Advertisement
০৪ নভেম্বর ২০২৪
লিউ শাও চি-র পরামর্শ ও সিপিএম

সাচ্চা কমিউনিস্ট কী করে...

জয়ন্ত ঘোষাল
শেষ আপডেট: ২৯ অগস্ট ২০১৮ ০০:০০
Share: Save:

কলকাতা গেলে সুযোগ পেলেই এক বার কলেজ স্ট্রিট যাই। প্রেসিডেন্সি কলেজের ফটক থেকে কফি হাউসকে বাঁ দিকে ফেলে হাঁটতে হাঁটতে ইউনিভার্সিটি ইনস্টিটিউট। এখানেই তো দেখেছিলাম ‘দাঁড়াও পথিকবর’। কৈশোর যৌবনের স্মৃতি। কোলাহলমুখর টেক্সট বুক আর মুড়ি ফুলুরি বিক্রেতাদের ভিড়েই ন্যাশনাল বুক এজেন্সি। সে দিন ঢুকে দেখি, বেশ কিছু পুরনো বই নব কলেবরে নব প্রচ্ছদে রঙিন হয়ে প্রকাশিত। হাতে ঠেকল লিউ শাও চি-র ‘সাচ্চা কমিউনিস্ট কী করে হবে’। চিন দেশের বিপ্লবী তাত্ত্বিক। উত্তর চিন মাঞ্চুরিয়া এলাকার শীর্ষ নেতা। ’৫৯ থেকে ’৬৮ সাল, তিনি ছিলেন চিনের চেয়ারম্যান। বহু বছর পর এই পুস্তিকাটি ফের পড়তে গিয়ে দেখলাম, তিনি বার বার লিখেছেন, সাচ্চা কমিউনিস্ট হতে গেলে প্রয়োজন আত্ম-অনুশীলন। আত্মপরীক্ষা। তুমি বড় নেতা হয়ে গিয়েছ, তাই যা বলবে সেটাই শেষ কথা? লিউ শাও চি বলছেন যে, কনফুসিয়াস পর্যন্ত বলেছেন তিনি ধীরে ধীরে ধাপে ধাপে আত্মপরীক্ষার মধ্য দিয়েই জ্ঞান অর্জন করেছিলেন। ১৫ বছর বয়সে শেখার প্রবল আগ্রহ ছিল। ৩০ বছর বয়সে চিন্তা করতে সক্ষম হন। ৪০ বছর বয়সে দূর হল অনেক বিভ্রান্তি। ৬০ বছর বয়সে সত্যকে যেন নিজের কানে শুনতে পেলেন। অতএব, মাটিতে পা দিয়ে চলতে হবে। জনগণের পার্টি, জনগণের ইচ্ছে-অনিচ্ছেকে তোয়াক্কা না করলে হবে কী করে? সে দিন কলেজ স্ট্রিটে এক মুহূর্তের জন্য মনে হল ভারতবর্ষের সেই মুদির দোকানে বসে আছি। এখানে আসলে কোনও কিছুই বদলায় না। সম্প্রতি সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়ের মৃত্যুর পরেও দলের নেতারা লিউ শাও চি-র কথা শুনতে প্রস্তুত নয়। দলের মধ্যে গণতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতার নামে প্রকাশ কারাট অ্যান্ড কোং প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত সোমনাথবাবুর প্রতি অন্যায় অবমাননাই নিক্ষেপ করেছেন। সেই প্রতিকূলতার পীড়নের মধ্যে সোমনাথবাবু দল থেকে বহিষ্কৃত হয়েছেন। কার্যত দল সামাজিক বয়কট করে তাঁকে। তাতে ক্ষতিবৃদ্ধি যত না হল লোকসভার স্পিকারের, তার চেয়ে অনেক বেশি জনগণ বিচ্ছিন্ন হল সিপিএম। বিশেষত বাংলায়। সেটা আমি-আপনি বুঝলাম আর কারাট-সূর্যকান্ত মিশ্র বুঝলেন না?

সোমনাথবাবু ১৯৭১-এ প্রথম বার নির্বাচিত হওয়ার পর থেকে ২০০৪ পর্যন্ত ভারতের অন্যতম সব চেয়ে দীর্ঘ সময়ের সাংসদ। প্রথমে ছিলেন সিপিএম সমর্থিত নির্দল প্রার্থী। তার পর পার্টি সদস্য থেকে হলেন দলের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য। ’৮৪ সালে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁকে পরাস্ত করেন। কিন্তু সোমনাথবাবু বোলপুর উপনির্বাচনে সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়কে হারিয়ে আবার লোকসভায় এলেন। সোমনাথবাবুর সঙ্গে সেই সময় থেকেই পরিচয়। অল্প দিনেই বুঝতে পারলাম, কমিউনিস্ট পার্টি করলেও তিনি ঠিক তাসের দেশের ‘চল নিয়ম মতে’র মানুষ নন। রাশভারী ব্যক্তিত্ব। মাথা গরম হয়, আবার খুব অল্প সময়েই রাগ পড়ে যায়। সংবাদপত্রের সমালোচনায় কাতর হয়ে পড়তেন। আবার মোহনবাগানের জয়লাভে সমস্ত শোক পর ক্ষণেই ভুলে যেতেন। সনিয়া গাঁধী থেকে অরুণ জেটলি সকলকেই দেখেছি ওঁর সঙ্গে এক অসাধারণ স্বাচ্ছন্দ্যে। বিশ্বকাপ চলার সময় লন্ডনে তাঁর ঘরে এসে এক সঙ্গে টিভিতে খেলা দেখে যান অরুণ জেটলির সচিব, দিল্লির বিজেপি এমএলএ। তার পর থেকে সেই এমএলএ পণ্ডিতজির সঙ্গে দারুণ বন্ধুত্ব হয়ে যায় সোমনাথদার।

এ হেন সোমনাথবাবুকে যে ভাবে দল থেকে বিতাড়িত হতে হয়, তা বহু মানুষেরই ভাল লাগেনি। বিশেষত বাঙালিরা এ ঘটনায় যে কতটা কারাট-বিরোধী হয়ে যান, সেটাও বহু সিপিএম নেতাই দিল্লিতে বসে বোঝেননি। সোমনাথদা তাঁর আত্মজীবনীতে লিখলেন, “মা-বাবাকে হারানোর পর ২০০৮ সালের ২৩ জুলাই নিঃসন্দেহে আমার জীবনের সব থেকে দুঃখের দিন।” তাঁর মৃত্যুর পর দলের কাছে সুযোগ এসেছিল ভুল শুধরে নেওয়ার। সীতারাম ইয়েচুরি দলের সাধারণ সম্পাদক। তিনি সোমনাথদার প্রতি বিশেষ ভাবে দুর্বল সেই জ্যোতিবাবুর সময় থেকেই। তবু আজ যখন গোটা দলটাই কার্যত স্বখাতসলিলে, তখনও পথের মানচিত্র বদলানোর সাহস দল দেখাতে পারল কই? কোথায় গেল লিউ শাও চি-র আত্মসমীক্ষা?

ইউপিএ সরকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে পরমাণু চুক্তিতে দস্তখত করার সিদ্ধান্ত নেওয়ার ফলে সংসদে সঙ্কট দেখা যায়। সাংবাদিক হিসেবে সেই সময়টার সাক্ষী। কারাট ২০০৮ সালের ৯ জুলাই নিজে সাংবাদিক বৈঠক করে বলেছিলেন, স্পিকারের কী করণীয় তা স্পিকারই ঠিক করবেন। এক দিকে কারাট এ সব কথা বার বার বাইরে বললেও গোপনে সোমনাথবাবুর ঘনিষ্ঠ-ব্যবসায়ী শিশির বাজোরিয়াকে স্পিকারের কাছে পাঠানো হয়। তাঁকে দলের প্রস্তাব জানানো হয়। প্রস্তাব ছিল, স্পিকার পদ থেকে ইস্তফা। তা না হলে সিপিএম দলের সাংসদদের সঙ্গে সরকারের বিরুদ্ধে ভোট দিন। সোমনাথবাবু বিরুদ্ধে ভোট দিতে রাজি ছিলেন না। এ দিকে রাষ্ট্রপতির কাছে সিপিএম সাংসদরা সমর্থন প্রত্যাহারের চিঠি দেয়, তাতে সিপিএম সদস্যদের যে তালিকা রাষ্ট্রপতির কাছে জমা দেওয়া হয়, তাতে প্রথম নাম রাখা হয় সোমনাথবাবুর। সোমনাথবাবুকে না জানিয়েই সে চিঠির কপি সোমনাথবাবু মৃত্যুর আগের দিন পর্যন্ত হাতে পাননি। যে দিন রাষ্ট্রপতির কাছে সমর্থন প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত জানাতে সিপিএম নেতারা যান, সে দিনই কারাট সোমনাথবাবুকে স্পিকার পদ থেকে ইস্তফা দিতে বলেন। সেটাই নাকি দলীয় সিদ্ধান্ত। এর পরের ইতিহাস তো আপনাদের জানা। কোনও শো-কজ় নোটিস ছাড়াই এ হেন প্রবীণ নেতাকে বহিষ্কার করা হয়। মনে পড়ে, সিপিআই নেতা প্রয়াত এ বি বর্ধন সে দিন বলেছিলেন, রাষ্ট্রপতির কাছে সমর্থন প্রত্যাহারের চিঠিতে সোমনাথবাবুর নাম দেওয়াটা ঠিক হয়নি। এ সবই আজ অতীত। পাঠক আমাকে প্রশ্ন করতে পারেন, ধান ভানতে আমার এ হেন অতীতাসক্তির কারণ কী? কারণ একটাই। লিউ শাও চি-র এই ছোট্ট লাল মলাটের পুস্তিকা।

এই পুস্তিকাটির পাশেই ছিল সরোজ মুখোপাধ্যায়ের লেখা আর এক পুস্তিকা। পার্টির শাখা সম্পাদকদের তিনি বলেছিলেন, মতাদর্শগত স্বচ্ছতা ও বিতর্ক প্রয়োজন। কিন্তু ব্যক্তিগত সম্পর্ককেও দলের মধ্যে জোর দিতে হবে। এমনকি অন্য পার্টিকর্মীদের স্বাস্থ্যের প্রতিও নেতাদের নজর দিতে বলেছিলেন তিনি। পার্টির নেতা রোবট তো নন। জনগণও তো রক্তমাংসের। দোষে-গুণে গড়া। মানুষকে নিয়েই তো দল। সোমনাথবাবু বাইরে থেকে সমর্থন নয়, সরকারের স্থায়িত্বের জন্য দলকে সরকারে যোগ দেওয়ানোর পক্ষে ছিলেন। দল সে প্রস্তাব খারিজ করে। সোমনাথবাবু তাও মেনে নেন। কিন্তু তাঁর মনে হয়েছিল, ’৭৭ সালের পর পশ্চিমবঙ্গে পঞ্চায়েত নির্বাচনে প্রথম বিপর্যয়। এ সময় দিল্লিতে সমর্থন প্রত্যাহার করলেও সমাজবাদী পার্টির সমর্থন নিয়ে যদি ইউপিএ টিকে যায়, তাতে রাজ্য সিপিএমের অবস্থা আরও শোচনীয় হবে। কারাট এই যুক্তি শুধু মানতে রাজি হননি তা-ই নয়, দলের মধ্যে এ বিষয়ে তখন কোনও বিতর্কেও তিনি প্রস্তুত ছিলেন না। হতে পারে দলের পলিটবুরো ও কেন্দ্রীয় কমিটির মধ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্য কারাটের পক্ষে। তা বলে আত্ম-অনুশীলনও হবে না?

আজ শুধু একটাই প্রশ্ন, মৃত্যুর পরও কি সোমনাথদাকে দল তাঁর মর্যাদাটুকু যথাযথ ভাবে দিতে পারত না? সরোজবাবু আর কনকদি দিল্লিতে থেকেছেন দীর্ঘ সময়। কনকদি তখন রাজ্যসভায়। ভিপি হাউসের ফ্ল্যাটে প্রায়ই গিয়ে আড্ডা মারতাম। ডালভাতও খেয়েছি কত দিন। সিপিএম সম্পর্কে তখন আরও তীব্র সমালোচনা-মুখর ছিলাম, কারণ সিপিএম শাসক দল। তবু তিনি আমাকে অচ্ছুৎ সাংবাদিক মনে করতেন না। তিনি দলের সাধারণ সম্পাদক হতে পারেন। কিন্তু মিশলে মনে হবে আমাদেরই বাড়ির জ্যাঠামশাই।

সোমনাথদার ক্ষেত্রে দল সেই ঔদার্য দেখাতে পারল না। যেটা মানুষ হিসাবে অন্য মানুষের কাছে থেকে কাম্যও। কারাটের সংখ্যার জোরের কাছে পরাস্ত হল সরোজ মুখোপাধ্যায়ের উপদেশ। বিধ্বস্ত লিউ শাও চি।

কমিউনিস্ট পার্টিতে দীপ নিবু নিবু। তবু হরতন রুইতন ইস্কাপনরা জয়ধ্বনি দিচ্ছেন, ‘বলো, কারাট রাজার জয়’! বোধশক্তির এই আলস্য ঘুচবে কবে?

অন্য বিষয়গুলি:

Somnath Chatterjee CPM Indian politician
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE