করোনা অতিমারির প্রকোপ তখন তুঙ্গে। ভাইরাল হল একটি কার্টুন। কমিক্সের একঝাঁক সুপারহিরো, সঙ্গে আমেরিকান পতাকা হাতে এক মেরিন হতোদ্যম হয়ে বসে। এক ব্যক্তি তাঁদের বলছে, এ বার পৃথিবীকে বাঁচাও দেখি, যে ভাবে সিনেমায় বাঁচাও। গত ন’মাস ধরে গোটা পৃথিবীকে ওলোটপালট করে দিয়েছে করোনা অতিমারি। এ অবস্থায় মানবসভ্যতাকে বাঁচাতে পারত এক জনই সুপারহিরো, যার নাম ভ্যাকসিন।
কমিক্সের সুপারহিরোদের মতোই অতিমারির শুরুর দিকে এই ভ্যাকসিন সুপারহিরোকেও কাল্পনিক মনে হচ্ছিল। এমনিতেই নোভেল করোনাভাইরাসের চরিত্র বুঝে ওঠাই ছিল মুশকিল। তা ছাড়া ভ্যাকসিন তৈরি করতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গাইডলাইন অনুযায়ী সময় লাগে অন্তত ১০ বছর। যে ভাবে প্রতি দিন মৃত্যু-হারের গ্রাফ লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছিল, তাতে বিজ্ঞানীদের হাতে একেবারেই সময় ছিল না।
তবে অসম্ভবকে সম্ভব করেছেন বিজ্ঞানীরা। ভ্যাকসিন এসে গিয়েছে। এ হল সত্যিকারের সুপারহিরো। তাই তাকে তৈরির কসরতও ঝক্কিদায়ক। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার রিপোর্ট অনুযায়ী মোট ৭০টি দল কোভিড ভ্যাকসিন তৈরির চেষ্টা করেছে। তার মধ্যে সফল তিনটে ভ্যাকসিন—ফাইজ়ার ও মডার্নার আরএনএ ভ্যাকসিন, অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজ়েনেকার তৈরি ভাইরাল ভেক্টর ভ্যাকসিন। তৈরি করার পদ্ধতি অনুযায়ী কোভিড ভ্যাকসিনকে মোট চার ভাগে ভাগ করা যায়। ভাইরাল ভেক্টর ভ্যাকসিন, ভাইরাস ভ্যাকসিন, নিউক্লিক অ্যাসিড ভ্যাকসিন ও প্রোটিন ভ্যাকসিন। ভাইরাল ভেক্টর পদ্ধতিতে একটি দুর্বল ভাইরাসের খোলসের মধ্যে করোনার স্পাইক প্রোটিনের জিন পুরে দিয়ে মানবদেহে প্রবেশ করানো হয়। শরীরের মধ্যে স্পাইক জিন স্পাইক প্রোটিন তৈরি করে শরীরের ইমিউন সিস্টেমকে উত্তেজিত করে তোলে। অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজ়েনেকার ভ্যাকসিন এই পদ্ধতিতে তৈরি। ভাইরাস ভ্যাকসিনের ক্ষেত্রে সার্স-কোভ-২ ভাইরাসের জেনেটিক কোডে সামান্য বদল ঘটিয়ে ভাইরাসটিকেই ভ্যাকসিন হিসেবে ব্যবহার করা হয়। ভারতের সিরাম ইনস্টিটিউট এই পদ্ধতি মেনে চলছে। নিউক্লিক অ্যাসিড ভ্যাকসিনের ক্ষেত্রে একটা লিপিডের তৈরি বলের মধ্যে ইলেক্ট্রোপোরেশন পদ্ধতিতে করোনার রাইবো নিউক্লিক অ্যাসিড (আরএনএ) প্রবেশ করানো হয়। আরএনএ যুক্ত লিপিড বলের প্রাচীর মানব কোষে প্রবেশের সময় গলে যায়। তখন নিউক্লিক অ্যাসিড মুক্ত হয়ে ভাইরাল প্রোটিন তৈরি করে। ফাইজ়ার ও মডার্নার তৈরি ভ্যাকসিন এই পদ্ধতিতে তৈরি। প্রোটিন বেসড ভ্যাকসিনে ভাইরাসের বাইরের প্রোটিনকে রাসায়নিক পদ্ধতিতে আলাদা করে ভ্যাকসিন হিসেবে ব্যবহার করার চেষ্টা হয়েছে। সাফল্য মেলেনি।
বোঝাই যাচ্ছে এ এক বিশাল কর্মযজ্ঞ। আইডিয়ার স্তর থেকে ভ্যাকসিনকে বাস্তবে পরিণত করতে দক্ষ বিজ্ঞানকর্মী ছাড়াও প্রয়োজন ছিল বিপুল অর্থের জোগান ও বিপুল পরিমাণে জিনিসপত্রের জোগান। ভ্যাকসিন গবেষণার প্রাথমিক স্তরে বিপুল পরিমাণ অর্থের জোগান দেয় গেটস ফাউন্ডেশন। এর পরে একে একে এগিয়ে আসে জ্যাক মা ফাউন্ডেশন, ওয়েলকাম ট্রাস্ট-সহ একাধিক সংস্থা। তবে অচিরেই বোঝা যায় সরকারি হস্তক্ষেপ ছাড়া এই বিরাট কর্মযজ্ঞ সম্ভব নয়। মে মাসের মাঝামাঝি ভ্যাকসিন গবেষণায় গতি আনতে অপারেশন ওয়ার্প স্পিড শুরু করে আমেরিকান সরকার।
অর্থের জোগান ছাড়াও প্রয়োজন ছিল জিনিসপত্রের জোগান। যে কোনও যুগান্তকারী বৈজ্ঞানিক গবেষণার নেপথ্যেই থাকে যন্ত্রপাতি, রাসায়নিক দ্রব্য থেকে শুরু করে ল্যাবরেটরির ব্যবস্থাপনার ভূমিকা। এ বিষয়ে তথ্য সন্ধান ও পর্যালোচনাকে বলা হয় কোনও বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের মেটেরিয়াল কালচার নিয়ে গবেষণা। ১৪ অক্টোবর ‘নেচার রিভিউজ় মেটেরিয়ালস’-এ প্রকাশিত ‘আ মেটেরিয়ালস-সায়েন্স পার্সপেক্টিভ অন ট্যাকলিং কোভিড১৯’ শীর্ষক প্রবন্ধে রয়েছে করোনা অতিমারি রুখতে ভ্যাকসিন তৈরির মেটেরিয়াল কালচারের কথা। ভ্যাকসিন গবেষণা সচল রাখতে প্রয়োজন হয়েছে অনেক কেমিক্যাল। ভাইরাস থেকে জেনেটিক পদার্থ আলাদা করা, ভাইরাসের জিনের কোনও একটি অংশকে আরটি পিসিআর পদ্ধতিতে বহুগুণে বাড়িয়ে নেওয়ার কিট, ইলেক্ট্রোপোরেশনের যন্ত্রপাতি, ভ্যাকসিনের জন্য প্রয়োজনীয় অ্যাডজুভ্যান্ট তৈরির মালমশলা, লিপিড বল তৈরি করার একাধিক রাসায়নিক দ্রব্য, আরও কত কী! বিপুল পরিমাণে মেটেরিয়ালের দ্রুত সরবরাহ ছাড়া ভ্যাকসিন ভূমিষ্ঠ হত না। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় মডার্নার নিউক্লিক অ্যাসিড ভ্যাকসিন তৈরিতে কোডেনফার্মা সংস্থার ভূমিকার কথা। এই সংস্থার কর্মীরা নিয়মিত লিপিড বল তৈরি করে গিয়েছেন এবং সরবরাহ করেছেন মডার্নার ভ্যাকসিন প্রস্তুতকারী ইউনিটে।
ব্রিটেন ও আমেরিকায় ইতিমধ্যেই টিকাকরণ শুরু হয়ে গিয়েছে। যদিও এরই মাঝে চিন্তায় ফেলেছে ব্রিটেনে করোনার নতুন মিউটেটেড স্ট্রেন-এর সংক্রমণ। তবে বিজ্ঞানীরা আশ্বস্ত করেছেন, এই নতুন রূপের এই করোনার সংক্রমণ দ্রুতগতির হলেও ভ্যাকসিনকে এড়ানোর উপায় তার নেই। তাই সুপারহিরো ভ্যাকসিন পৃথিবী রক্ষায় তৈরি। ২০২০-তেই তার মর্তধামে অবতরণ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy