দীর্ঘ রোগভোগের পর প্রয়াত হইলেন প্রদীপকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, বিশ্ব ফুটবল নিয়ামক সংস্থা তাঁহাকে বিংশ শতকের শ্রেষ্ঠ ভারতীয় ফুটবলার তকমা দিয়াছে। ভারতীয় ফুটবলের যে অধ্যায়কে সংজ্ঞায়িত করিয়াছিলেন ফুটবলার পিকে, তাহা বস্তুতই এক ভিন্ন যুগ। তখন ফুটবলারদের বেতন গগনচুম্বী ছিল না, ইউরোপীয় তারকারাও বাঙালির ঘরে ঘরে পরিচিত ছিলেন না। তখন ভারতের জাতীয় দলের যে কোনও খেলা দেখিতেই ভিড় উপচাইয়া পড়িত। তখন মাঠ ছিল রুক্ষ ও অমসৃণ এবং বল ছিল কঠিন চর্মনির্মিত। পরে প্রশিক্ষক হইয়া যখন ফুটবল-জীবনের দ্বিতীয় ইনিংস খেলিতে নামিলেন পিকে, তখনও তাহাতেও সমরূপ সাফল্য আসিল। সত্তর, আশি ও নব্বইয়ের দশক জুড়িয়া ইস্টবেঙ্গল ও মোহনবাগানের পক্ষে সমস্ত ঘরোয়া ট্রফি জিতিলেন। পেলের নিউ ইয়র্ক কসমসের বিরুদ্ধে মোহনবাগানকে গোলশূন্য ড্র করানোর ঘটনা তো ভারতীয় ফুটবল জগতে লোককথায় পরিণত হইল।
বিশেষজ্ঞরা বলিয়া থাকেন, ম্যান ম্যানেজমেন্ট স্কিল বা লোক সামলাইবার ক্ষমতা এবং রিডিং দ্য গেম বা খেলা বুঝিবার দক্ষতার জোরেই তিনি এত বড় প্রশিক্ষক হইয়া উঠিয়াছিলেন। কিন্তু এহ বাহ্য। পিকে-র প্রশিক্ষণ দিবার ধরনটি আজও শিক্ষণীয়। তিনি ছিলেন অসামান্য কথক— গল্প ও উপমায় দলের খেলোয়াড়দের অনুপ্রাণিত করিতেন। পিকে-র কোচিং কৌশল বিশ্লেষণ করিতে বসিলে এই ‘ভোকাল টনিক’-এর মাহাত্ম্যের কথাই বলিতে হয়। সম্ভবত আর এক কিংবদন্তি বাঙালি কোচ অমল দত্তের সহিত পিকে-র সর্বজনবিদিত দ্বৈরথের বীজটিও এই স্থলেই নিহিত। ভারতীয় ফুটবলে ‘ডায়মন্ড সিস্টেম’-এর প্রবর্তক অমল দত্তের দুর্ভেদ্য কৌশল ১৯৯৭ সালে ভাঙিয়া দিতে সক্ষম হইয়াছিলেন পিকে। পাল্টা কৌশলে নহে, বক্তৃতায় চাঙ্গা করিবার নিজস্ব চালেই। তিনি জানিতেন, কী করিয়া বড় খেলোয়াড়দের অহং বশে রাখিতে হয়। জানিতেন, কী করিয়া এক সঙ্গে বহু তারকাকে চালাইতে হয়। অনবদ্য উপস্থাপন ভঙ্গিই তাহার চাবিকাঠি।
স্মরণে রাখা ভাল, পিকে মূলত স্বশিক্ষিত ছিলেন। এক সরকারি চাকুরিজীবীর সাত সন্তানের বরিষ্ঠ এই পুত্র ১৯৫৫ সালে মাত্র ১৯ বৎসর বয়সে আন্তর্জাতিক ম্যাচে মাঠে নামিয়াছিলেন। জাতীয় দলে তিনিই প্রথম ইনভার্টেড উইঙ্গার হিসাবে খেলেন। তাঁহার যোগ্য সঙ্গত ছিলেন সৈয়দ আবদুল রহিম, তুলসীদাস বলরাম ও চুনী গোস্বামী। উইং হইতে চকিতে ভিতরে ঢুকিয়া গোল দিবার ক্ষমতা তাঁহার ছিল। কখনও বা দূরে থাকিয়া অবশিষ্ট দুই জনকে বল বাড়াইতেন। এই রূপেই ১৯৬০-এর সূচনায় ভারতীয় দলকে তাহার অন্যতম শ্রেষ্ঠ যুগে পৌঁছাইয়া দিয়াছিল এই ত্রয়ী। খেলোয়াড় হিসাবে পিকে-র অন্যতম সেরা কীর্তি ১৯৬০ অলিম্পিক্সে ভয়ানক ফ্রান্স দলের বিরুদ্ধে গোল। অবসরের পরেও প্রশিক্ষক হিসাবে ফুটবলের সহিত পিকে-র যোগ রহিয়া গিয়াছিল। কোচ হিসাবে ভগ্নস্বাস্থ্য হইবার পরেও পিকে ভারতীয় ফুটবলের প্রতি উদাসীন হন নাই। ধারাভাষ্যকার হিসাবে স্থানীয় ফুটবলের ক্রমাবনতি নিয়ে বিলাপ করিতেন, তাহাকে পুনরুজ্জীবিত করিবার জন্য নানা পন্থাও বাতলাইয়া দিতেন। খেলার কৌশলের অপেক্ষাও খেলোয়াড়ের সহিত কোচের সংযোগ দিয়াই যে লড়াই অনেক দূর জিতিয়া ফেলা যায়, তাহা প্রমাণ করিয়া গিয়াছেন পিকে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy