Advertisement
২৭ নভেম্বর ২০২৪
Editorial news

লকডাউন, লকডাউন, লকডাউন

ইটালি, স্পেন, ফ্রান্স, দক্ষিণ কোরিয়ার এবং চিনের অভিজ্ঞতা বলছে এখনও সতর্ক হলে আমরা দাবানল রোধ করতে পারি। লকডাউনের বর্মে করোনাকে আটকাব, না মূঢ়ের মতো বাঘের গলায় মালা পরানোর জন্য তার খাঁচায় ঝাঁপ দেব?ইটালি, স্পেন, ফ্রান্স, দক্ষিণ কোরিয়ার এবং চিনের অভিজ্ঞতা বলছে এখনও সতর্ক হলে আমরা দাবানল রোধ করতে পারি। লকডাউনের বর্মে করোনাকে আটকাব, না মূঢ়ের মতো বাঘের গলায় মালা পরানোর জন্য তার খাঁচায় ঝাঁপ দেব?

প্রতীকী ছবি।

প্রতীকী ছবি।

শর্মিষ্ঠা দাস
শেষ আপডেট: ২৯ মার্চ ২০২০ ১০:৪৯
Share: Save:

পৃথিবী নামক গ্রহটি আজ নতজানু ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র এক ভাইরাসের কাছে। এতই বেয়ারা সে করোনা (কোভিড-১৯) যে, কোনও রাজা উজিরের পেশির আস্ফালন, কোনও ধর্মীয় বিভাজনের বেড়া, কোনও ধনীর অর্থে গড়া ঘেরাটোপ মানছে না!

গত ৩১ ডিসেম্বর চিনের উহানে যখন প্রথম রোগীটি পাওয়া গেল, আমরা খবরটা শুনিনি। এর পরে যখন সেখানে মহামারি হল, আমরা ভাবলাম, হুবাই প্রদেশের স্থানীয় রোগ। যখন তা ইটালিতে ছড়াল, তখনও ভাবছি আমরা নিরাপদ দূরত্বে আছি। মার্চের ৯ তারিখ বিশ্ব স্বাস্থ্যসংস্থা (হু) বিশ্বজুড়ে অতিমারি (গ্লোবাল প্যানডেমিক) ঘোষণার পরেও আমাদের রোজকার যাপনে কোনও বিচ্যুতি দেখা যায়নি। ঠিক এমনটাই হয়েছিল ইটালিতে। মার্চের প্রথমে সরকার, স্বাস্থ্য দফতর চূড়ান্ত সতর্কতা জারি করেছিল। সে নিষেধ তুড়ি মেরে উড়িয়ে যথেচ্ছ বাড়ির বাইরে বেরনো, পার্টি, সামাজিক মেলামেশা চলেছে। ইটালি ও স্পেনে লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা। পিছিয়ে নেই আমেরিকা, ফ্রান্সও। গণকবর, গণদাহ চলছে। সবচেয়ে দুঃখজনক যাঁরা মারা গিয়েছেন তাঁদের অধিকাংশই কোনও চিকিৎসার সুযোগ পাননি। কারণ, পৃথিবী এখনও করোনা মোকাবিলায় পুরোপুরি প্রস্তুত হতে পারেনি। এখন মহামারি ক্যালকুলেটর অনুযায়ী, প্রতি দিন নতুন রোগীর খোঁজ মিলছে। এবং নতুন রোগীর সংখ্যাটা বাড়ছে। প্রতি দু’দিনে রোগীর সংখ্যা কয়েক গুণ হচ্ছে। আমাদের দেশে ও রাজ্যে সংখ্যাটা এখন ইটালি বা স্পেনের তুলনায় কম হলেও নিশ্চিন্তে বসে থাকার উপায় নেই। দ্রুত দরকার করোনা গ্রাফের এই অতিদ্রুত ক্রম ঊর্ধ্বমুখী বৃদ্ধিকে একটু চ্যাপ্টা করে দেওয়া (ফ্ল্যাটেনিং অব কার্ভ)। যেটা সরকার ও জনগণের যৌথ সহযোগিতাতে অসম্ভব নয়।
ক’দিন আগে পর্যন্ত, ভারতে করোনা প্রবেশের প্রথম দিকে সাধারণ মানুষের জন্য নির্দেশ ছিল, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা, কোনও জমায়েত এড়িয়ে চলা, সিনেমা হল, শপিং মল বয়কট, মাস্ক, হাত ধোওয়া ইত্যাদি ব্যক্তিগত সুরক্ষা। আক্রান্ত ও সম্ভাব্য আক্রান্ত রোগীদের সংস্পর্শে এসেছেন যাঁরা, তাঁদের জন্য ১৪ দিন সেলফ কোয়ারেন্টাইন, আক্রান্তদের সম্পূর্ণ আইসোলেশন। এখন সে পর্যায় আমরা পেরিয়ে এসেছি।
আমাদের সৌভাগ্য যে, আমাদের সামনে ইটালি, স্পেন, ফ্রান্স, দক্ষিণ কোরিয়ার এবং সর্বোপরি চিনের অভিজ্ঞতা আছে। অনেক দেশ সে সুযোগ পায়নি। এখনও আমরা যথেষ্ট সতর্ক হলে আগুনের ফুলকি থেকে দাবানল রোধ করতে পারি। সতর্কতার বর্মে সেই ‘করোনাসুর’-কে আটকাব, না মূঢ়ের মতো বাঘের গলায় মালা পরানোর জন্য তার খাঁচায় ঝাঁপ দেব?

চতুর্দশ শতাব্দীর সেই কুখ্যাত প্লেগ মহামারির পরে এত বড় বিপদ মানুষের সামনে আসেনি। বিপদের চোখ, মুখ, নাক, কান গতিবিধি এখনও সম্পূর্ণ জানা নেই। বিশেষজ্ঞেরা এখন পর্যন্ত পাওয়া তথ্যের উপরে নির্ভর করে যে নির্দেশিকা জারি করেছেন, তা অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলা ছাড়া উপায়ান্তর নেই।
ঠিক এই মুহুর্তে আপ্তবাক্যের মত শুধু আওড়াতে হবে, লকডাউন, লকডাউন, লকডাউন। গত ২৪ মার্চ মধ্যরাত থেকে ভারত জুড়ে লকডাউনের ঘোষণা করেছেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী নরেদ্র মোদী। ২১ দিন ধরে চলবে লকডাউন। অত্যন্ত জরুরি পদক্ষেপ। এখন আপৎকালীন প্রয়োজন ছাড়া একদম বাড়ি থেকে বেরোবেন না। কিন্তু দেখা যাচ্ছে এখনও অনেক তথাকথিত ‘শিক্ষিত’ মানুষ মূর্খের স্বর্গে বাস করছেন। যাঁরা অন্য শহর থেকে ছুটিতে বাড়ি এসে বন্ধুদের ফোনে ডাকছেন, ‘চলে আয়, বোর হচ্ছি। ছোট গেট্টু’। যাঁরা ফ্ল্যাট কমপ্লেক্স চত্বরে গায়ে গা লাগিয়ে দেশের অর্থনীতি, রাজনীতি নিয়ে আড্ডা দিচ্ছেন তাঁদের ‘জরুরি’ কথাটার অর্থ অনুধাবন করা দরকার, পৃথিবীর স্বার্থে।

গত ১০ মার্চ টমাস পুয়ো করোনা আটকাতে ‘হ্যামার অ্যান্ড ডান্স’ নামে যে লেখাটি প্রকাশ করেছেন, বিশ্বজুড়ে সবাই এখন পর্যন্ত সেই মডেলটিকে সর্বাধিক মান্যতা দিয়েছেন। ক’দিন পর্যন্ত বেশি ভাবা হচ্ছিল আক্রান্ত, সংস্পর্শে আসা মানুষদের কথা। মহামারিতে সবচেয়ে মারাত্মক হল তৃতীয় পর্যায়, যখন পুরো সমাজে রোগ ছড়িয়ে পরে, রোগের উৎস প্রাথমিক ভাবে কোনও রোগী, কোন জায়গা তা আর খুঁজে পাওয়া যায় না। মনে রাখবেন এক জন রোগী তিন জনকে আক্রান্ত করেন। এক থেকে তিন, তিন থেকে নয়, নয় থেকে...। আরও ভয় এই কারণে যে, ভাইরাস শরীরে ঢুকলেও রোগী নিজে প্রথমে বুঝতে পারেন না তিনি আক্রান্ত। শরীরে রোগের লক্ষণ প্রকাশের আগেও তিনি রোগ ছড়িয়ে যান। কোভিড-১৯ শরীরে ঢোকা আর রোগের লক্ষণ প্রকাশের (ইনকিউবেশন পিরিয়ড) সময় মোটামুটি সর্বোচ্চ ১৪ দিন বলা হচ্ছে। এক বার তৃতীয় পর্যায়ে পৌঁছে গেলে রোগ নিয়ন্ত্রণ আয়ত্তসীমা পেরিয়ে যায়। ইটালির মতো দেশে যা হয়েছে। ভারতের মতো উন্নয়নশীল দেশে অতিমারি তৃতীয় পর্যায়ে পৌঁছলে কী হবে কেউ জানি না। তাই তৃতীয় পর্যায়ে যাবার আগেই লকডাউন দরকার। লকডাউন হল সেই হাতুড়ি, যা দিয়ে নতুন রোগীর ঊর্ধ্বগামী রেখাটিকে চ্যাপ্টা করে একটু সোজা করা যায়। সোজা কথায়, জরুরি পরিষেবায় নিযুক্ত লোকজন ছাড়া প্রত্যেকে যদি গৃহবন্দি থাকেন, তা হলে, নতুন আক্রান্তের সংখ্যা অনেকটাই কমে যাবে, রোগের বিস্তার আটকানো যাবে। পশ্চিমী দেশের উদাহরণ দিয়ে টমাস পুয়ো বুঝিয়েছেন, অর্থনীতি কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হলেও তা মানতে হবে। কারণ, মানুষের জন্যই অর্থনীতি, অর্থনীতির জন্য মানুষ নয়। অর্থনীতি চাঙ্গা রাখার জন্য লক্ষ লক্ষ মানুষ মারা গেলে সবই ধসে পড়বে। ইতিমধ্যেই মুখ থুবড়ে পড়েছে ইটালির স্বাস্থ্য ব্যবস্থা। যদি প্রতি দিন হাজারে, লক্ষে করোনা রোগী আসতে শুরু করলে পৃথিবীর উন্নত দেশগুলিরই সেই চাপ সামলানোর মতো পরিকাঠামো নেই। সে সময়ে হার্ট অ্যাটাকের রোগীও প্রয়োজনে ভেন্টিলেটর পাননি। এ রকম অজস্র সমান্তরাল ক্ষতি হয়েছে, হচ্ছে।

তা হলে ভারতবাসী এই লকডাউন ঠিকমতো মানলে কী হবে? কিছু দিন লকডাউনে থাকলে নতুন রোগী কমতে বাধ্য। এ বার কিছুটা সময় পাওয়া গেল। টমাস পুয়ো এই সময় নেওয়ার কথা তুলনা করেছেন যুদ্ধক্ষেত্রের সঙ্গে। অজানা শত্রুর উপরে ঝাঁপিয়ে পড়ে প্রাণ না দিয়ে একটু পালিয়ে এসে, লুকিয়ে থেকে কী ভাবে শত্রুকে জব্দ করা যায়। এটাই বুদ্ধিমানের কাজ। লকডাউনকে ভাবুন সেই লুকিয়ে থাকা। ২১ দিনের মধ্যে করোনার ওষুধ, টিকা হয়তো বেরোবে না, কিন্তু আমরা হাতে একটু সময় পাব। চিন কিন্তু এ ভাবেই অনেকটা সামলে উঠেছে।

এডস, টিবি, ম্যালেরিয়ার মতো করোনা মোকাবিলার এখন পর্যন্ত সর্বসম্মত কোনও নির্দিষ্ট গাইডলাইন, প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত স্বাস্থ্যকর্মী, চিকিৎসা পরিকাঠামো, দেশের সর্বস্তরে পরীক্ষার সুব্যবস্থা বিশ্বের কোথাও নেই। আপৎকালীন ভাবে প্রতি দিন গাইডলাইন বদলাচ্ছে। নতুন রোগীর চাপ কমলে স্বাস্থ্য ব্যবস্থা একটু ফুরসত পাবে। নিজেকে নতুন শত্রুর উপযোগী করে গড়ে তুলবে, নতুন স্বাস্থ্যবিধি, করোনা চিকিৎসাকেন্দ্র, প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত কর্মী তৈরি হবে। অল্প সংখ্যক নতুন রোগী এলেও তারা অন্তত বিনা ভেন্টিলেটরে মরবেন না। এখনও প্রয়োজন অনুযায়ী সবকিছু অত্যন্ত অপ্রতুল। এ রোগ নিজে থেকে জন্মায় না। শুধু অন্য কোনও আক্রান্ত মানুষের সংস্পর্শে এলেই হয়। এ ক’টা দিন একটু নিজের সঙ্গে নিজে কাটান। ভুলে যাওয়া গানের কলি, প্রিয় বই, শখের রান্না, বাগান পরিচর্যা, টিভি, ইন্টারনেট আর মুঠোফোনে... এই ‘হ্যামারিং’ পর্যায়টা পেরিয়ে গেলেই তো আসছে ‘ডান্স’ এর সময়। এই বিপন্ন সময়ে কেন্দ্র ও রাজ্য সরকার দেখবেন দরিদ্র মানুষগুলির বাড়িতে যেন হাঁড়ি চড়ে। দুই সরকারই এ বিষয়ে সক্রিয় হয়েছে। আগামী বসন্তকে আলিঙ্গন করার জন্যেই এ বসন্তকে ঘরে বসে উপভোগ করুন।

দুর্গাপুরের চিকিৎসক ও সাহিত্যকর্মী

(অভূতপূর্ব পরিস্থিতি। স্বভাবতই আপনি নানান ঘটনার সাক্ষী। শেয়ার করুন আমাদের। ঘটনার বিবরণ, ছবি, ভিডিয়ো আমাদের ইমেলে পাঠিয়ে দিন, feedback@abpdigital.in ঠিকানায়। কোন এলাকা, কোন দিন, কোন সময়ের ঘটনা তা জানাতে ভুলবেন না। আপনার নাম এবং ফোন নম্বর অবশ্যই দেবেন। আপনার পাঠানো খবরটি বিবেচিত হলে তা প্রকাশ করা হবে আমাদের ওয়েবসাইটে।)

অন্য বিষয়গুলি:

Coronavirus Health COVID 19
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy