ম হারাষ্ট্রের ভীমা-কোরেগাঁওতে প্রতি বৎসর পয়লা জানুয়ারি দলিত সমাবেশের প্রথাটি প্রায় শতাব্দীপ্রাচীন। দলিত আত্মপরিচয়ের রাজনীতির নিকট— যাহার সঙ্গে উচ্চ বর্ণের, মহারাষ্ট্রে পেশোয়া ব্রাহ্মণ্যবাদের, মরাঠা খণ্ডজাতীয়তার বিরোধ অতি স্পষ্ট এবং প্রত্যক্ষ— এই সমাবেশটির প্রতীকী মাহাত্ম্য বিপুল। এই বৎসর ভীমা-কোরেগাঁও যুদ্ধের দ্বিশতবার্ষিকী ছিল। দলিত সমাগমের পরিমাণও যে বাড়িবে, তাহা অনুমান করাও কঠিন ছিল না। সেই সমাবেশেই হিন্দুত্ববাদীরা অশান্তি বাধাইল। প্রকাশ্য যুক্তিটি উগ্র জাতীয়তাবাদের। ২০০ বৎসর পূর্বের সেই যুদ্ধে পেশোয়াদের হারাইয়াছিল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সেনাবাহিনী। পেশোয়ার বাহিনীতে ব্রাত্য মাহার সম্প্রদায়ের সৈন্যরা সেই যুদ্ধে কোম্পানির পদাতিক ছিল মাত্র। অতএব, তাহার উদ্যাপন আসলে বৈদেশিক শক্তির জয়ে উল্লসিত হওয়া। যুক্তিটি ইতিহাসবোধশূন্য। কিন্তু, ইহাই নরেন্দ্র মোদীর ভারতের মাহাত্ম্য। উগ্র জাতীয়তাবাদকে ‘বৈধতা’ দেওয়ার ফলে এখন নিচু স্তরের কর্মীদের উপর নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখা কার্যত অসম্ভব। যে কোনও আঞ্চলিক বিরোধকে জাতীয়তাবাদের প্রশ্নে পরিণত করিয়া হিসাব মিটাইয়া লওয়ার প্রবণতাটি সর্বাত্মক হইতেছে। মহারাষ্ট্রে মরাঠা বনাম দলিত বিরোধের প্রশ্নটিও সেই গোত্রেরই। মরাঠারা সংরক্ষণের দাবি করিতেছেন। সেই দাবি মানা এবং না মানা, উভয়ই দেবেন্দ্র ফডণবীসের সরকারের পক্ষে কঠিন। প্রশ্নটি, অতএব, অমীমাংসিত রহিয়াছে। ভীমা-কোরেগাঁওয়ের ঘটনায় সেই স্থানীয় বিরোধের তাৎপর্য অস্বীকার করা মুশকিল।
দলিত রাজনীতি লইয়া বিজেপির অস্বস্তি ক্রমবর্ধমান এবং নানা ভাবে তাহা ফুটিয়া বাহির হইতেছে। ভীমা-কোরেগাঁওয়ে জিগ্নেশ মেবাণী, সোনি সোরি বা রোহিত ভেমুলার মায়ের উপস্থিতি নেহাত সমাপতন নহে। নরেন্দ্র মোদীরা সম্ভবত টের পাইতেছেন, তাঁহাদের মূলত ব্রাহ্মণ্যবাদী হিন্দু রাজনীতির প্রতিস্পর্ধী শক্তি হিসাবে ভারতের বিভিন্ন প্রান্তের দলিত আন্দোলনগুলি ক্রমেই সংযুক্ত হইতেছে, এবং এমন কিছু প্রশ্ন তুলিতেছে, যাহার উত্তর নাগপুরের নিকট নাই। এই রাজনীতিকে ঠেকানো বিজেপির পক্ষে কেন কঠিন, মহারাষ্ট্রের উদাহরণটিই তাহা বলিয়া দিবে। শিবজি মহারাজ-কেন্দ্রিক মরাঠি আত্মপরিচয়ের যে রাজনীতি রাজ্যে বিজেপির অন্যতম প্রধান ভরসা, তাহার সহিত দলিত রাজনীতির বিরোধ প্রত্যক্ষ। সেই বিরোধকে মুছিয়া, বা অন্তত ধামাচাপা দিয়া প্রতিস্পর্ধী শক্তিগুলিকে বৃহত্তর হিন্দুত্বের ছাতার তলায় লইয়া আসিতে গেলে যে উদারতা এবং সহনশীলতা প্রয়োজন, আরএসএস-বিজেপির তাহা নাই। ফলে, উনা হইতে ভীমা-কোরেগাঁও, বিভিন্ন প্রান্তে আগুন জ্বলিয়া উঠিতেছে।
‘আরএসএস-বিজেপি’ সমষ্টির পক্ষে কি আদৌ দলিত রাজনীতির নিকট পৌঁছানো সম্ভব? রাজনীতি সম্ভাব্যতার শিল্প, ফলে পূর্বাভাস বিপজ্জনক। কিন্তু, নাগপুরের রাজনীতির প্রাণকেন্দ্রে যে ব্রাহ্মণ্যবাদ রহিয়াছে, তাহা এই নৈকট্যের পরিপন্থী। ভীমা-কোরেগাঁওতে যাহারা অশান্তি বাধাইল, অনুমান করা চলে, তাহারা ভাবিয়াছিল, ভাল করিয়া পিটিলেই দলিতদের শায়েস্তা করিয়া দেওয়া যাইবে। তাহাদের দোষ নাই, উচ্চবর্ণ এই ভাবেই ভাবিতে অভ্যস্ত। বস্তুত, বৃহত্তর হিন্দুত্বের গল্পটিতে যদি দলিত নিম্নবর্ণকে ধরিতে হয়, তবে তাঁহাদের জীবনযাত্রা, খাদ্যভ্যাসকেও ঠাঁই করিয়া দিতে হইবে। হিন্দুত্বের ছাতার তলায় গোমাংস ভক্ষণ মানিয়া লওয়া কি সহজ? ফলে, নরেন্দ্র মোদীরা বিলক্ষণ জানেন, তাঁহাদের রাজনীতির পক্ষে নেমেসিস হইল দলিত প্রতিরোধ। কিন্তু, তাঁহাদের উপর আক্রমণের তীব্রতা বাড়াইয়া যে সেই প্রতিরোধকে প্রতিহত করা যাইবে না, এই কথাটি তাঁহারা বুঝিতে নারাজ। ফলে, ভীমা-কোরেগাঁওতেই গল্পটি ফুরাইবার আশা কম।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy