ক্ষুধা সূচক’-এ ভারত রয়েছে ১০২ নম্বরে। ‘উন্নয়ন’ নিয়ে প্রায় দুই দশক কাজের অভিজ্ঞতার নিরিখে এই করুণ দশা দেখে আঘাত লাগল না। জানি, কেন দারিদ্র দূর করার এত চেষ্টা করেও মানুষ খিদে নিয়ে শুতে যায়, সে প্রশ্ন করলে নানা মুনির মত শুনতে হবে। কেউ মার্ক্স-এর হাত ধরে বলবেন, শ্রেণিবিভক্ত সমাজে দারিদ্র মুছে যাওয়া অসম্ভব। কেউ মিশেল ফুকো আওড়ে বলবেন, এ সবই মানুষকে নিয়ন্ত্রণের কৌশল (‘গভর্নমেন্টালিটি’)। ভুলিয়ে রাখার জন্য নানা কর্মসূচি। কেউ বলবেন, বাজারকে কাজ করতে দিতে হবে। ধনতান্ত্রিক বিকাশই দারিদ্র দূর করার পথ। কেউ বলবেন, কিসে দরিদ্র কমছে, পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে (র্যান্ডমাইজ়ড কন্ট্রোলড ট্রায়াল) ঠিক করতে হবে।
দারিদ্র দূর করার প্রশাসনিক নানা উদ্যোগ কখনও এক মতাদর্শের দিকে ঝুঁকেছে, কখনও অন্যটার দিকে। স্বাধীনতার পরে ব্রিটিশ আমলের প্রশাসনিক পরিকাঠামোয় জুড়ে দেওয়া হল ‘কমিউনিটি ডেভেলপমেন্ট ব্লক’— যাতে উন্নয়নে কেন্দ্রের প্রাধান্য বজায় রেখেও প্রশাসনকে আর একটু নীচের স্তরে বিস্তৃত করা যায়। আবার ক’দিন পরে মনে হল, কেবল ‘টপ-ডাউন’ উন্নয়নে কুলোচ্ছে না। গাঁধীর কথা অনুযায়ী গরিবের উন্নয়নের জন্য গরিবের স্বশাসন চাই। অতএব আইন করে গ্রাম-ব্লক-জেলাতে পঞ্চায়েত ব্যবস্থা সচল হল। পাশাপাশি দেশ জুড়ে অস্বাস্থ্য-অপুষ্টি-অশিক্ষা দূর করার নানা রকম ‘মিশন’ চালু করল কেন্দ্র। কেন্দ্রীয় সরকারের নানা দফতর, তার তলায় রাজ্য সরকারের নানা দফতর, জেলাগুলোতে প্রশাসন আর স্বশাসনের বিভিন্ন কর্তার দফতর, গরিবি কমাতে দায়িত্বের জটিল বণ্টন। আরও আছে বিভিন্ন অসরকারি সংস্থা (এনজিও), সাংসদ-বিধায়কদের টাকায় উন্নয়নের কাজ। বিশ্ব ব্যাঙ্ক, রাষ্ট্রপুঞ্জের দারিদ্র দূর করার লক্ষ্য পূরণ করার প্রকল্প। এ যেন এক অর্কেস্ট্রা, যার পরিচালক বা ‘কন্ডাক্টর’ নেই।
দরিদ্রের সহায়তার এত রকম প্রকল্পই কি দারিদ্র দূর না হওয়ার একটা বড় কারণ? বিভিন্ন দফতর যে যার মতো পরিকল্পনা করছে, টাকা খরচ করছে এবং ‘সাফল্য’-এর রিপোর্ট পাঠাচ্ছে। কী করে অগ্রগতি দেখাতে হয়, সেটা শিখতে আধিকারিকদের সময় লাগে না। প্রতিটি গ্রাম পঞ্চায়েত পরিকল্পনা করছে, কিন্তু পরিকল্পনার ফলে দারিদ্র কমছে কি না, সেটা বোঝার উপায় নেই। রাস্তা হচ্ছে, পুকুর কাটা হচ্ছে, স্কুল বাড়ি হচ্ছে, কিন্তু ক’জন দারিদ্রের ফাঁদ থেকে বেরোতে পারল, স্পষ্ট হচ্ছে না। ধরে নেওয়া হয়, টাকা খরচ হচ্ছে মানেই কাজ হচ্ছে।
ব্যবস্থার জটিলতার ফলে ব্যর্থতা ধরা পড়লেও কাউকে দোষ দেওয়া সম্ভব নয়। পঞ্চায়েত বলবে, স্কুলে কেন শিশুরা যাচ্ছে না সেটা শিক্ষা দফতর বলতে পারবে। অঙ্গনওয়াড়িতে খিচুড়ি বিলি বন্ধ? সমাজকল্যাণ দফতরকে বলুন। আবার এক সরকারি দফতরের অমুকবাবুকে দোষ দিলে তিনি বলবেন, ওই দফতরের তমুকবাবু সাহায্য করছেন না।
দীর্ঘ দিনের এই সমস্যার মোকাবিলা করার একটা পরীক্ষামূলক চেষ্টা সম্প্রতি দেখলাম মহারাষ্ট্রে। সেখানে রাজ্য সরকার কিছু গ্রাম বেছে নিয়ে এক জন উন্নয়নকর্মী (ফেলো) পাঠাচ্ছে। তাঁরা গ্রামে থেকে হাল হকিকত বুঝছেন। তার পর গ্রাম পঞ্চায়েত এবং বিভিন্ন দফতরের বরাদ্দকে একসঙ্গে ধরে একটি পরিকল্পনা বা প্ল্যান তৈরি করছেন। গ্রাম পঞ্চায়েতও প্ল্যান তৈরি করে, কিন্তু তা কেবল তার নিজের বরাদ্দ ধরে। এই উন্নয়নকর্মীরা পঞ্চায়েতের বরাদ্দের সঙ্গে কৃষি, সেচ, বিদ্যুৎ, এমন নানা দফতরের বরাদ্দও ধরছে। ধরা যাক গ্রামসভায় জানতে পারা গেল যে একটি স্কুলে মেয়েদের শৌচাগার নেই। সেই টাকাটা হয়তো শিক্ষা দফতরের কাছে নেই, কিন্তু গ্রাম পঞ্চায়েতের কাছে আছে। আবার কৃষকদের ট্রেনিং চাই কিন্তু সেই টাকাটা গ্রাম পঞ্চায়েতের কাছে নেই, কৃষি দফতরের কাছে আছে। এ ভাবে সমন্বিত প্ল্যান তৈরি হবে।
এই উন্নয়নকর্মী যেন তপন সিংহের ‘গল্প হলেও সত্যি’ ছবির রবি ঘোষ। সবার মধ্যে ঝগড়াঝাঁটি মিটিয়ে দিয়ে তাঁকে পরিকল্পনা-মাফিক উন্নয়ন করতে হবে। সমস্যা একটাই— রবি ঘোষের চরিত্রটির অলৌকিক ক্ষমতা ছিল, কিন্তু এই গবেষকের তা নেই। তাঁর দায়িত্ব আছে, কিন্তু কোনও ক্ষমতাই নেই, কারণ তিনি সরকারি আধিকারিক নন, চুক্তিবদ্ধ কর্মচারী মাত্র। তা-ও বেশ কিছু গবেষক ভাল কাজ করছেন। কিন্তু দেশ জুড়ে সব পঞ্চায়েতে ‘ফেলো’ নিয়োগ কি সম্ভব?
আর একটি প্রচেষ্টা শুরু করেছে নীতি আয়োগ। ব্যাকওয়ার্ড বা পিছিয়ে পড়া জেলাগুলির জন্য মোট উনপঞ্চাশটি সূচক ঠিক করা হয়েছে, যা দিয়ে জেলার উন্নতি প্রতি মাসে মাপা হচ্ছে। জেলাস্তরে এক জন উন্নয়নকর্মী রাখা হয়েছে সার্বিক সমন্বয়ের জন্য। প্রতি জেলাকে মাসিক রিপোর্ট কার্ড দেওয়া হচ্ছে, কোন খাতে কে কত উন্নতি করল। এর ফলে ঘাটতিগুলো সহজে সবার চোখে পড়ছে। এই মডেল কাজ করত, যদি নিশ্চিত করা যেত যে জেলার নানা দফতর থেকে যে তথ্য পাঠানো হবে, তাতে জল থাকবে না। জল মেশানোই স্বাভাবিক, কারণ সবাই চাইবে যাতে র্যাঙ্ক ভাল হয়।
দারিদ্র দূর করার কাজে কোথায় গলদ, তা যে টের পাওয়া গিয়েছে, এটা ভাল কথা। কিন্তু তা দূর হবে কী করে? ‘চেষ্টা চলছে’ এই অছিলায় সত্যটা এড়ানো যাবে না। সেই সত্য এই যে, জটিল প্রশাসন ব্যবস্থা এবং নানা সমান্তরাল উন্নয়ন প্রকল্পকে যত ক্ষণ না সরল, দায়বদ্ধ এবং সমন্বিত করা যাচ্ছে, তত ক্ষণ দারিদ্র নিরসনের টাকা বরাদ্দ আর খরচের হিসেব চলতে থাকবে। দারিদ্র ঘুচবে না।
সিগমা ফাউন্ডেশন। মতামত ব্যক্তিগত
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy