অলঙ্করণ: মণীশ মৈত্র।
পশ্চিমবঙ্গের মুসলমান সমাজের মধ্যেও অতীতে এক মস্ত বড় সমস্যা ছিল। যাঁরা বিদেশি উৎস থেকে আসা বাংলার মুসলমান তাঁরা অভিজাত শ্রেণি ছিলেন কিন্তু বাংলা জানতেন না। শেখার চেষ্টাও করতেন না। তাঁরা পারস্য ও আরবের ভাষা জানতেন। ঊনবিংশ শতাব্দীর পর এঁদের পরবর্তী প্রজন্ম উর্দু শিক্ষাও লাভ করেন। বাঙালি যাঁরা ধর্মান্তর করতেন তাঁদের বলা হত QTRAPS (Wretched)। এঁরা আবার পার্সিয়ান, আরবি, এমনকী উর্দুও জানতেন না এঁরা শুধু বাংলাই জানতেন। আগে বাংলা না জানা মুসলিমদের বলা হত আশরফ। বাংলা ছাড়া অন্য কোন ভাষা না জানা এই ধর্মান্তরিত মুসলিমদের আশরফগোষ্ঠী মানুষ জ্ঞান করত না।
ব্রিটিশদের তাই ‘ডিভাইড অ্যান্ড রুল’ করতে খুব সুবিধা হয়ে গিয়েছিল। ব্রিটিশরা এক দিকে বলতেন, ভারতীয় সমস্ত আইনকে অভিন্ন ধর্মনিরপেক্ষ করতে হবে আবার অন্য দিকে বিভাজনের আগুন নিয়ে খেলতেন ব্রিটিশ প্রভুরাই।
বৈষ্ণব সাম্যবাদী সন্তবাদ, এমনকী শঙ্করাচার্যের ভাবনাতেও সামাজিক বিভেদনীতি ছিল না। হিন্দু উৎসের এই Saint Cult কিন্তু মুসলমান সমাজেও প্রভাব বিস্তার করে। সুফি গুরু ও তাঁর শিষ্যরা একটা সেতু রচনা করেছিলেন হিন্দু ও মুসলিম ধর্মের মধ্যে। মা দুর্গার আরাধনায় কোনও সুফি সাধক হাজির হলেও তাঁর দর্শনে মহাভারত অশুদ্ধ হত না। কিন্তু ব্রিটিশদের সাহায্য নিয়ে গোঁড়া মুসলমানরা এই সুফি সম্প্রদায়কেই দূরে সরিয়ে দেয়। গোড়া উলেমারা সেসময়ে এই সুফি সাধকদের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করে দেয়। Marc Gaborieau তাXর Muslim shrines গ্রন্থে লিখেছিলেন, The Worship of saint is all the more to be prohibited because to makes muslims resemble hindu, amongst whom they live.
সমস্যাটা এখানেই! হিন্দু আইন মানলে কি তবে হিন্দু হয়ে যাওয়া! হিন্দু আইন বলে কিছুই হয় না। আইন আইন। তা হলে মুসলিম আইন বলেও কিছু হতে পারে না। প্লেটো এবং কৌটিল্য, দু’জনেই এই অভিন্ন দেওয়ানি বিধির বিতর্ক নিয়ে খুবই বিস্মিত। এই সমস্যার সমাধান তা হলে কী হবে?
বসুন্ধরা ধাগামওয়ার (Vasundhara Dhagamwar) এই UCC নিয়ে সবিস্তার গবেষণা করেছেন। ইন্ডিয়ান ল ইনস্টিটিউট এটি প্রকাশ করেছে। প্লেটোবাবু কলেজ স্ট্রিটে একটা পুরনো বইয়ের দোকান থেকে বইটি কিনে ফেলেছেন।
প্লেটোবাবু: আমি যা বুঝলাম, ভারতীয় মুসলমান সমাজ মনে করছে মুসলিম আইন তাদের ধর্মের ভিত্তিতেই তৈরি, তাই এই আইন বদলানো মানে সংবিধানের ২৫ নম্বর অনুচ্ছেদ অনুসারে সংখ্যালঘু সমাজের বাক স্বাধীনতার মৌলিক অধিকারই কেড়ে নেওয়া হবে। আবার যেহেতু মুসলিম পার্সোনাল ল সরাসরি কোরান থেকেই সংগৃহীত, কাজেই এই আইন এখন বদলানোর কথা বলা মানে কোরানাকেই চ্যালেঞ্জ করা।
কৌটিল্য: হিন্দু নামাঙ্কিত যে কোনও জিনিসকেই বর্জন করার একটা প্রবণতা ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ দিকে হয়েছিল, সেটাও আমার নজরে পড়ছে। এটাও ঠিক নয়। স্বাধীনতার পর ভারতীয় রাষ্ট্রনেতারা আইনের সাম্য প্রতিষ্ঠায় যথেষ্ট সক্রিয় ছিলেন। তবু ...
প্লেটো: হ্যাঁ, তবু রাজনীতি হয়েছে। এই রাজনীতিটা করেছে অনেক বেশি ব্রিটিশরাই। যে সব বাঙালি হিন্দু মুসলিম হয়ে যায় তাদের জন্য সুফি আচার তো ভাল ছিল। সুফি হয়ে তারা অতীতের হিন্দুয়ানাও বজায় রাখত। ও রকম জোর করা ঠিক হয়নি।
জয়ন্ত: সংবিধান প্রণেতাগণ যখন বিতর্ক চালাচ্ছিলেন সে সময় অম্বেডকরও অভিন্ন দেওয়ানি বিধির পক্ষে ছিলেন। কে এম মুন্সি, আলাদি— এঁরা এই অভিন্ন দেওয়ানি বিধির পক্ষে ছিলেন। অম্বেডকর তো হিন্দু সাম্প্রদায়িক ছিলেন না। আর এর মধ্যে যদি সাম্প্রদায়িতার সম্ভাবনা থাকত তবে নেহরু কি সংবিধান পরিষদের বৈঠকে এই প্রস্তাবের ঘোরতর বিরোধিতাই করতেন না? দেখুন, মহম্মদ নিজেই বলেছিলেন, ধর্ম নিয়ে তিনি যা বলেছিলেন সাচ্চা মুসলমানরা তা মানতে বাধ্য থাকবেন। বাধ্য মানে bundings আর অন্যান্য বিষয়, যেমন ধর্মনিরপেক্ষ বা ধর্মীয় বিষয় নয় এমন বিষয়গুলিকে উপদেশ হিসাবেই গ্রহণ করা উচিত, কোনও বাধ্যতামূলক আদেশ নয়।
কৌটিল্য: সমস্যাটা কোথায় হচ্ছে জানেন? সমস্যাটা হল ধর্মকে জোর করে ধর্মান্ধতায় পৌঁছে দেওয়া। তারপর রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে সেই অন্ধ ধর্মকে ব্যবহার করা। Judge Mauz-এর সঙ্গে প্রোফেটের আলাপচারিতা পড়ুন। সেখানে তিনি বলছেন বিচারকে প্রভাবিত করতে প্রয়োজন Re বা বুদ্ধির। হজরতের মৃত্যুর পর Muta Zilla নামের একটি বিদ্যালয় গড়ে ওঠে ইজিপ্টে। কোরানের ব্যাখ্যাই ছিল এই বিদ্যালয়ের প্রধান লক্ষ্য। বেশ কয়েক শতক এই কাজ চলছিল। আমির আলি, স্যার সৈয়দের মতো জ্ঞানী এই বিদ্যালয়ের কাজকর্মে খুবই তুষ্ট হন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ধর্মান্ধ কিছু মৌলবাদীর হাতে এই বিদ্যালয় আক্রান্ত হয়। শেষ পর্যন্ত এই বিদ্যালয় বন্ধ হয়ে যায়।
তাই মনে হচ্ছে প্রাথমিক ভাবে অভিন্ন দেওয়ানি বিধি নিয়ে সাধারণ মানুষের জানাটা বিশেষ প্রয়োজন। দরকার সাধারণ জ্ঞান। তারপর বুঝতে হবে তিন তালাক সমস্যা আর অভিন্ন দেওয়ানি বিধিও এক জিনিস নয়। আবার এই বিষয়টিকে হিন্দু-মুসলিমের সংঘাতের প্রেক্ষাপটে দেখাও ঠিক নয়। আবার হিন্দু সমাজে খাপ পঞ্চায়েতের নির্দেশ ব্যতিক্রম করে হিন্দু বহু বিবাহের ক্ষেত্রে ধীরে চলো নীতি গ্রহণ— এ সবও খোলা মনে আলোচনা করতে হবে। তবে উত্তরপ্রদেশের ভোটের আগে এই বিষয়টি উত্থাপন করলে মনে হয় ক্ষুদ্র রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করছে সব কিছু।
সে দিন এক বিয়েবাড়িতে অনেক দিন পর দেখা হল এক পুরনো বন্ধুর সঙ্গে। সে আবার পুরনো বিজেপি ভক্ত। তার প্রশ্ন ছিল: ‘‘কী হচ্ছে?’’ আমি বললাম, ‘‘আর কি, হিন্দু-মুসলমান হচ্ছে।’’
খুব রেগে গেল সেই বন্ধুটি। ‘‘তুমি কি রাজনীতিতে আসছো? রাজনৈতিক নেতারা এ ভাবে কথা বলে।’’
বললাম, ‘‘ঠিক উল্টো, রাজনীতি থেকে মুক্ত হওয়ার কথাই বলছি। আর স্বপ্ন দেখছি।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy