ছবি: পিটিআই।
দেড় মাস যাবৎ যাঁহাদের কাজ নাই, দুই বেলার অন্ন সংস্থান করিতে যাঁহাদের শেষ সম্বলটুকুও হাতছাড়া হইয়া গিয়াছে, আজ ঘরে ফিরিতে চাহিলে ট্রেনের টিকিটের পয়সা তাঁহাদেরই দিতে হইবে। এই কথাটি যদি কোনও অর্থপিশাচ ব্যবসায়ী বলিত, অথবা কোনও নির্মম সামন্তপ্রভু, সভ্য সমাজ তাহাদের প্রতি ঘৃণা জানাইত। কিন্তু, কথাটি যখন দেশের সরকার বলে— কল্যাণরাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক পন্থায় নির্বাচিত সরকার, যাহা ‘সব কা সাথ, সব কা বিকাশ’-এর কসম খাইয়া মসনদে বসিয়াছে— তখন ধিক্কার জানাইবারও আর ভাষা থাকে না। সনিয়া গাঁধীর বিবৃতিতে বজ্রাহত সরকার এবং বিজেপি যত চেষ্টা করিয়াছে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার, ততই স্পষ্টতর হইয়া উঠিয়াছে সংবেদনশীলতার এই অপরিসীম অভাব। সামান্য পাটিগণিতের হিসাব বলিতেছে, বিজেপির মুখপাত্ররা যে ৮৫ শতাংশ ভর্তুকির গল্প শোনাইতেছেন, তাহা নিছক চালাকি— রেলের টিকিটের ভাড়া যাহা ছিল, তাহাই আছে; যাত্রিসংখ্যা কমায় রেলের ভর্তুকির পরিমাণ বাড়িয়াছে মাত্র। রেল দফতরের বিজ্ঞপ্তিতেও স্পষ্ট, মূল পরিকল্পনা ছিল অভিবাসী শ্রমিকদের নিকট হইতেই টিকিটের মূল্য আদায়ের, এখন বিপাকে পড়িয়া রাজ্য সরকার ইত্যাদি অজুহাত খুঁজিতে হইতেছে। জাতীয় সঙ্কটকালে অসহায় দেশবাসীর প্রতি অপরিসীম অসংবেদনশীলতার এমন উদাহরণ সহসা মিলে না।
অভিবাসী শ্রমিকদের হইতে ভাড়া আদায় করিবার এই সিদ্ধান্তটি এক অর্থে লকডাউন পর্বে সরকারের এই জনগোষ্ঠীর প্রতি মনোভাবের অভিজ্ঞান। মাত্র চার ঘণ্টার নোটিসে দেশব্যাপী লকডাউন চালু করাই হউক, মাসাধিক কালেও অভিবাসী শ্রমিকদের জন্য কোনও সার্বিক নীতি ভাবিতে না পারাই হউক, বিপন্ন শ্রমিকদের অসহায় ক্ষোভকে পুলিশের লাঠিতে দমন করাই হউক— গত চল্লিশ দিনে কেন্দ্রীয় সরকার বারে বারে প্রমাণ করিয়াছে, এই বিপুল জনগোষ্ঠীর দাম তাহাদের নিকট কানাকড়িও নহে। শ্রমিকরা ভিক্ষার অন্নে দিন গুজরান করিয়াছেন, তাহার সহিত বাড়তি জুটিয়াছে অপমান। মাইলের পর মাইল হাঁটিয়া ঘরে ফিরিবার চেষ্টা করিয়াছেন তাঁহারা, মাঝপথেই মারা গিয়াছেন অনেকে, সরকার তবু তাঁহাদের কথা ভাবিয়া উঠিতে পারে নাই। বিদেশ হইতে বিমান ভরিয়া উচ্চবিত্তদের দেশে ফিরাইয়াছে সরকার। রেল পিএম কেয়ারস তহবিলে ঝুলি উপুড় করিয়াছে। কিন্তু অভিবাসী শ্রমিকদের ঘরে ফিরাইবার টাকা দিতে সরকার নারাজ। উগ্র জাতীয়তাবাদী নেতারা সর্বদা যে দেশের কথা বলিয়া থাকেন, সেই রাষ্ট্রকল্পনায় এই ক্লিষ্ট মানুষদের অস্তিত্ব নাই বলিয়াই।
অভিবাসী শ্রমিকদের ঘরে ফিরাইবার টাকা কংগ্রেস দিবে বলিয়া সনিয়া গাঁধীর ঘোষণায় বিজেপি নেতারা রাজনীতির গন্ধ পাইয়াছেন। রাজনীতি, বিলক্ষণ। দেশের প্রধান বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেত্রীর সিদ্ধান্তে রাজনীতি থাকিবে বইকি। কিন্তু, এই রাজনীতির উদাহরণ ভারতে বিরল। সরকারকে বারংবার নিজের দায়িত্বের কথা স্মরণ করাইয়া দেওয়ার পরও যদি সরকারের হুঁশ না ফিরে, তখন বিরোধীদেরই মানুষের স্বার্থরক্ষা করিতে পথে নামিতে হয়। নিজেদের সাধ্য অনুসারে— কখনও বা সাধ্যের সীমা অতিক্রম করিয়াও। কেন্দ্রীয় সরকারের অস্বস্তিতে স্পষ্ট, ঔষধে কাজ হইতেছে। সরকারের লজ্জা হইয়াছে, বলিলে সম্ভবত অত্যুক্তি হইবে। লজ্জা বস্তুটি তাঁহারা বহু পূর্বেই সবরমতীর জলে বিসর্জন দিয়াছেন। কিন্তু, দেশের মানুষের সম্মুখে সরকারের নীতির অনৈতিকতা এমন বেআব্রু হইয়া যাওয়ায় তাঁহারা সম্ভবত ভয় পাইয়াছেন। অসংখ্য ম্লান মূক মুখের মিছিলেও যাঁহাদের বিবেক জাগ্রত হয় না, ভোট হারাইবার ভয় যদি তাঁহাদের খানিক মানবিক হইতে বাধ্য করে, তবে গণতন্ত্রের দোহাই, সেই পবিত্র ভয়টিকে বাঁচাইয়া রাখিতে হইবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy