Advertisement
২৭ ডিসেম্বর ২০২৪
Diego Maradona death

‘কোন গ্রহ থেকে এসেছিলে’

অসহায় ইংল্যান্ড! একটু আগে ‘ঈশ্বরের হাত’-এর ছোঁয়ায় গোল খেয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করছিল। চার মিনিটের মধ্যে ফুটবল-ঈশ্বরের পায়ের জাদুতে নিষ্প্রাণ হয়ে পড়ে রইল।

সুমিত ঘোষ
শেষ আপডেট: ২৮ নভেম্বর ২০২০ ০০:২২
Share: Save:

২২ জুন, ১৯৮৬। কী ভাবে ব্যাখ্যা করা যায় সেই দিনটাকে? যে দিন একই মানুষের মধ্যে শয়তান এবং দেবতাকে একই সঙ্গে প্রত্যক্ষ করার সুযোগ হয়েছিল ক্রীড়াবিশ্বের? তা-ও মাত্র চার মিনিটের ব্যবধানে!

আর্জেন্টিনার বিস্ময়-প্রতিভা তখন সবে ‘হ্যান্ড অব গড’ গোলটি করে উঠেছেন। মাঠে উত্তাল পরিস্থিতি। রেফারি, লাইন্সম্যানের মনে হল, ন্যায্য গোল। এর পর ইংরেজরা কী ভাবল, তা দিয়ে দিয়েগো আর্মান্দো মারাদোনার কবে কী এসে গিয়েছে!

বরাবর ঈশ্বরের প্রিয়পাত্র, দেবদূত হিসেবে নিজেকে তুলে ধরা তিনি শুধু ‘শয়তান’ অপবাদ নিয়ে ফেরেন কী করে! ছ’জন ইংরেজ ফুটবলারকে একের পর এক পরাস্ত করে তিনি এমন এক বিস্ময়-গোল উপহার দিলেন, যা শতাব্দীর সেরা হিসেবে থেকে গেল। দেখে মনে হচ্ছিল, বিশ্বকাপ নয়, ফ্যান্টাসি ফুটবল চলছে। যেন ইংল্যান্ডের এই ফুটবলাররা রক্তমাংসের শরীরই নন, মঞ্চ সাজানোর জন্য বসানো কিছু মোমের মূর্তি! মারাদোনা বল নিয়ে কাছাকাছি এলেই বিকর্ষণ ঘটে তাঁরা সব খসে যেতে থাকবেন।

ইংল্যান্ডের প্রাক্তন তারকা গ্যারি লিনেকার বলেছিলেন, “ওই একটা দিন গোল খেয়েও প্রতিপক্ষের সামনে হাতজোড় করে সম্মান জানানোর ইচ্ছা হয়েছিল। লোকে যেমন প্রভুর সামনে হাতজোড় করে। দিয়েগো মারাদোনা অন্য গ্রহের বাসিন্দা।” এখনও ইউটিউবে দেখতে বসলে মনে হবে, চৌত্রিশ বছর আগে কোথায়, যেন গত কালই ঘটেছে! এতটাই জীবন্ত সেই গোল। ওই তো দিয়েগো আর্মান্দো মারাদোনা নামক পাঁচ ফুট পাঁচ ইঞ্চির বিস্ময়-প্রতিভা। নিজেদের অর্ধে বল ধরলেন। দ্রুত মার্কিং করতে চলে এল দুই ইংরেজ ফুটবলার। মারাদোনা বলটার উপর পা দিয়ে ‘রোল’ করে ঘুরে গেলেন। ফুটবল তো নয়, যেন ব্যালে প্রদর্শনী। পায়ে তাঁর পোষ মানা বল।

ক্ষিপ্র মোচড়ে পিটার বিয়ার্ডস্লে এবং টেরি বুচার ছিটকে গেলেন। পিটার রিড তাঁকে তাড়া করার চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু মারাদোনার যেন পায়ে চাকা লাগানো। কোথায় পড়ে রইলেন রিড! সামনে এ বার টেরি ফেনউইক। ১৯৮২ বিশ্বকাপে ডিফেন্ডারদের নির্মম অত্যাচার সহ্য করতে হয়েছিল মারাদোনাকে। ১৯৮৬-র মেক্সিকোতে সেরা শিল্পীকে রক্ষা করার কথা ভেবেছিলেন রেফারিরা। ইতিমধ্যেই হলুদ কার্ড দেখা ফেনউইক ভেবেছিলেন, কনুইয়ের আঘাতে মারাদোনাকে ধরাশায়ী করবেন। ঝড় থামানোর আর কোনও ফর্মুলা জানা ছিল না তাঁর। কিন্তু লাল কার্ড দেখার ভয়ে করতে পারেননি। মারাদোনা টপকে গেলেন ফেনউইককেও। সামনে ইংরেজ গোলরক্ষক পিটার শিলটন। কিন্তু শট নিচ্ছেন না মারাদোনা। দক্ষ শিকারির মতো চোখ স্থির। ট্রিগার টিপবেন একদম মোক্ষম সময়ে। মরিয়া শেষ চেষ্টা করতে এগিয়ে এলেন টেরি বুচার। ব্যর্থ হল তাঁর ট্যাকলও। যেন প্রতিপক্ষের অস্তিত্বই নেই, তাঁরা শুধুই দর্শক, এমন বাদশাহি মেজাজে মারাদোনা ডান পা থেকে বাঁ পায়ে বলটা নিলেন। আগুয়ান শিলটনের পাশ দিয়ে জড়িয়ে দিলেন জালে।

অসহায় ইংল্যান্ড! একটু আগে ‘ঈশ্বরের হাত’-এর ছোঁয়ায় গোল খেয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করছিল। চার মিনিটের মধ্যে ফুটবল-ঈশ্বরের পায়ের জাদুতে নিষ্প্রাণ হয়ে পড়ে রইল। আর আর্জেন্টিনার দিক থেকে শুধু একটা গোল নয়, ছিল জীবনের ক্ষতে প্রলেপ দিয়ে যাওয়া স্বাধীনতার আনন্দ। চার বছর আগে ফকল্যান্ড যুদ্ধে ইংরেজদের কাছে আত্মসমর্পণ করার সময়ে স্পেনে বিশ্বকাপ চলছিল। গোটা দেশের লজ্জা আর হীনম্মন্যতার শাপমোচন ঘটিয়েছিল মারাদোনার সেই গোল। মেক্সিকোয় ইংল্যান্ড বনাম আর্জেন্টিনা ম্যাচকে ঘিরে এমনই উত্তেজনা তৈরি হয় যে, নামকরণ হয়েছিল ‘ফকল্যান্ডস পার্ট টু’। ফুটবল ম্যাচ নয়, যুদ্ধ জয়ের আনন্দে ভেসেছিল আর্জেন্টিনা।

মেক্সিকো বিশ্বকাপে ইংল্যান্ডের ম্যানেজার ববি রবসন বলেছিলেন, “মারাদোনাকে আমরা মার্কিং করব না। কিন্তু ও বল পেলেই ঘিরে ধরতে হবে। এই ছেলেটা কিন্তু চার মিনিটে খেলার ভাগ্য গড়ে দিয়ে যেতে পারে!” কে জানত, রবসনের কথা অক্ষরে অক্ষরে মিলিয়ে দেবেন দিয়েগো মারাদোনা। তাঁদের বিরুদ্ধেই! এখনকার মখমলের মতো মাঠ মেক্সিকো বিশ্বকাপে ছিল না। ও রকম এবড়োখেবড়ো মাঠে কী ভাবে বলকে কথা বলিয়েছিলেন মারাদোনা, তা দেখে অনেকেই স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিলেন। টিভি সম্প্রচারের স্বার্থে খেলাও ছিল ভরদুপুরে।

বিস্ময়-গোলটার সময় মারাদোনার সবচেয়ে কাছাকাছি ছিলেন সতীর্থ ভিক্তর ভালদানো। স্মরণীয় হয়ে থাকবে তাঁর উক্তি: “আমি দিয়েগোর সঙ্গে সঙ্গে এগোচ্ছিলাম এটা ভেবে যে, যদি আমার সহায়তা লাগে। একটু পরেই বুঝলাম, প্রতিপক্ষের মতো আমিও এই শোয়ের এক জন দর্শকমাত্র।”

রেডিয়ো আর্জেন্টিনায় সে সময় ধারাভাষ্য দিচ্ছিলেন ভিক্তর উগো মোরালেস। শতাব্দীর সেরা গোলের মতোই অমর হয়ে রয়েছে ভিক্তরের সেই বর্ণনা— “জিনিয়াস! জিনিয়াস! জিনিয়াস! এগিয়েই চলেছেন, এগিয়েই চলেছেন। বুরুচাগাকে কি পাস দেবেন? না, এখনও তাঁর পায়েই বল। আরও এক জনকে টপকে গেলেন। মারাদোনা! মারাদোনা! বিশ্ব ফুটবলের জিনিয়াস। গো-ও-ও-ও-ও-ল। গো-ও-ও-ও-ও-ল। আমি কাঁদতে চাই। হে প্রভু, হে ঈশ্বর! আমি কাঁদতে চাই। সুন্দর ফুটবল। দীর্ঘজীবী হও ফুটবল। একক কৃতিত্বে সর্বকালের সেরা গোল। হে দিয়েগো মারাদোনা, তুমি কোন গ্রহ থেকে এসেছ!!!”

চৌত্রিশ বছর পরেও, সেই গোলের অমর স্রষ্টার প্রয়াণের শোকযাপনের মধ্যে ভিক্তরের সঙ্গে গলা মিলিয়ে গোটা বিশ্ব বলে চলেছে, “হে দিয়েগো মারাদোনা, তুমি কোন গ্রহ থেকে এসেছিলে!”

অন্য বিষয়গুলি:

Diego Maradona death Hand of God Argentina
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy