‘বিকল্প আদর্শ’ শুধু আখ্যানেই সীমাবদ্ধ রাখেননি দেবেশ, হয়তো তাঁর দীর্ঘ জীবনচর্যায় লেখকের আত্মসম্মান-চিহ্নিত ‘স্বাধীনতা’কেও তিনি ‘বিকল্প’ হিসেবে রক্ষা করতে চেয়েছেন।
তাঁর কথাই প্রথমে শুনে নিই একটু। ‘...জলপাইগুড়ির গ্রাম, তার রাজবংশী মানুষজন, সেই মানুষজনে বিবৃত প্রকৃতি, রাজবংশী বাচন, তিস্তা নদী, চা বাগানের শ্রমিক, ডুয়ার্স, ফরেস্টের লোকজন, ফরেস্টের গাছপালা-জঙ্গল-পশুপাখির এক ভুবনে আমার অধিকার কায়েম হতে শুরু করল, দিনের পর দিন ধরে, বছরের পর বছর ধরে। রাজনীতির অজস্র দৈনন্দিন কাজের আষ্টেপৃষ্ঠে লিপ্ততা ছাড়া এ অধিকার আয়ত্ত করা অসম্ভব ছিল কারণ এ কোনো ভ্রমণের অধিকার নয়, এ কোনো দর্শন-শ্রবণের অধিকার নয়, এ এক জনপদের প্রতিদিনের জীবনযাপনের সঙ্গে লেপ্টে যাওয়া, সেই জীবনযাপনের ইতিহাস-ভূগোলের সঙ্গে সেঁটে থাকা। আমার আর কোনো উদ্ধার ছিল না। বা, সেই ছিল আমার একমাত্র উদ্ধার।... বছরের পর বছরের অজস্র গ্রন্থিতে এমন এক বিদ্যুৎ-সংবহন ব্যবস্থার ভিতরে আমি নিজেকে জড়িয়ে ফেলেছি যার বাইরে আমার কোনো প্রজ্বলন নেই, কোনো শিহরন নেই। আবার অন্যদিকে, জলপাইগুড়ির কোনো লোকজীবনই যেন এখনো আমার গল্প-উপন্যাসের পরীক্ষাভূমি— তা সে ঘটনা বা চরিত্র ভারতবর্ষের যে-অঞ্চলেরই হোক না কেন।’ (ভূমিকা/ গল্পসমগ্র)
বা, এই শব্দগুলো: ‘একজন ঔপন্যাসিক লিখতে চাইছে ব্যক্তির ঐতিহাসিকতা। ব্যক্তির ইতিহাস মানে ব্যক্তির জীবনী নয়। সেই জীবন যে-ইতিহাসের অংশ সেই ইতিহাসে সেই ব্যক্তিকে স্থাপন করাই উপন্যাসের কাজ।’ (সাক্ষাৎকার/ ১৩৯৬)
দেবেশ রায় (১৯৩৬-২০২০) বাংলা কথাসাহিত্যের সেই বিস্ময় যিনি নিজস্ব ঘরানা-বাহিরানায় সমাজবিশ্ব আর ব্যক্তিমানুষকে আশ্চর্য নৈপুণ্যে গভীর সংবেদনে তরঙ্গায়িত করেন। তাঁর সমগ্র কথাসাহিত্য সেই দূরপাল্লার নৌবহর। দূরবিনের দুই দিক দিয়ে তিনি ক্রমান্বয়ে দেখে গিয়েছেন দেশকাল, প্রান্ত প্রান্তিক, ভণ্ড ধ্বস্ত অথচ প্রতিরোধী বাস্তবতা। ইতিহাস পুরাণের প্রেক্ষিতে ব্যক্তিমানুষের উত্থান তাঁর প্রিয় বিষয়। এখানেই তিনি স্বতন্ত্র, সমুজ্জ্বল।
আরও পড়ুন: পণ্ডিতবলয় থেকে রাজপথ জুড়ে
যযাতি, মানুষ খুন করে কেন, আপাতত শান্তিকল্যাণ হয়ে আছে থেকে মফস্বলি বৃত্তান্ত, তিস্তাপারের বৃত্তান্ত, সময় অসময়ের বৃত্তান্ত, তিস্তাপুরাণ, বরিশালের যোগেন মন্ডল কিংবা সাম্প্রতিক সাংবিধানিক এজলাস (২০১৯) সেই অভিযাত্রার প্রতিচিত্রায়ণ। কমিউনিস্ট পার্টির কর্মী হিসেবে তাঁর জনবৃত্তে পদার্পণ, সে কথা বারংবার মনে করিয়ে দেন তিনি, কিন্তু তাঁর সমগ্র রচনায় ‘পার্টি’তন্ত্র বা দলদৃষ্টি নয়, এক বহুবিচিত্র সুরসঙ্গতি ঢেউয়ের মতো আছড়ে পড়ে। সমাজ-সংসার অতীত-বর্তমান ক্ষুদ্রতুচ্ছকে ছুঁয়ে ছুঁয়ে তিনি মহাকায় এক ভবিষ্যতের আভাস পাঠককে দেন।
হয়তো সে জন্যই প্রথম দিকের রচনায় তিনি প্রতীক এবং সঙ্কেতকে বারংবার ব্যবহার করেন। চলন্ত, বন্ধ ট্রেনের কামরায় বাইরে থেকে যারা ঢুকতে চাইছে তাদের নিয়ে কামরার মানুষ ভয়ার্ত, নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কিত। ‘এই চার যুবক কোন্ দলের? মারবার না বাঁচাবার? এই চার মানুষ কী চায়? মারতে না বাঁচতে?’ গল্পের নাম নিরস্ত্রীকরণ কেন? অকল্পনীয় ব্যঞ্জনা! আপাতত শান্তিকল্যাণ হয়ে আছে কাহিনির শেষে বীভৎস ফ্যান্টাসি সেই মৃত্যু উপত্যকাকে সঙ্কেতে ধরে ফেলে। ‘শান্তিকল্যাণ’ শব্দের বিস্ফোরণ ধ্বনিত হয়।
দেবেশ রায়ের কলমের সাহস এবং ধারণক্ষমতা এমনই। প্রবহমান, একটু নৈর্ব্যক্তিক জলধারার মতো ঘটনাবলির আখ্যান তৈরি হয়। ক্রমে স্পষ্ট হয়ে ওঠে তার মহা-অবয়ব। চরিত্র, ঘটনা, কথকভাষ্য, অতীত, বর্তমান, ইতিহাস, সংবাদ, রেডিয়ো, সরকারি তৎপরতা অথবা নিষ্ক্রিয়তা, চায়ের দোকানের আলোচনা, রান্নাঘর, অরণ্যবাস্তবতা, হাসিকৌতুক, বিবরণ সব মিলেমিশে অত্যাশ্চর্য আখ্যান-উৎসবের জন্ম দেয়। বিস্ময়াবৃত এবং অসহায় পাঠক যেন কাহিনির মধ্যে জাদুবলে আখ্যানের শিল্পরূপে ভেসে যেতে থাকে। হয়ে ওঠে ওই ইতিহাসপ্রবাহের শরিক।
১৯৮৯ সালে এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘প্রথম পরিচ্ছেদে লেখক হিসেবে লিখেছি, দ্বিতীয় পরিচ্ছেদে পাঠক হিসেবে react করেছি, বাইরে থেকে দেখলে প্রথম পরিচ্ছেদ উপন্যাস, দ্বিতীয়তে আত্মসংলাপ। এই ভাবে। কিন্তু উপন্যাস তো ঐভাবে তৈরি হয় না। ফর্মটাকে আমি বাইরের জিনিস মনে করি না। একটা ফর্ম যখন তৈরি হয় তখন লেখক বিষয়টাকে কীভাবে ধারণ করছেন, তাই ফর্ম হয়ে যায়।... আমি লিখবার সময় পাঠককে এটুকুই সাবধান করতে চেয়েছি যে তাঁরা যেন একে আমার অভিজ্ঞতা মনে না করেন। পাঠক ও লেখকের সম্মিলিত অভিজ্ঞতা করে তুলতে চেয়েছি।’
আখ্যানের ফর্ম বা আঙ্গিক নিয়ে দেবেশের মতো এত ‘সচেতন’ ভাবুক বাংলা সাহিত্যে বিরল। আছেন আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, নবারুণ ভট্টাচার্য এবং রবিশংকর বল-ও। তবে তাঁরা কেউই দেবেশ রায়ের মতো এত ধারাবাহিক নিষ্ঠায় ‘বিকল্প আদর্শ’ খুঁজে যাননি। বঙ্কিমচন্দ্র প্রযোজিত ইউরোপীয় নভেল ঘরানার প্রতিস্পর্ধী এক ‘নিজস্ব’ ‘দেশীয়’ ঐতিহ্যের আখ্যান খুঁজেছিলেন দেবেশ। সে জন্য ফিরে গিয়েছিলেন পালাকীর্তনে মঙ্গলকাব্যে কিংবা গ্রামীণ বাচনে। আক্ষেপ করে বলেছেন, ‘তাই বয়স বাড়ার সঙ্গে-সঙ্গে, নবীন-নবীন আধুনিকতার সঙ্গে-সঙ্গে, বাংলা গল্প-উপন্যাস বাঙালির লোকজীবন থেকে সরে গেছে। তার ভাষা থেকে ঝরে গেছে লোকবাচনের রহস্যময়তা অথচ স্পষ্টতা, লোককৌতুকের প্রবল পৌরুষ, পৌরাণিককে ভেঙে ফেলার অদম্য লোকায়ত সাহস আর কাহিনীকারের নিজস্ব বিবরণের স্পষ্টতা।’ (উপন্যাস নিয়ে, পৃ ২৮) আমরা সহজেই বুঝতে পারি, কেন তাঁর কথাসাহিত্যে ‘বৃত্তান্ত’, ‘পুরাণ’, ‘প্রতিবেদন’ নামকরণে ফিরে ফিরে আসে।
এখানেই শেষ নয়। দেবেশ রায় একই অনুসন্ধিৎসায় পৌঁছে যান বাখতিন-এর ‘ডায়ালজি’ থেকে ‘পলিফনি’ উদ্ভবের হালহদিশে। কিংবা থিয়োডর আডোরনো-র ‘নাৎসিবাদ বিরোধী’ শিল্প-সাহিত্যতত্ত্বের সন্নিকটে, জনসংযোগের পদ্ধতিচর্চায়। বলা চলে তাঁর আখ্যানরচনা এক সুবৃহৎ মহাপ্রকল্প, তার কেন্দ্রীয় শব্দ ‘বিকল্প আদর্শ’ প্রতিষ্ঠা।
‘বিকল্প আদর্শ’ শুধু আখ্যানেই সীমাবদ্ধ রাখেননি দেবেশ, হয়তো তাঁর দীর্ঘ জীবনচর্যায় লেখকের আত্মসম্মান-চিহ্নিত ‘স্বাধীনতা’কেও তিনি ‘বিকল্প’ হিসেবে রক্ষা করতে চেয়েছেন। লেখার ‘মান’ যখন আপস করে বাজারি পণ্যের সঙ্গে, যখন বছরে বছরে লেখককে বাধ্যত লিখে যেতে হয় পরিকল্পনাহীন, অগভীর পৌনঃপুনিকতায়, সাহিত্যশ্রেষ্ঠীর অঙ্গুলিনির্দেশে, তখন দেবেশ মনে করেন, জনপ্রিয়তার হাতছানিতে বিনষ্ট হয় লেখকের ‘স্বাধীনতা’, লেখকের ‘দার্ঢ্য’। তিনি এই ‘বিকল্প’ অবস্থানের শরিক, সে জন্য এক-একটি রচনার জন্য হয়তো পাঁচ-সাত বছর নিতেও তাঁর আটকায়নি।
এই বিকল্পসন্ধানী লেখকসত্তার জোরেই তাঁর গদ্যরীতিও সচেতন ভাবে পল্লবিত হয়। তরল, সহজপাচ্য গদ্যে এই বিশাল অঙ্গসংস্থান হয়তো সম্ভবও ছিল না। স্বাধীনতা-উত্তর, বিশেষত বিশ শতকের শেষ দশকগুলিতে দেশদুনিয়ার পরিবর্তমান পরিস্থিতি, উত্তর-ঔপনিবেশিক পরিমণ্ডল, পুঁজির নতুন নতুন জটিল কৌশল, প্রভুত্ব আর কর্তৃত্বের নতুন নতুন নকশা, রাষ্ট্রক্ষমতার নিষ্পেষণ আর নয়া জীবন-বাস্তবতা তিনি যত্নে ধরেছেন কথাসাহিত্যে।
ঠিক এই প্রসঙ্গেই ঢুকে পড়ে আরও একটি প্রাসঙ্গিক শব্দ। ‘প্রত্যাখ্যান’। দেবেশ রায়ের উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্ররা ‘আধুনিক’ উন্নয়নের সমস্ত প্রক্রিয়াকেই প্রত্যাখ্যান করে। হয়ে ওঠে পুরাণ বা লোকগাথার আদিম অতিকায় এক প্রাকৃতিক শক্তি। সে প্রান্তিক থেকে হয়ে যায় মহাবিকল্পের দ্যোতনাবাহী লোকনায়ক। ইতিহাস থেকে তার উত্থান, ‘আধুনিকতা’কে তার প্রত্যাখ্যান। ‘বাঘারু এই ব্যারেজকে, এই অর্থনীতি ও এই উন্নয়নকে প্রত্যাখ্যান করল। বাঘারু কিছু কিছু কথা বলতে পারে বটে কিন্তু প্রত্যাখ্যানের ভাষা তাঁর জানা নেই। তার একটা শরীর আছে। সেই শরীর দিয়ে সে প্রত্যাখ্যান করল।... এই প্রত্যাখ্যানের রাত ধরে বাঘারু মাদারিকে নিয়ে হাঁটুক, হাঁটুক, হাঁটুক...’ (তিস্তাপারের বৃত্তান্ত)
ব্যক্তিগত স্মৃতি-বিস্মৃতি সর্বদাই নশ্বরের সঞ্চয়। পিতৃবন্ধু হিসেবে আশৈশব তিনি ঘনিষ্ঠজন। মতান্তর, দূরত্বে স্নেহে কখনও ঘাটতি দেখিনি। মাস পাঁচেক আগে তাঁর বাড়িতে দেখা হয়েছিল, অসুস্থতার মধ্যেও বার বার বলছিলেন, ‘লিখতে সব থেকে ভাল লাগে। রোজ লিখি। নতুন নতুন করে ব্যাপারটাকে বুঝতে পারি।’ মুখে ফুটে উঠছিল এক অমর্ত্য বিভা।
আজ মনে হয়, ‘লিখন’ এই শিল্পরূপটির চূড়ান্ত পর্যায়ে তিনি পৌঁছেছিলেন। যখন কাহিনি, চরিত্র, ঘটনা, পরম্পরা, বক্তব্য, সব তুচ্ছ করে দিয়ে ভাষা আর অনুভব বিমূর্ত উচ্চতায় স্বরাজ প্রতিষ্ঠা করে। তখন লেখক তুচ্ছ, পাঠক তুচ্ছ, সমকাল তুচ্ছ, সংসার তুচ্ছ, সমাজ তুচ্ছ, ব্যক্তিসঙ্কট তুচ্ছ, শুধু শিল্পরূপ ডানা মেলে দেয় নীল শূন্যতায়।
শেষে একটা কথা। উইকিপিডিয়ায় লেখক দেবেশ রায় নামে কোনও এন্ট্রি গতকাল ‘খুব বারোটা’য়ও দেখতে পাইনি। কার জয়? কার পরাজয়? না কি ‘কোকাকলোনাইজেশনের সময় এরকম ঘটে থাকে’?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy