মহারাষ্ট্রে গত ৬ মার্চ থেকে ১২ মার্চ অল ইন্ডিয়া কিসান সভার নেতৃত্বে অনুষ্ঠিত হল ‘লং মার্চ’, যাতে প্রায় পঁয়ত্রিশ হাজার কৃষক ১৮০ কিলোমিটার পথ হেঁটে সরকার ও গণমাধ্যমের নজর কাড়লেন। এই প্রতিবাদ মিছিলের অন্যতম গুরুত্ব ছিল এর দাবিদাওয়ার সামগ্রিকতা। কী নেই সেখানে! ঋণ ছাড় থেকে শুরু করে ফসলের ক্ষতিপূরণ, ফসলের উৎপাদন ব্যয়ের কমপক্ষে দেড়গুণ সহায়ক মূল্য, গরিব কৃষক ও কৃষিশ্রমিকদের জন্য পেনশন, রেশন ব্যবস্থার সংস্কার, উন্নয়নের নামে কৃষি জমি অধিগ্রহণ বন্ধ, এমনকী অরণ্যের জমিতে আদিবাসীদের স্থায়ী অধিকার। এক কথায়, আজকের ভারতে কৃষক ও প্রান্তিক মানুষদের সামগ্রিক অব্যবস্থা ও অবহেলার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ। সাম্প্রতিক কালে দেশের বিভিন্ন স্থানেই ঘটছে কৃষক অসন্তোষের ঘটনা, কারণ কৃষির অবস্থা সারা দেশের কোথাও তেমন ভাল নয়।
মহারাষ্ট্রের এই কৃষক আন্দোলন দেখে একটা প্রশ্ন উঠতেই পারে— কৃষক আন্দোলনের ভিত্তিভূমি পশ্চিমবঙ্গে এই ধরনের মহামিছিল কি এখন সম্ভব? সেই প্রশ্নে আসতে গেলে আগে দেখে নেওয়া ভাল, মহারাষ্ট্রের সঙ্গে এ রাজ্যের কৃষির সামগ্রিক পরিবেশ ও পরিস্থিতির পার্থক্যগুলি কী কী? মহারাষ্ট্রে মোট কৃষিজমির মাত্র ১৭% সেচসেবিত, পশ্চিমবঙ্গে যা প্রায় ৫৪%, মহারাষ্ট্রে শস্য-প্রগাঢ়তা (ক্রপ ইনটেনসিটি, অর্থাৎ একই জমি বছরে ক’বার চাষ হয়, তার অনুপাত) ১২৭% কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে তা প্রায় ১৭৬%। এর অন্যতম প্রধান কারণ হল মহারাষ্ট্রে সেচ প্রায় পুরোটাই সরকারি ব্যবস্থার উপর নির্ভরশীল কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে ঠিক তার উল্টো। মাটি খুঁড়লেই যেহেতু জল পাওয়া যায়, তাই সেচের জন্য চাষিকে এখানে সরকারের উপর বিশেষ নির্ভর করতে হয় না। সর্বোপরি, মহারাষ্ট্র ও পশ্চিমবঙ্গে প্রান্তিক ও ক্ষুদ্র চাষিরা যথাক্রমে ৪৫.১৫% এবং ৮০.৭২% জমিতে চাষ করেন।
মহারাষ্ট্র ও পশ্চিমবঙ্গের আর একটি বড় পার্থক্য হল ফসলের প্রকৃতিতে। মহারাষ্ট্রে কৃষিতে বাণিজ্যিকীকরণ হয়েছে বহু দিন আগে। সেখানে আর খাদ্যশস্যের চাষ তেমন হয় না। তাই পশ্চিমবঙ্গে ধান আর আলু হল প্রধান ফসল, মহারাষ্ট্রে আখ ও তুলো। ধানের তুলনায় তুলো চাষে ঝুঁকি অনেক বেশি। আর তা ছাড়া, খাদ্যশস্যের চাষে লাভ না হলেও চাষি না খেয়ে মরে না। পশ্চিমবঙ্গে আশির দশকে ভূমি সংস্কার, অপারেশন বর্গার মাধ্যমে কৃষিজমির যে বণ্টন ঘটেছিল তার সুফল কমতে শুরু করেছিল গত দুই শতকে। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় এসেছে শিল্পের জন্য কৃষিজমি অধিগ্রহণের বিরুদ্ধে আন্দোলনের মধ্য দিয়ে। কৃষি উন্নয়নের জন্য এই সরকারের আমলে নেওয়া হয়েছে একগুচ্ছ কর্মসূচি। এগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল কিসান মান্ডি তৈরি, ফসলের ক্ষতি হলে কৃষকদের ক্ষতিপূরণ দেওয়া, কৃষকদের কাছ থেকে সরাসরি ধান কেনা, বয়স্ক গরিব চাষিদের পেনশন, মিউটেশন ফি মকুব ইত্যাদি। এর সম্মিলিত ফল হিসাবে পশ্চিমবঙ্গ বর্তমানে সারা ভারতের মধ্যে কৃষি বিকাশের হারে অনেকটা এগিয়ে রয়েছে এবং পর-পর পাঁচ বার ভারত সরকারের ‘কৃষি কর্মন’ পুরস্কারও পেয়েছে। পাশাপাশি, সাম্প্রতিক কালে এ-রাজ্যে রেশনিং ব্যবস্থার সংস্কারও হয়েছে, যার সুফল পেয়েছেন গরিবের পাশাপাশি গ্রামের কৃষকও।
তবে কি বুঝতে হবে, এ-রাজ্যের কৃষকরা খুব একটা সমস্যার মধ্যে নেই? তা কিন্তু ঠিক নয়। কিছুটা কাজ হলেও, এই রাজ্যে কৃষি পরিকাঠামোর অনেক ঘাটতি রয়েছে। সেচ ব্যবস্থার সংস্কার দীর্ঘ দিন ঠিক মতো হয়নি, ফলে সেচের সমস্যা বাড়ছে। নানান প্রচেষ্টা সত্ত্বেও চাষির অভাবী বিক্রি বন্ধ করা যায়নি। বাজারদর কম থাকলে চাষির লোকসান হয়, কিন্তু বেশি থাকলেও তার থেকে লাভ তোলে মূলত ব্যবসায়ী বা ফড়েরা, চাষিরা নয়। কৃষিপণ্যের অস্থির বাজারদর এর মূল কারণ। যেমন, গত কয়েক বছরে এ-রাজ্যের আলু চাষিরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন আর লাভ তুলেছেন ব্যবসায়ীরা। সাধারণভাবে বাজারে কৃষিপণ্যের দাম বাড়লে সরকার তা কমানোর ব্যবস্থা করে, কিন্তু চাষিরা কদাচিৎ তাঁদের উৎপাদিত দ্রব্যের ঠিক দর পান। ধান চাষে খরচ যে-ভাবে বেড়েছে সেই তুলনায় ন্যূনতম সহায়ক মূল্য বা বাজারদর বৃদ্ধির হার তো বাড়েইনি, উল্টে কমেছে। সর্বোপরি সারা দেশে কৃষক দুর্দশার দিনে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত প্রান্তিক ও ক্ষুদ্র চাষিরা, আর এ-রাজ্যে প্রায় ৯০ শতাংশ চাষিই এই শ্রেণির। এই ধরনের চাষিরাই আবার বেশির ভাগ লিজ নিয়ে অন্যের জমি চাষ করেন ও সাধ্যের অতিরিক্ত ঝুঁকি নিতে গিয়ে বিপদের মুখে পড়েন।
এ-বারে আসা যাক আন্দোলনের কথায়। স্বামীনাথন কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী মোট পরিবর্তনশীল খরচের উপর ৫০ শতাংশ হারে লাভ রেখে তুলোর ন্যূনতম সহায়ক মূল্য নির্ধারিত হলে তাতে তুলো চাষে লাভ বেশ কিছুটা বাড়বে, কেননা বর্তমান হিসাব অনুসারে তুলো চাষের খরচের উপর মাত্র ২৩ শতাংশ উদ্বৃত্ত ধরে ন্যূনতম সহায়ক মূল্য ঠিক করা আছে। তাই এই দাবিতে মহারাষ্ট্রের কৃষকের আন্দোলন করে লাভ আছে অনেক। অন্য দিকে, ধানের ক্ষেত্রে এই বছর মোট পরিবর্তনশীল খরচের উপর প্রায় ৩৯ শতাংশ লাভ রেখে ন্যূনতম সহায়ক মূল্য ধার্য করা হয়েছে। সুতরাং স্বামীনাথন কমিটির সুপারিশ কার্যকর হলেও ধানের ন্যূনতম সহায়ক মূল্য খুব একটা বাড়বে না। মহারাষ্ট্রের তুলনায় পশ্চিমবঙ্গে অপ্রাতিষ্ঠানিক ক্ষেত্র থেকে ঋণ নেওয়া কৃষকের সংখ্যা অনেক বেশি। মহারাষ্ট্রে যেখানে মাত্র ১৬.২ শতাংশ কৃষক অপ্রাতিষ্ঠানিক ক্ষেত্র থেকে ঋণ নেন, সেখানে পশ্চিমবঙ্গে এর হার প্রায় ৪২ শতাংশ। তাই এ-রাজ্যে ঋণ মকুবের দাবি তুলে খুব একটা লাভ হবে না। সবচেয়ে বড় কথা হল, মহারাষ্ট্রের কৃষকদের মতো পশ্চিমবঙ্গের কৃষকরা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই নিজে চাষ করেন না, চুক্তি মাফিক সাময়িক লিজে দিয়ে দেন অন্যকে। অন্যের জমি লিজ নিয়ে চাষ করেন এমন কৃষক পরিবারের আনুপাতিক হার মহারাষ্ট্রে যখন ৫.২১ শতাংশ, পশ্চিমবঙ্গে তা প্রায় ৩৭.১৮ শতাংশ। অর্থাৎ কৃষি ঋণ মকুব হলে পশ্চিমবঙ্গে জমির মালিকের লাভ হলেও আসলে যিনি চাষ করছেন তাঁর কোনও লাভ হবে না। কারণ তিনি জমির মালিক নন, আর তাই ব্যাঙ্ক থেকে না-পেয়ে ঋণ নিয়েছেন অপ্রাতিষ্ঠানিক ক্ষেত্র থেকে। যদিও কাগজে-কলমে জয়েন্ট লায়াবিলিটি গ্রুপ তৈরি করে ঋণ নেওয়ার সুযোগ তাঁদের আছে, তবে বাস্তবে এখনও তা কাজে তেমন আসেনি।
এ বার আসা যাক রাজনৈতিক তথা সংগঠনগত ক্ষেত্রটির কথায়। মুম্বইয়ের লং মার্চ-এর উদ্যোক্তা অল ইন্ডিয়া কিসান সভা হল কৃষকদের নিয়ে গঠিত সিপিআইএম-এর একটি শাখা সংগঠন। এখন পশ্চিমবঙ্গে এই সংগঠনের সক্রিয়তা নেই বললে খুব একটা ভুল হবে না। আবার শাসক দল তৃণমূলের কৃষক সংগঠনও (অল ইন্ডিয়া তৃণমূল কিসান কংগ্রেস) খুব একটা শক্তিশালী নয়। আর তা ছাড়া একই দলের সরকারের বিরুদ্ধে তারা আন্দোলনে সহজে যেতে চাইবে না। অর্থাৎ, এক কথায় পশ্চিমবঙ্গে এখন কৃষকদের সাংগঠনিক অবস্থাটা খুবই দুর্বল। মহারাষ্ট্রে একসঙ্গে সরকার গড়লেও এখন শিবসেনা বিজেপির প্রধান বিরোধী। একযোগে শিবসেনা, কংগ্রেস, সিপিআইএম-এর মতো দলগুলির সমর্থনে তাই কৃষক মিছিল সফল হয়েছে। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতায় থাকা তৃণমূল কংগ্রেস এবং অবশিষ্ট রাজনৈতিক দলগুলির যা সাংগঠনিক অবস্থা ও পারস্পরিক সম্পর্ক, তাতে কোনও দল বা সংগঠন কৃষকদের নিয়ে লং মার্চ করার স্বপ্ন দেখে বলে মনেও হয় না।
বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল বিভাগে যথাক্রমে শিক্ষক ও গবেষক
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy