এক কোটি আশি লক্ষ। প্রতি দিন এই সংখ্যক ভুয়ো মেল আসে গুগলের মেল, জিমেলে। সম্প্রতি একটি ব্লগ পোস্টে গুগল নিজেই তা জানিয়েছে। এই বিপুল সংখ্যক ভুয়ো মেলের বিষয়বস্তুও এক। যে বিষয় নিয়ে এখন গোটা বিশ্ব উদ্বিগ্ন, সেই করোনাভাইরাস। ভাইরাস ঘটিত অতিমারি নিয়ে বিশ্বজোড়া জনমনের এই আশঙ্কাই এখন পুঁজি সাইবার-দুষ্কৃতীদের।
করোনাভাইরাসের প্রতিষেধক এখনও আবিষ্কৃত হয়নি। আতঙ্কও কমেনি। কেবল ভারতবর্ষের মতো গরিব দেশ নয়, আতঙ্ক উন্নত দেশগুলির নাগরিকদের মধ্যেও। তাই করোনাভাইরাসকে ঠেকানোর নানাবিধ সামগ্রীর পসার সাজিয়ে প্রতারণার ফাঁদ পাতছে সাইবার-ঠগরা। এন-৯৫ মাস্ক, গ্লাভস, বর্মবস্ত্রের (পিপিই) খোলাবাজারে মেলা কঠিন হয়ে যেতেই ডার্ক ওয়েবে এই সব জিনিসের পসরা সাজানো হয়েছে। বিক্রির তালিকায় রয়েছে করোনা সংক্রমণ থেকে সেরে ওঠা মানুষের রক্তও। তা শরীরে নিলে নাকি করোনা হবে না!
যুক্তি দিয়ে ভাবলে এমন অবান্তর দাওয়াই কারও বিশ্বাসই করার কথা নয়। কিন্তু আতঙ্ক ও উদ্বেগ এমন মানসিক অবস্থার মধ্যে নিয়ে যাচ্ছে, যে যুক্তি বা বিবেচনা কাজে লাগানোর মতো অবস্থায় অনেকে থাকছেনই না। আবিষ্কারের আগেই চড়া দামে ডার্ক ওয়েবে বিক্রি হচ্ছে করোনাভাইরাসের প্রতিষেধকও! অস্ট্রেলিয়ার এক অপরাধবিজ্ঞান গবেষণা কেন্দ্রের রিপোর্ট অনুযায়ী এমন প্রতিষেধকের গড়পড়তা দাম ৩৭০ ডলার। আবার চিন থেকে আনা বলে দাবি করা হলে সেই প্রতিষেধকের দাম ১৫০০০ ডলার পর্যন্ত!
আমেরিকার জাতীয় নিরাপত্তা সংস্থায় মানব-আচরণের বিশ্লেষক হিসেবে কাজ করতেন মর্গান রাইট। ক’দিন আগে তিনি একটি সাক্ষাৎকারে বিবিসিকে বলেছেন, ‘‘এই অতিমারির ভয়, অনিশ্চয়তাই দুষ্কৃতীরা ব্যবহার করছে। মানুষ উৎকণ্ঠার বশে মরিয়া হয়ে এমন জিনিস চাইছেন যা স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে কখনওই চাইতেন না।’’
সাইবার অপরাধীরা নিজেদের পরিচিতি গোপন রাখতে চান, তাই তাঁদের চলাচল ডার্ক ওয়েবে। এই ডার্ক ওয়েবে নির্দিষ্ট প্রযুক্তি ছাড়া সকলের পক্ষে পৌঁছনো সম্ভব নয়। সেখানে এই সব প্রতারণা ছাড়াও চলে অনলাইন জুয়া, মাদকের কারবার। টাকাপয়সার লেনদেন হয় বিটকয়েনে। এই ডার্ক ওয়েবের মাধ্যমেই কিন্তু অনেক সময় মানবাধিকার কর্মীরা, হুইসলব্লোয়াররা দুর্নীতি ফাঁস করেছেন, যা রাষ্ট্রের নজরদারিতে থাকা প্রকাশ্য ইন্টারনেটে করা সম্ভব নয়। সেই নজরদারি এড়ানোর সুযোগ নিচ্ছে দুষ্কৃতীরাও। এ যেন ঠিক শাঁখের করাত।
আজকের পরিস্থিতিতে শাঁখের করাত হয়েছে মানুষের সহমর্মিতা, সাহায্য করার মানসিকতাও। মানবমনের এই ইতিবাচক বৈশিষ্ট্যগুলিও সাইবার অপরাধীদের পুঁজি হয়ে উঠছে। অনেকে করোনা-পরিস্থিতিতে কোনও উদ্যোগের পাশে দাঁড়াতে চেয়ে টাকা দিতে চাইছেন। আসলে কিন্তু কোনও ছদ্মবেশে সেই টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে দুষ্কৃতীরা। তার বহু উদাহরণ দেখা গিয়েছে আমাদের দেশেই।
করোনা-পরিস্থিতি মোকাবিলায় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ‘পিএম কেয়ার্স’ ফান্ডের ঘোষণা করতেই তার আসল ওয়েবসাইটের আদলে একাধিক ভুয়ো ওয়েবসাইট তৈরি হয়ে গিয়েছে। সেগুলির লিঙ্ক দুষ্কৃতীরা ছড়িয়ে দিয়েছে ইমেল, এসএমএস, হোয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমে। খুব ভাল করে যাচাই না করলে কোনও সাধারণ মানুষের পক্ষে বোঝা কঠিন যে এগুলি ভুয়ো ওয়েবসাইট। এমন অনেক লিঙ্কে গিয়ে আর্থিক সাহায্য করে প্রতারিত হয়েছেন দেশের নানা প্রান্তের অনেকে। তেমন অভিযোগও এসেছে পুলিশের কাছে। দিল্লি পুলিশ জানিয়েছে, প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণার পরই আশিটিরও বেশি টাকা নেওয়ার ভুয়ো ইউপিআই (মোবাইলের মাধ্যমে সরাসরি অ্যাকাউন্টে টাকা দেওয়ার প্রযুক্তি) আইডি-র খোঁজ মিলেছিল। ফাঁদে পা দিয়ে সেই সব ছদ্ম অ্যাকাউন্টে টাকা দিয়েছেন দেশ-বিদেশের অনেকেই। অভিযোগের সংখ্যা ছাড়িয়েছে আট হাজার। সাম্প্রতিক ঘূর্ণিঝড় আমপানের পরও টাকা তোলার এমন ফাঁদ পাতা হল কি না কে জানে!
প্রতারকদের পক্ষে সময়টা আরও সুবিধেজনক, অসংখ্য পেশাদার বাড়ি থেকে ইন্টারনেটের মাধ্যমে কাজ করায়। সাধারণ অবস্থার থেকে অনেক বেশি মানুষ ইন্টারনেটে অনেক বেশি সময় কাটাচ্ছেন, তাই সাইবার-দুষ্কৃতীদের ‘শিকার’ ধরার সুযোগও বেড়েছে অনেকগুণ। ঘরবন্দি দশায় সময় কাটাতে অনলাইন স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্মের নানা ভুয়ো অফার ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে মেলে। নানা কৌশলে হাতিয়ে নেওয়া হচ্ছে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট, ক্রেডিট কার্ডের মতো ব্যক্তিগত তথ্য। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের একটি সূত্রই সংবাদমাধ্যমে দাবি করেছে, লকডাউন শুরু হওয়ার পরে মার্চ থেকে এপ্রিলের চার সপ্তাহেই এমন সাইবার-হানা বেড়েছে ৮৬ শতাংশ। দুষ্কৃতীদের আক্রমণের লক্ষ্য হয়ে উঠছে সরকারি সংস্থা, এমনকি করোনা-পরিস্থিতি মোকাবিলায় লড়ে যাওয়া বহু স্বাস্থ্য সংস্থার ওয়েবসাইট। হানা দিয়ে পরিষেবা অচল করে দিয়ে টাকা আদায় করা বা গোপন তথ্য হাতিয়ে নেওয়াই দুষ্কৃতীদের লক্ষ্য।
সাইবার দুনিয়ায় দুষ্কৃতীদের দাপাদাপি তাড়াতাড়ি কমবে বলে মনে হয় না। কারণ দেশ, তথা বিশ্ব জুড়েই করোনাভাইরাসকে সঙ্গে নিয়েই জীবনযাত্রা চালুর ভাবনাচিন্তা চলছে। তা হলে পারস্পরিক দূরত্ব বজায় রাখার শর্তে বাড়ি থেকে কাজ, অনলাইন বাজার, ব্যাঙ্ক-সহ নানা পরিষেবার জন্য ইন্টারনেটের উপর নির্ভরতা বৃদ্ধিও অবশ্যম্ভাবী। রাষ্ট্র বা প্রশাসন কী ভাবে এই সাইবার অপরাধকে নিয়ন্ত্রণ করবে সেটা একটা কথা। আর আমরা, ইন্টারনেট ব্যবহারকারীরা কী করব, সেটা আর এক কথা। বদলে যাওয়া বাস্তবতাটা বুঝে আমাদের নিজেদেরও সতর্ক হওয়া জরুরি। ইন্টারনেটে পাওয়া কোনও কিছুকেই ভাল করে না যাচাই করে বিশ্বাস না করাটা হতে পারে সেই সতর্কতার প্রথম ধাপ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy