পাশাপাশি: দশমীতে ইছামতী নদীর এ পারে ও পারে ভারত ও বাংলাদেশের দুর্গাপ্রতিমার বিসর্জন, টাকি। ২৮ সেপ্টেম্বর, ২০০৯
আমার বেড়ে ওঠার শহর কুমিল্লার পথে পথে পূজার মরসুমে শুনতে শুনতে বড় হয়েছি লতা মঙ্গেশকরের গলায়, ‘মঙ্গলদীপ জ্বেলে অন্ধকারে দু’চোখ আলোয় ভরো প্রভু’। ঘনীভূত আঁধার-তাড়ানো উজ্জীবনমন্ত্র খুঁজে পেয়েছি এই গানের মধ্যে। ঋতুপর্ণ ঘোষের সঙ্গে মেনেছি, ‘‘শরতের আকাশে, ধূপধুনোর গন্ধে, ঢাকের আওয়াজের সঙ্গে মিশে থাকত এক মরাঠি মহিলার গলা, যাঁকে ছাড়া বাংলার পুজো আজ কেমন যেন পানসে হয়ে গিয়েছে।’’
শুধু বাঙালি-মরাঠি তো না, পূজার মতো উৎসব এই ভাবেই মানুষকে মেলায়, দূরত্ব কমায়। ছোটবেলায় বাংলাদেশের মফস্সল শহরে বসে কলকাতা থেকে প্রকাশিত বইয়ে ভূমিকার নীচে ‘মহালয়া’ শব্দটি দেখে অবাক হতাম। একই শৈশবের অভিন্ন অংশীদার রামু বা শ্যামু বুঝিয়ে দিত আগমনি লগ্নের মর্ম। আসছে আসছে পূজা আসছে। আমার যেমন ইদের জন্য অপেক্ষা, জায়ন রাব্বি সমাদ্দারের যেমন ক্রিসমাসের জন্য, শুভ্রার যেমন বুদ্ধপূর্ণিমার জন্য অপেক্ষা। উৎসব মানেই এমন ব্যাকুল অপেক্ষার। ভাল কিছুর জন্য, শ্রেয়র জন্য অপেক্ষা।
কুমিল্লার মনোহরপুরের রাজরাজেশ্বরী কালীবাড়ি থেকে ভেসে আসত বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের ‘মহিষাসুরমর্দিনী’। আর তার পরই আমাদের ইস্কুল শিক্ষক কাব্যব্যাকরণতীর্থ মধুসূদন চক্রবর্তীর কণ্ঠে চলত স্তোত্রপাঠ। আমরা মজা করে বলতাম মধুসূদন স্যর হলেন গরিবের বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র!
বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের কথা উঠতেই মনে পড়ে বাংলাদেশের চলচ্চিত্র-ব্যক্তিত্ব নাজির আহমদের এক কাহিনি। নাট্যজন সাইদ আহমদ তাঁর স্মৃতিকথায় লিখেছেন, নাজির আহমদ কী ভাবে এক বার অল ইন্ডিয়া রেডিয়োতে মহালয়ার অনুষ্ঠানে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের স্থলে স্তোত্রপাঠের দায়িত্ব পেয়েছিলেন: ‘‘এক দুর্গাপূজার ঘটনা বলছি। মহালয়ার অনুষ্ঠান সরাসরি সম্প্রচার হবে। কিন্তু বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র এসে পৌঁছাননি। পুরো ইউনিটের দিশেহারা অবস্থা। নাজির ভাইও প্যানেলে ছিলেন। উপায়ান্তর না দেখে স্টেশন ডিরেক্টর নাজির ভাইকে বললেন ‘মহালয়ার অনুষ্ঠানে স্তোত্রপাঠ করতে পারবেন কি?’ নাজির ভাই দম নিয়ে বললেন ‘ভদ্রের জায়গায় আমি স্তোত্রপাঠ করব? এটা তো দুঃসাহসিকতা হয়ে যায়।’ স্টেশন ডিরেক্টর বললেন, ‘আপনিই করবেন।’ অগত্যা নাজির ভাইকে অনুষ্ঠানটি করতে হল। ওঁর উচ্চারণ ভাল ছিল। কণ্ঠ তো ভালই ছিল। সংস্কৃতে লেটার মার্কস নিয়ে ম্যাট্রিক পাশ করেছিলেন। এই সময় সেটা কাজে এল। অনুষ্ঠান চলার সময়ই বীরেন্দ্রকৃষ্ণ এলেন স্টুডিয়োতে। যে ঘর থেকে অনুষ্ঠানটি সরাসরি সম্প্রচারিত হচ্ছিল, তার কাচের স্বচ্ছ অন্তরাল থেকে উঁকি মেরে দেখলেন, নাজির ভাই মগ্ন হয়ে স্তোত্রপাঠ করছেন। রেডিয়োর কর্মকর্তা বললেন ‘আপনি যান নাজির সাহেবকে অব্যাহতি দিন।’ কিন্তু বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র বললেন ‘নাজিরই করুক, ভালই করছে।’’ (সাইদ আহমদ রচনাবলী, বাংলা একাডেমি, ঢাকা ২০১২)
পূজা মানে কেবলই ঢাকের বাদ্যি না, পাঠকের কাছে নতুন লেখা ও শব্দের বাদ্যিও বটে। পশ্চিমবঙ্গ থেকে বাংলাদেশে আসা হরেক রকম পূজাসংখ্যা। বাংলাদেশের যে কোনও পাঠাগার, এমনকি সমৃদ্ধ ব্যক্তিগত সংগ্রহেও খুঁজে পাওয়া যাবে দেশ, আনন্দবাজার, অমৃতবাজার, আনন্দমেলা, সানন্দা, পত্রিকা, নবকল্লোল, আজকাল প্রভৃতি পত্রিকার পুরাতন পূজাসংখ্যা। শুধু কি তা-ই! পশ্চিমবঙ্গের জেলা-মফস্সল থেকে বেরোনো লিটল ম্যাগাজিনের শারদীয় সংখ্যাও পাঠক সংগ্রহ করেন দারুণ ঔৎসুক্যে। বাংলাদেশে রোজার মাস না আসতেই যেমন শুরু হয় ইদ-সংখ্যা প্রকাশের প্রস্তুতি, তেমনই আজকাল পূজা বা শারদসংখ্যা প্রকাশের আয়োজনও চোখে পড়ার মতো। পুরনো ঢাকার ঐতিহ্যবাহী ঢাকেশ্বরী মন্দির থেকে শুরু করে নতুন ঢাকায় গুলশন-বনানী পূজামণ্ডপ থেকেও প্রকাশ হতে শুরু করেছে ঢাউস মাপের পূজাবার্ষিকী। অনলাইন পত্রিকাতেও চলছে নানা শারদীয় আয়োজন।
ঢাকার ঘনবসতিপূর্ণ হয়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে উৎসবের উন্মুক্ততা। মন্দিরকেন্দ্রিক দুর্গোৎসব ছাপিয়ে এখন ঢাকার মাঠেও বসছে পূজার আয়োজন। গত কয়েক বছর যাবৎ কলাবাগান বা গুলশন-বনানী মাঠে পূজামণ্ডপের বিস্তৃতি, এবং ধর্মনির্বিশেষে ঢাকাবাসীর একে আপন করে নেওয়াতে বুঝতে হয় উৎসব আসে সর্বজনীন আবাহনে। সারিবদ্ধ ভাবে দাঁড়িয়ে গুলশন-বনানী পূজামণ্ডপে প্রবেশের দৃশ্য এ বারও পূজার সন্ধ্যায় দেখা গেল। বোঝা গেল, অসাম্প্রদায়িক মিলনসরণিতেই বাঙালির প্রকৃত অধিবাস।
শুধু নগরে তো নয়, প্রান্তেও ছড়িয়ে পড়ে দুর্গাপূজার সর্বজনীনতা। ইছামতী নদীর তীরে বিজয়া দশমীকে কেন্দ্র করে ভারত-বাংলাদেশের টাকি আর শ্রীপুর টাউন এলাকায় মানুষের মিলনোৎসব এই সর্বজনীনতারই প্রতীক। ইছামতীর বুকে বাংলাদেশ ও ভারতের কয়েক হাজার রকমারি নৌকা আর ট্রলার যেন উৎসবকেই ভাসিয়ে রাখে নদীতে। বিজয়া দশমী উপলক্ষে বাংলাদেশের সাতক্ষীরা সীমান্তের বিভিন্ন জনপদ থেকে প্রতিমা আসে ইছামতীতে, আবার সাতক্ষীরার সমান্তরালে ভারতের চব্বিশ পরগনা জেলার বসিরহাট, হাসনাবাদ, টাকি ও হিঙ্গলগঞ্জ-সহ বিভিন্ন এলাকার প্রতিমা নিয়ে আসা হয় ইছামতীতে। এ পারের মানুষ ও পারে, আর ও পারের মানুষ এ পারে পূজার আনন্দে ইছামতীর বুকে ভেসে কিছু সময়ের জন্য হলেও দূরত্ব ভুলে মিলিত হন নিবিড় নৈকট্যে। দুর্গাপূজাকে কেন্দ্র করে কলকাতায়ও ছুটে আসেন বাংলাদেশের হিন্দু-মুসলিম উৎসুক মানুষ।
বাংলাদেশের লেখকদের স্মৃতিচারণেও পূজাকে কেন্দ্র করে হিন্দু-মুসলিম মিলনের ইতিহাস। লেখক সৈয়দ শামসুল হক তাঁর আত্মজীবনীতে ঢাকার অদূরে মির্জাপুরের দানবীর রণদাপ্রসাদ সাহার মুসলিম জামাতা ব্যারিস্টার শওকত আলি খানের দুর্গোৎসবের কথা জানিয়েছেন: ‘‘আজীবন দেখভাল করেছেন তাঁর (ব্যারিস্টার শওকত আলি খানের) শ্বশুর রণদাপ্রসাদ সাহার মির্জাপুরের হাসপাতাল আর বিদ্যাপ্রতিষ্ঠানগুলো, এমনকি বাৎসরিক দুর্গাপূজাও হত তাঁরই তত্ত্বাবধানে। অনেক পরে তাঁরই নেমন্তন্ন পেয়ে গিয়েছি মির্জাপুরে, তাঁরই ব্যবস্থাপনায় নৌকোয় খাল পেরিয়ে পৌঁছেছি পূজামণ্ডপে, অষ্টমীর দিনে খাঁটি ঘিয়ের হলুদরঙা ঝরঝরে পোলাও আর রুইমাছ ভাজার রাজকীয় ভোজেও বসেছি কত না বছর।’’ (সৈয়দ শামসুল হক, তিনপয়সার জ্যোছনা)
লেখকদের কথা বলতেই মনে পড়ে, পূজার দিনে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের চিরপ্রস্থানের কথা। পূজা আর ইদের ছুটি মিলিয়ে সে বার বড় ছুটি, ঢাকা থেকে চলেছি নিজের শহরে। এর মধ্যেই কলকাতার টিভি চ্যানেলে দেখতে পেলাম, প্রিয় লেখকের শেষ বিদায়ের আয়োজন। বাঙালি পাঠকের পূজার সব আনন্দকে যেন ছাই করে দিয়ে গেল নীলু, সন্তু, নীরা। পঞ্চভূতে বিলীন হলেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়।
তবু অনন্ত জাগে। অনন্ত শান্তির বার্তা জাগে। আমাদের মনের মালঞ্চে রেখে যায় পূজার মতো সর্বজনীন উৎসবের সুরভি। সমস্ত দুঃখবিরোধ উজিয়ে উৎসবেই জাগুক অনন্ত মানুষ। জাগুক।
ঢাকার বাংলা একাডেমির গবেষক
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy