আদালতের নির্দেশে পুলিশের হেফাজত হইতে ছাড়া পাইবার পর আনন্দ তেলতুেম্ব বলিয়াছেন, তাঁহার বিরুদ্ধে নয়, ভিন্ন মতাদর্শের বিরুদ্ধে অবস্থান লইয়াছে রাষ্ট্র। আজ তাঁহাকে ধরিয়াছে, কাল ধরিবে অপর কোনও ব্যক্তিকে। গোয়া ইনস্টিটিউট অব ম্যানেজমেন্ট-এর অধ্যাপকের দাবি ভিত্তিহীন নয়। ২০১৭ সালের ডিসেম্বরে মহারাষ্ট্রের ভীমা কোরেগাঁওয়ের দলিত সমাবেশে যে হিংসা ঘটিয়াছিল, তাহার সরকারি তদন্ত অতি বিচিত্র পথে চলিয়াছে। দেশবাসীর মনে সংশয় জাগে, ঘটনার অনুসন্ধান করিয়া সাক্ষ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে দুষ্কৃতীর অনুসন্ধান করিতেছে পুলিশ? না কি, ভিন্ন রাজনৈতিক আদর্শের মুখপাত্রদের চিহ্নিত করিয়া তাঁহাদের সহিত ঘটনার সংযোগসূত্র খুঁজিয়া বেড়াইতেছে? ইহার পূর্বে সুধা ভরদ্বাজ, ভারাভারা রাও, গৌতম নওলখা, সোমা সেন প্রমুখ নয় জন বিশিষ্টকে ভীমা কোরেগাঁওয়ের ঘটনায় গ্রেফতার করা হইয়াছে। আকস্মিক তল্লাশি এবং গ্রেফতার করিবার যে নকশা তৈরি করিয়াছে পুেণ পুলিশ, তাহা কতটা অনুসন্ধানের প্রয়োজনে আর কতটা বিরোধী মতাদর্শের মুখপাত্রদের মনে ত্রাস উদ্রেকের প্রয়োজনে, সে প্রশ্ন উঠিয়াছে। তেলতুেম্বর ক্ষেত্রে সে প্রশ্নটি তীক্ষ্ণতর, কারণ সুপ্রিম কোর্ট তাঁহাকে ১১ ফেব্রুয়ারি অবধি গ্রেফতার না করিবার নির্দেশ দেয়। শীর্ষ আদালতকে গ্রাহ্য করিয়া পুণে পুলিশ তাঁহাকে ২ ফেব্রুয়ারি গ্রেফতার করে।
তেলতুেম্ব দলিত অধিকার আন্দোলনের কণ্ঠ হিসাবে সুপরিচিত। তাঁহার গতিবিধি, কর্মস্থল কিছুই গোপন নহে। তৎসত্ত্বেও কোচি হইতে গৃহে প্রত্যাবর্তনের সময়ে তাঁহাকে পলায়নোদ্যত অপরাধীর ন্যায় বিমানবন্দর হইতে গ্রেফতার করা হয়। যদিও আদালত সেই গ্রেফতারকে অবৈধ রায় দেওয়ায় কয়েক ঘণ্টার মধ্যে তেলতুেম্বকে ছাড়িয়া দিতে বাধ্য হয় পুলিশ। একই ভাবে, গত বৎসর অগস্ট মাসে সুধা ভরদ্বাজ প্রমুখ পাঁচ জনকে গ্রেফতারের পর সুপ্রিম কোর্ট পুলিশকে তাঁহাদের হেফাজতে লইতে দেয় নাই। এক মাসের অধিক সময় তাঁহারা গৃহবন্দি থাকেন। অতএব প্রশ্ন উঠিবে, যাঁহারা নিজ নিজ ক্ষেত্রে সুপরিচিত ব্যক্তি, তাঁহাদের গ্রেফতার করিবার জন্য পুলিশ এমন মরিয়া হইয়া উঠিয়াছে কেন? অতি বামপন্থা হইতে মাওবাদের ন্যায় হিংসাশ্রয়ী আন্দোলন জন্ম লইয়াছে, তাহা সত্য। কিন্তু বামাদর্শী মাত্রেই তো হিংসাদর্শী নহেন। নানা প্রকার রাজনৈতিক এবং সামাজিক আন্দোলন সেই মতবাদকে কেন্দ্র করিয়া গড়িয়া উঠিয়াছে। তাহার অনেকগুলিই দরিদ্রতম, প্রান্তিকতম মানুষদের সংগঠিত করিয়া উন্নততর জীবনের পথ দেখাইয়াছে। দলিত আন্দোলন আজ গণ-আন্দোলনে পরিণত হইয়াছে। অম্বেডকরপন্থীদের সহিত বিবিধ প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর আন্দোলন মিলিয়া শক্তি বাড়াইয়াছে।
কোনও আন্দোলনের সহিত সরকারের বিরোধ থাকিতেই পারে। কিন্তু সেই বিরোধিতা গ্রেফতারযোগ্য শত্রুতায় পর্যবসিত হইতে পারে না। গত পাঁচ বৎসরে যাঁহারাই হিন্দুত্ববাদ, উগ্র জাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধে সরব হইয়াছেন, তাঁহাদের ‘অপরাধী’ বলিয়া চিহ্নিত করিতে রাষ্ট্র সচেষ্ট থাকিয়াছে। দলিত আন্দোলনের মুখপাত্রদের জন্য মিথ্যা মামলা, পুলিশি হয়রানি, অকস্মাৎ গ্রেফতারির মতো ‘শাস্তি’ ধার্য করিতে সরকারের যত আগ্রহ, দলিতদের বিরুদ্ধে হিংসার কিনারা করিতে তাহার কিয়দংশও নয়। ভীমা-কোরেগাঁওয়ে দলিত-মরাঠা সংঘর্ষের ঘটনায় ছয় শত মামলা হইয়াছে। অথচ রাষ্ট্রবিরোধিতা বা সাম্প্রদায়িক হিংসা উস্কাইবার অভিযোগে গ্রেফতার হইয়াছেন কেবল অম্বেডকরপন্থী, অতি বামপন্থী লেখক, সমাজকর্মী, শিক্ষাবিদরা। বিরুদ্ধ মতের প্রতি বিদ্বেষ, বিশেষত অতি বাম মতাদর্শের ‘বিপদ’ প্রচারের কাজটি নূতন নয়। কিন্তু মোদী সরকারের শাসনকালে তাহার তীব্রতা এতই বাড়িয়াছে যে আদালতের নির্দেশও মান্যতা হারাইয়াছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy