি স্থাপন করেছিলেন পঞ্চায়েতের মানুষজন। তখন এটা ছিল কেবল মাটির একটা ঘর। গ্রামের মানুষ চেয়েছিলেন, শহরের ছেলেময়েদের মতো তাঁদের সন্তানরাও শিক্ষার সুযোগ পাক। ১৯৮৬ সালে মহানন্দা নদী স্কুলটা ভাসিয়ে নিয়ে যায়। গ্রামবাসীরা খুব তাড়াতাড়ি আবার তা বানিয়ে ফেলেন। এর কয়েক বছর পর সরকারি টাকায় পাঁচটি ঘর-সহ একটি পাকা স্কুলবাড়ি তৈরি হয়। কিন্তু সেখানেই থেমে যাননি গ্রামবাসীরা। শিক্ষকদের সঙ্গে তাঁরাও হাত লাগালেন স্কুলবাড়িটির সৌন্দর্যায়নের কাজে, যাতে শিশুদের কাছে সেটি আকর্ষণীয় হয়। এত বছর পরও স্কুলবাড়িটা ঝকঝক করছে, যেন গত কালই তৈরি।
ওই শিশুরাও তাদের স্কুলবাড়ির মতো— বা বলা ভাল, ওই স্কুলবাড়িটি তার ছাত্রছাত্রীদের মতো— আনন্দে ভরপুর, রঙিন। যখন শিশুরা আর শিক্ষকরা একে অন্যের সঙ্গে থাকতে পছন্দ করে, তখন শেখানো আর শেখা, দুটোই কার্যকর এবং শক্তপোক্ত হয়। স্কুলে থাকতে যদি শিশুদের ভাল লাগে, তা হলে স্কুলে তাদের উপস্থিতি নিয়ে কোনও সমস্যা হয় না, শিক্ষকদের স্কুলে থাকাও নিশ্চিত। স্কুলে যা কিছু হচ্ছে, তাতে যদি অভিভাবকরা খুশি থাকেন, তা হলে তাঁদের সমর্থন ও সহযোগিতা পাবে স্কুল, এ বিষয়ে সন্দেহ থাকে না।
স্কুলে অতিথি আপ্যায়ন হল চমৎকার। একটা বড় পান পাতা, একটা পাকা আম, আর কিছু ফুল দেওয়া হল। নিয়মিত বিভিন্ন স্কুল পরিদর্শনের অভিজ্ঞতায় জানি যে, শিক্ষকরা নিয়মরক্ষার জন্য নানা সৌজন্য দেখান। এখানে একেবারেই তা নয়। প্রধানশিক্ষক উৎসাহ দিলেন প্রতিটি ক্লাসে গিয়ে শিশুদের সঙ্গে সময় কাটাতে। বড়-ছোট, সব ছেলেমেয়ের সঙ্গে কথা বলে মনে হল, অতিথিদের সঙ্গে কথা বলতে ওরা অভ্যস্ত। গল্প করতে, মতামত জানাতে ওরা বেশ আগ্রহী। বেশির ভাগ সময়েই তারা স্বচ্ছন্দে কথাবার্তা বলছিল— এক-এক সময়ে শিক্ষক কোনও শিশুকে উৎসাহ দিচ্ছিলেন কথাবার্তায় যোগ দিতে। এই সব কথোপকথনে জানা গেল, সকলে বই ভালবাসে, গল্প ভালবাসে। আমরা ঠিক করলাম যে, ছেলেমেয়েরাও একটা বই লিখবে, শিক্ষকদের সঙ্গে। গল্প তৈরি, লেখা, আঁকা, সব করবে স্কুলের সকলে।
ফেরার সময়ে স্কুলের সকলে চলে এল নদীর ধারে বিদায় জানাতে। পাকা আম উপহার দিল তারা। আমাদের নৌকা নদী পেরিয়ে ওই ঘাটে না পৌঁছনো অবধি শিশুরা দাঁড়িয়ে রইল। হাত নাড়তে থাকল।
কিছু দিন পরে হাতে এল একটি পুস্তিকা। মালদহের সেই স্কুলের সকলে সেখানে গল্প লিখেছে। যদি ভারতের প্রতিটি স্কুলের পড়ুয়া আর শিক্ষকরা নিজেদের গল্পের বই লিখত, কী ভালই না হত!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy