ভালবাসা পথ খুঁজিয়া লইতে পারে। শত প্রতিকূলতার মধ্যেও মানুষের শরীর-মনের তীব্র আবেগ প্রকাশিত হয়। পথ সহজ না হইলে, প্রকাশ্য না হইলে ঘুরপথই বাহির করিয়া লয়। রাধার অন্তরে বা কৃষ্ণের অন্তরে ব্যথা হইলে তাঁহাদের কে-ই বা কবে আটক করিয়া রাখিতে পারিয়াছে! বৈষ্ণব পদাবলিতে রাধার তিমিরাভিসারের প্রসঙ্গ সুবিদিত। অন্ধকার অমারাত্রি। চন্দ্রালোকহীন আকাশ মেঘমণ্ডিত। সহসা বিদ্যুতের স্ফুরণ হইল। শত শত বজ্র পড়িতে লাগিল। অঝোর বারিধারায় পথ পঙ্কিল। তবু রাধা অনমনীয়। কৃষ্ণপ্রেমে তিনি পাগলিনী। এই পথই তখন তাঁহার রাজপথ। এমন সমস্যা-সঙ্কুল পথেই যে তাঁহাকে যাইতে হইবে, তাহা তো তিনি আগেই অনুমান করিয়াছিলেন। তাই অভিসারশিক্ষার ত্রুটি করেন নাই। গোবিন্দদাস কবিরাজের অভিসারশিক্ষার পদে রাধা উঠানে কণ্টক পুঁতিয়াছিলেন। জল ঢালিয়া সেই উঠান পিচ্ছিল করিয়াছিলেন। তাহার পর সেই উঠান উপরি পদ-বিক্ষেপ করিয়াছিলেন। তাঁহার কোমল পদযুগল কাঁটায় রক্তাক্ত হইতেছিল, তথাপি তিনি চলিতে গিয়া থামেন নাই।
সেই রাধা-কৃষ্ণের দিন গিয়াছে। এখন প্রেম অনেক বেশি প্রকাশ্য, সমাজসংসার অনুমোদিত। প্রেমের নানা পরিষেবা দেশে-বিদেশে প্রচলিত। প্রেম যদি হৃদয়ে এমনই না আসে, তাহা হইলেও অসুবিধা নাই। দেশে-বিদেশে যুগলকে এক করিবার নানা আয়োজন। ম্যাচ-মেকিং বা ডেটিং স্থির করিবার জন্য ঝাঁপ খুলিয়া নানা সংস্থা বসিয়া আছে। আপনার শরীর ও মনের মাপমতো সহচর-সহচরী জুটিবেই জুটিবে। দারুণ অগ্নিবাণে দগ্ধ হইবার কারণ ঘটিবে না। সবই ঠিক চলিতেছিল। এমন সময়ে সহসা আসিল করোনা। প্রেমের অপেক্ষা প্রাণ যে অনেক প্রিয়তর, তাহা বোধ হইল। ইহাতে অন্যায়ের কিছু নাই। সকলেই বাঁচিতে চাহেন, প্রেমিক-প্রেমিকারাই বা চাহিবেন না কেন! তাঁহারা প্রেম ছাড়িয়া প্রাণ রাখিতে ঘরে ঢুকিলেন। শহরের বিনোদন পরিসরগুলি ফাঁকা হইল। পেয়ালা মুখরিত নিভৃত কোণগুলি জনশূন্য হইল। ভাবা গিয়াছিল, এই করাল ব্যাধি দ্রুত যাইবে। প্রেম, পরিণয় সবই দ্রুত ফিরিবে। ক্রমশ বোধ হইতেছে বিষয়টি তেমন নহে। ব্যাধি জাঁকাইয়া বসিয়াছে। অতঃপর অন্য উপায় প্রয়োজন। সে উপায় সকল ক্রমশ প্রকাশ্যে আসিতেছে। প্রেমকে ঘিরিয়া গড়িয়া উঠিতেছে নিত্যনূতন বন্দোবস্ত ও নূতন শব্দাবলি। জাপানের নূতন শব্দ ‘অন-নমি’। অর্থ অনলাইন পানীয় সেবন। পাত্র-পাত্রী বসিয়া রহিয়াছেন। পরস্পরের সম্মুখে নহে, বসিয়া রহিয়াছেন স্ক্রিনের সম্মুখে। সেখানেই মূর্ত পরস্পরের আবেগ। বাজারে আসিয়াছে নূতন টি-শার্ট। তাহা বক্ষে ধারণ করিয়াছে ‘কুয়োমোসেক্সুয়াল’ শব্দটি। এই অশ্রুতপূর্ব বিশেষ্য পদের অর্থ, অতিমারির সময় যে নেতা পূর্ণবাক্যে কথা বলিতে পারেন, শান্ত-শমিত কাণ্ডজ্ঞান প্রদর্শন করিতে পারেন, তাঁহার নামবাহিত একটি ব্যবহারবিধি। তাঁহার নাম হইতেই এই শব্দের উৎপত্তি। অতিমারি কালে তাঁহার অনুসরণে স্ক্রিন ও দূরত্ববাহিত প্রেম-প্রণয়ে কাণ্ডজ্ঞান ও সুমিত বাক্য প্রয়োগের অধিকার অর্জন করা।
বাক্য হইয়া উঠিতেছে অসীম ক্ষমতাবান। স্বাভাবিক। পথ যত ব্যাধি-কণ্টকিত, প্রেমের উপায় ততই বিচিত্র। এই ব্যাধি-প্রবাসে মনে পড়ে, বৈষ্ণব পদাবলিতে পূর্বরাগের যে শর্তগুলি ছিল— তাহার মধ্যে একটি বংশীধ্বনি শ্রবণ। দূর হইতে বাঁশি শুনিয়া রাধা প্রণয়গ্রস্ত হইয়াছিলেন। এখন আবার এই ঐতিহ্য অনুসরণ করিতে হইবে। ধ্বনির স্থানে বাক্যকে প্রতিষ্ঠিত করিতে হইবে। আর, প্রেম বলিতে যে হেতু কেবল নর-নারীর যৌন মিলনকে বোঝায় না, তাহার নানা স্তর, নানা স্বর— প্রেমের মধ্যে স্নেহ, বাৎসল্য, মায়া, মমতা সকলই রহিয়াছে— প্রেমের এই বিচিত্র ক্ষেত্র টিকাইয়া রাখিবার জন্য দূর হইতে বাক্য ও দৃশ্য প্রেরণের উপরই ভরসা করিতে হইবে। মনে রাখিতে হইবে, বাক্যই আমাদের এ-কালের বংশীধ্বনি। বাঙালি তাই কথা বলিতে শিখিতে যত্ন করুন। দূরবর্তী সন্তান মাতা-পিতাকে যথাযথ ভাবে কথায় আশা প্রদান করুন, স্বামী বিরহিণী স্ত্রীকে সম্যক প্রণয়বাক্যে সম্ভাষিত করুন, জীবনকে মধুর রস উপহার দিন। সেই কবে কর্মযোগে স্বামী বিবেকানন্দ গৃহীকে উত্তম বাক্য বলিবার সামর্থ্য অর্জন করিতে বলিয়াছিলেন। এই তো সেই অনুশীলনের সু-সময়। বাক্য ব্রহ্ম, বাক্য প্রেম, বাক্যই তত্ত্বসার। বাক্যের কী অমোঘ অঘটনপটীয়সী ক্ষমতা, তাহা গীতার শ্রীকৃষ্ণ জানিেতন। করোনার প্রেমিকই বা জানিবেন না কেন!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy