Advertisement
০৫ নভেম্বর ২০২৪
প্রবন্ধ ১

পরিবেশ দুয়োরানিই থেকে গেল

ভারতে আমাদের রাজ্যই প্রথম পরিবেশ দফতর চালু করে। বামফ্রন্ট সরকার কিন্তু পরিবেশ নিয়ে কখনওই কঠোর হতে পারেনি। দু’দিক বাঁচিয়ে চলার প্রবণতাই ছিল বেশি। আজকের পোস্ট-মার্কসিস্ট সরকারও মনে হয় সেই রাস্তা ধরেই চলছে।পরিবেশকে যাঁরা ভালবাসেন, আমাদের জীবনে পরিবেশের মূল্য বোঝেন, তাঁদের কাছে গ্রিন সিগন্যাল কথাটির মানে ‘সবুজের সংকেত’। কোথাও সবুজের অস্তিত্ব বিপন্ন হলে তাঁরা দেখেই বুঝতে পারেন। আর যাঁদের পরিবেশ নিয়ে বিশেষ মাথাব্যথা নেই, সরকারি অনুমোদনের জন্য প্রকল্প জমা দিয়ে বসে আছেন, এক দিনের দেরিতে যাঁদের লক্ষ টাকার ক্ষতি, তাঁদের জন্য গ্রিন সিগন্যাল হল ‘সবুজ সংকেত’।

অর্ধেন্দু সেন
শেষ আপডেট: ১৪ মে ২০১৫ ০০:০১
Share: Save:

পরিবেশকে যাঁরা ভালবাসেন, আমাদের জীবনে পরিবেশের মূল্য বোঝেন, তাঁদের কাছে গ্রিন সিগন্যাল কথাটির মানে ‘সবুজের সংকেত’। কোথাও সবুজের অস্তিত্ব বিপন্ন হলে তাঁরা দেখেই বুঝতে পারেন। আর যাঁদের পরিবেশ নিয়ে বিশেষ মাথাব্যথা নেই, সরকারি অনুমোদনের জন্য প্রকল্প জমা দিয়ে বসে আছেন, এক দিনের দেরিতে যাঁদের লক্ষ টাকার ক্ষতি, তাঁদের জন্য গ্রিন সিগন্যাল হল ‘সবুজ সংকেত’। যুযুধান এই দুই পক্ষের মাঝখানে প্রায় তিন বছর আটকা পড়ে ছিলেন জয়রাম রমেশ। যখন তিনি ভারত সরকারের পরিবেশ মন্ত্রী, সেই সময়ের অভিজ্ঞতার কথা তিনি লিখেছেন তাঁর ‘গ্রিন সিগন্যালস’ নামক বইয়ে। আশা করি, সব পরিবেশ সচেতন মানুষই বইটি পড়বেন। আমি কোনও দিন পরিবেশ দফতরে কাজ করিনি। অভিজ্ঞতা সীমিত। তাও দু-চার কথা বলি।

এ দেশে সরকারি স্তরে পরিবেশচিন্তা শুরু করেন ইন্দিরা গাঁধী। সেই সূত্রেই আমাদেরও নতুন কথা শিখতে হয়েছিল। যেমন, কালিম্পং শহরের তীব্র জলকষ্ট মেটাতে রাজ্য সরকার উদ্যোগ নিয়েছিল নেওরাখোলায় জলপ্রকল্প তৈরি করে সেখান থেকে জল নিয়ে আসার। যেখানে এই প্রকল্প তৈরি হবে, সে জায়গাটি ঘন জঙ্গলে ঘেরা। কোথাও লোকবসতি নেই। নেওরা উপত্যকা অনেকটা কেরলের ‘সাইলেন্ট ভ্যালি’র মতোই। প্রকল্প করতে গেলে তার পরিবেশের ক্ষতি হবে। ইন্দিরা গাঁধী প্রকল্পটি অনুমোদন করলেন না। আমরা অবাক— আগে তো মানুষ বাঁচবে, তার পর তো পরিবেশ!

সেই সমস্যা মিটতে না মিটতে আবার সমস্যা। টাটা গোষ্ঠী কলকাতায় হোটেল করবেন। আলিপুর চিড়িয়াখানার পাশে একটি জায়গা বেছে নিয়েছেন। রাজ্য সরকারেরও জায়গাটি পছন্দ হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী বললেন, ওখানে হোটেল হলে চিড়িয়াখানার ঝিলে বিদেশি পাখি আসবে না। আমরা বোঝালাম, নিচু বাড়ি হবে, পরিবেশের সঙ্গে সামঞ্জস্য থাকবে। তিনি বুঝলেন না। তাঁর ঘনিষ্ঠ অফিসারদের সাহায্য চাওয়া হল, তাঁরা সাহায্য করতে সম্মত হলেন। এও বললেন যে, জ্যোতিবাবু যদি কিছু দিন ইন্দিরা গাঁধীর সমালোচনা না করেন, তা হলে তাঁদের সুবিধা হয়! শেষ পর্যন্ত দু’টি প্রকল্পই অনুমোদিত হয়।

ভারতে আমাদের রাজ্যই প্রথম পরিবেশ দফতর চালু করে। সেই সিদ্ধান্তের পিছনে উপরোক্ত ঘটনাগুলির কোনও অবদান ছিল কি না জানি না। বামফ্রন্ট সরকার কিন্তু পরিবেশ নিয়ে কখনওই কঠোর হতে পারেনি। কারখানা থেকে নিষ্কাশিত জলের তাপমাত্রা বেশি থাকলে আইনত ফাইন করা যায়, কারখানা বন্ধ করেও দেওয়া যায়। কিন্তু শ্রমিকের কী হবে? কলকাতার পূর্ব দিকের জলাজমিতে বাড়িঘর তুলতে না-দেওয়া, ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের স্বার্থে বইমেলা সরিয়ে নিয়ে যাওয়া, শব্দদূষণ বন্ধ করা, এই ধরনের সমস্যায় দু’দিক বাঁচিয়ে চলার প্রবণতাই ছিল বেশি। আজকের পোস্ট-মার্কসিস্ট সরকারও মনে হয় সেই রাস্তা ধরেই চলছে।

সুন্দরবন দফতরে কাজ করতে গিয়ে দেখলাম, কেন্দ্রীয় সরকারের আইনকানুন অনুযায়ী কিছুই করার উপায় নেই। কোনও রাস্তা, কোনও ব্রিজ, কোনও সেচ প্রকল্প হলে দিল্লির অনুমোদন দরকার। তারই মধ্যে যেটুকু করা যায় করা হত। আবার, তুষার কাঞ্জিলাল ছিলেন সুন্দরবন উন্নয়ন পর্ষদের সদস্য। সুন্দরবনের পরিবেশ সম্বন্ধে তাঁর গভীর জ্ঞান। কোথাও একটি ছোট্ট ব্রিজ হবে, উনি হিসেব করে দেখিয়ে দিতেন, নদীর জল বাধা পেয়ে কোথায় গিয়ে ভাঙন ধরাবে। মন্ত্রী কান্তি গাঙ্গুলি বসে থাকার লোক নন। বলতেন, ‘তুষারদা, এ হল আমাদের বাঁচার লড়াই। রাখেন তো আপনার পরিবেশ!’

চলে যাই আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে। পরিবেশ রক্ষায় আজকে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হল বিশ্ব উষ্ণায়ন। আমাদের দৈনন্দিন জীবনে এখন শক্তির ব্যবহার সর্বত্র। এই শক্তি আমরা উৎপাদন করি কয়লা, তেল, গ্যাস ইত্যাদি জ্বালানি পুড়িয়ে। বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যবহৃত হয় কয়লা আর প্রাকৃতিক গ্যাস। রান্না হয় এলপিজি-র উনুনে, মোটরগাড়ি চলে পেট্রোল অথবা ডিজেলে। এর ফলে কার্বন ডাইঅক্সাইড আর মিথেন-এর মতো গ্যাসের নিঃসরণ বেড়েই চলেছে। বাতাসে এই গ্রিনহাউস গ্যাসগুলির পরিমাণ যত বাড়বে, পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা ততই বেড়ে যাবে। ১৮৫০ সালের তুলনায় এই বৃদ্ধি যদি ২ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড ছাড়িয়ে যায়, তা হলে বিশ্বের আবহাওয়ায় বেশ কয়েকটি পরিবর্তন হওয়ার সম্ভাবনা, যাতে সাধারণ জীবনযাপন বিপর্যস্ত হতে বাধ্য।

প্রথমত, সমুদ্রের জল স্ফীত হয়ে উপকূলবর্তী বিস্তীর্ণ অঞ্চল প্লাবিত করবে। আমাদের দেশেই অানুমানিক ২০-৩০ কোটি মানুষ বিপদগ্রস্ত হবেন, তাঁদের অনেকেই গরিব মৎস্যজীবী। আমাদের কৃষিনির্ভর দেশের প্রধান চাষ হয় মৌসুমি বায়ুর সাহায্যে। বিশ্ব উষ্ণায়ন এই মৌসুমি বায়ুকে অনিশ্চিত করবে, বৃষ্টিপাত কমবেশি হলে ধানের চাষ মার খাবে, ম্যালেরিয়ার প্রকোপ বা়ড়বে, সাইক্লোন ও বন্যার মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ আরও ঘন ঘন দেখা দেবে। শুধু ভারত তো নয়, বিশ্বের সব দেশেই দেখা যাবে এ ধরনের প্রভাব। বলা যেতে পারে সমূহ বিপদ।

বোঝাই যায় যে, তাপমাত্রার বৃদ্ধি ২ ডিগ্রিতে সীমিত রাখা দরকার। তার জন্য প্রয়োজন গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণের মাত্রা কমানো। বিজ্ঞানীরা হিসেব করে বলেছেন, এই মাত্রা ২০২৫-৩০-এর পরে ক্রমাগত কমিয়ে আনতে হবে। এই কাজ করা যায় দু’টি উপায়ে— হয় শক্তির ব্যবহার কমিয়ে আনতে হবে, না হয় জৈব জ্বালানি বাদ দিয়ে সৌরশক্তি, বায়ুশক্তি ইত্যাদি পুনর্নবীকরণীয় শক্তির ব্যবহার বাড়াতে হবে।

যে পথই বেছে নেওয়া হোক, শক্তির খরচ এক ধাক্কায় অনেক বেড়ে যাবে। অনুন্নত দেশগুলি তাই চায় যে, উন্নত দেশগুলি এগিয়ে আসুক এই বাড়তি খরচ বহন করতে। আজকে বাতাসে যে পরিমাণ কার্বন ডাইঅক্সাইড আছে, তার ৭০ শতাংশ নিঃসৃত হয়েছে উন্নত দেশগুলি থেকেই, সেই হিসেবে এই দাবি সংগত। কিন্তু কুড়ি বছর ধরে সাধ্যসাধনার পরেও দেশগুলির মধ্যে এই বিষয়ে ঐকমত্য হয়নি। বছর পাঁচেকের মধ্যে যদি সমঝোতা না হয়, তা হলে আর তাপমাত্রার বৃদ্ধি কোনও মতেই ২ ডিগ্রিতে বেঁধে রাখা যাবে না।

রাষ্ট্রপুঞ্জের উদ্যোগে আয়োজিত বিশ্ব উষ্ণায়ন সংক্রান্ত আলোচনায় ভারত কখনওই নিঃসরণ কমাবার লক্ষ্যমাত্রা মেনে নেয়নি। আমাদের বক্তব্য, ভারত উন্নয়নশীল দেশ। ভারতে এখনও ৬০ কোটি মানুষ বিদ্যুতের ব্যবহার থেকে বঞ্চিত। দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা অনেক বাড়াতে হবে। প্রয়োজনে কয়লা পোড়াবার স্বাধীনতা আমাদের দরকার। আমরা স্বেচ্ছায় ১ লক্ষ মেগাওয়াট সৌরশক্তির টার্গেট নিয়েছি। আমরা ঘোষণা করেছি যে, আমাদের মাথাপিছু নিঃসরণ উন্নত দেশগুলির বেশি হবে না, কিন্তু এ ব্যাপারে টার্গেট নিতে আমাদের চিরকালের আপত্তি। ভারতের এই অবস্থান আন্তর্জাতিক বোঝাপড়ার পরিপন্থী হয়েছে। জয়রাম রমেশ একটু চেষ্টা করেছিলেন এই কোণঠাসা অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসার। কিন্তু তাঁর চেষ্টা কার্যকর হয়নি।

ভারত এখন বিশ্বের দরবারে দুই মুখে কথা বলে। আমরা যখন লগ্নি টানতে যাই, কিংবা রাষ্ট্রপুঞ্জের নিরাপত্তা পরিষদে স্থায়ী আসনের জন্য সওয়াল করি, তখন দারিদ্রের কথা, আদিবাসীদের কথা, মানবাধিকারের কথা বলা বারণ। আর যখন উষ্ণায়নের বৈঠকে গিয়ে বসি, তখন বারে বারেই সেই ৬০ কোটি মানুষের প্রসঙ্গে টেনে আনি। মঙ্গলযানের ভারতে, ৮ শতাংশ বৃদ্ধিহারের ভারতে এত গরিব মানুষ আছে? কেউ বিশ্বাস করেন, কেউ হয়তো করেন না। বোধ করি এক দিন এদের সঙ্গে নিয়ে যেতে হবে মেক্সিকো আর কোপেনহেগেনে পরিবেশ সম্মেলনে— রাজ্যপালের কাছে এমএলএ নিয়ে যাওয়ার মতো। আর যদি অন্যরা আমাদের বলে— ঠিক আছে, তোমাদের নিঃসরণ কমাতে হবে না, এই সব মানুষকে কোন সালের মধ্যে বিদ্যুৎ দেবে, সেই টার্গেট নাও? তখন আমরা নিশ্চয়ই বলব, সেটা আমাদের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার।

ভূতপূর্ব মুখ্য সচিব, পশ্চিমবঙ্গ সরকার

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE