এক দিকে চাপ দেওয়া হচ্ছে, নাগরিকদের লকডাউন মেনে চলাতে হবে। আর তার ব্যবস্থা করতে হবে পুলিশকেই। অন্য দিকে, সতর্ক করে দেওয়া হচ্ছে পুলিশকে মানবিক হতে হবে। করোনাভাইরাস এসে পুলিশের কাজ আরও বাড়িয়েছে। কোথায় কোন আক্রান্ত হোম কোয়রান্টিনে গেলেন, কোথায় কোন শ্রমিক রেললাইন ধরে হেঁটে বাড়ি ফিরতে গিয়ে বিপদ বাঁধালেন— সব দিক খেয়াল রাখতে হচ্ছে। তার উপরে আনাজ-মাছ, মাংস, মুদি, মিষ্টির সহ সকল দোকান খোলার অনুমতিও দিয়েছে রাজ্য সরকার। যার জেরে মানুষ বাইরে বেরিয়ে পড়েছে। যা রোখার জন্য পুলিশকে কড়া হতে দেখা গিয়েছে অনেক ক্ষেত্রেই। তা নিয়ে হয়েছে সমালোচনা। তার পরেই পুলিশের হাত বেঁধে দেওয়া হয়েছে। সব মিলিয়ে, দিশেহারা অবস্থা পুলিশের। অনেক পুলিশকর্মীর মধ্যে তা নিয়ে ক্ষোভও তৈরি হয়েছে।
পুলিশকর্মীদের একাংশের কথায়, যখন করোনাভাইরাসের আতঙ্কে সবাই ঘরবন্দি হয়ে রয়েছে, সেই সময় পুলিশকর্মীরা মাঠে নেমে প্রথম সারিতে দাঁড়িয়ে কাজ করছেন। নিজেদের জীবনের ঝুঁকি নিয়েও। সাবধানতার জন্য রয়েছে শুধু মুখে কাপড়ের মাস্ক, কারও কারও হাতে গ্লাভ্স। কোথাও ভিড় জমেছে বা পরিযায়ী শ্রমিক আসা নিয়ে পাড়ায় বা গ্রামে ঝামেলা হচ্ছে খবর এলেই পুলিশকে ছুটতে হচ্ছে সেখানে। এমনকি, সারি হাসপাতাল থেকে পালিয়ে যাওয়ার রোগীকেও ধরতেও পুলিশই ছুটছে।
করোনা নিয়ে আতঙ্ক পুলিশে কাজ করা মানুষগুলোর মনেও রয়েছে। তবে তা প্রকাশ করার কোনও উপায় নেই। কারণ, তাঁদের তো দায়িত্ব পালন করাটাই পেশাদারিত্ব। তাতে দু’-চার পুলিশের লোকের মধ্যে সংক্রমণ ছড়াতেই পারে, তাই বলে তো প্রশাসনিক দায়দায়িত্ব এড়িয়ে যেতে পারে না রাজ্যের পুলিশ। জেলার পুলিশের কর্মীদের কথায়, এই সময়ে অপরাধমূলক কাজের সঙ্গে যুক্ত বা অভিযুক্ত যে সকল লোকজনকে ধরা হচ্ছে, তাদের মধ্যে যে কেউ করোনা পজিটিভ নয়— সে-ই বা কে জানে! ‘‘কিন্তু আমাদের কাজ করতেই হচ্ছে। আবার, ডিউটির মধ্যে সব সময়ে গাড়ি জীবাণুমুক্ত করার কাজও করা সম্ভব হচ্ছে না।’’ বলছেন এক পুলিশকর্মী।
তাই এর পরেও যদি নাগরিকদের থেকে পুলিশকর্মীরা সব রকমের সহযোগিতা না পান, সে ক্ষেত্রে তাঁদের এই ভয়ঙ্কর চাপের মধ্যে নিজেদের কাজ করে যাওয়াটা কঠিন হবে বলেই দাবি পুলিশকর্মীদের। তাঁদের আরও অভিযোগ, কিছু মানুষ অহেতুক রাস্তায় ঘুরে বেড়াচ্ছে। তাদেরকে পুলিশ বোঝাতে গেলেই তাদের মধ্যে কেউ কেউ পুলিশকর্মীদের সঙ্গে খারাপ ব্যবহারও করেছেন।
তার মধ্যেও পরিবার-পরিজন ছেড়ে, রাস্তায় নেমে সাধারণ মানুষের জন্য কাজ করে যাচ্ছে পুলিশ।
কৃষ্ণনগর জেলা পুলিশের পক্ষ থেকে প্রতি দিন নিয়ম করে নানা এলাকায় রান্না করা খাবার তুলে দেওয়া হচ্ছে দুঃস্থ মানুষজনের হাতে। আবার, প্রতি থানা এলাকায় বিভিন্ন গ্রামে দুঃস্থ মানুষদের চিহ্নিত করে তাঁদের হাতে শুকনো খাবার পৌছে দিচ্ছে পুলিশ। শুধু মানুষই নয়, এই অতিমারির সময়ে রাস্তার পশুরা যাতে না খেতে পেয়ে মারা যায় সেই দিকেও নজর দিচ্ছে পুলিশ। কালীগঞ্জ থানার ওসি অনিমেষ দে নিজে প্রতিদিন রাতে রান্না করা খাবার এলাকার পথকুকুরদের কাছে পৌছে দিচ্ছেন।
করোনার কারণে পুলিশের সব ছুটি বাতিল করে দেওয়া হয়েছে। ইচ্ছে থাকলেও কেউ ছুটি নিয়ে যেমন বাড়ি যেতে পারবেন না, তেমনই বাড়ি থেকেও কেউ আসবেন না। এক পুলিশকর্মীর কথায়, বাড়িতে মা অসুস্থ। দুটো বাচ্চা রয়েছে আমার। ওরা বারবার ফোন করে বাড়ি যাওয়ার কথা বলে। খারাপ লাগে আমার। কিন্তু কোনও উপায়ও তো নেই। ওদের আবদার রাখতে মাঝে মধ্যে ভিডিয়ো কল করতে হয়। কিন্তু তাতে কি বাবার অভাব মেটে, বলুন?’’ অভাব মেটে না কারওরই। কেউ বাড়িতে বসে দূরে থাকা বাবাকে কাছে পাওয়ার জন্য হা-হুতাশ করে। আর কেউ এই কঠিন সন্তানের পাশে না থাকতে পারার জন্য আপশোস সঙ্গে নিয়ে রোজ ডিউটি করে চলেন। কখনও বয়স্ক মানুষের বাড়ি খাবার পৌঁছে দেওয়ার অনুরোধ আসে। কখনও দাগি আসামিকে খুঁজতে বেরোতে হয়। আবার কখনও বাজারে অকারণ জটলা করা মানুষের সামনে গিয়ে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে তাঁদেরকে বাড়ি ফেরাতে হয়। যাতে গোটা এলাকা সুস্থ থাকে। যাতে অন্যেরা নিজের সন্তানের কাছে থাকতে পারেন।
তবে যাঁরা পরিবার নিয়ে একসঙ্গে থাকেন, তাঁরাও নানা ধরনের সমস্যায় পড়ছেন। কালীগঞ্জের এক পুলিশকর্মী তাঁর পরিবার নিয়ে কালীগঞ্জে থাকেন। প্রতি দিন নানা জায়গায় নানা লোকের সঙ্গে মিশতে হচ্ছে তাঁকে। তাঁর কথায়, ‘‘বাড়িতে বাচ্চা রয়েছে, তাই সব সময়ে সাবধানে থাকতে হয়। কিছু কিছু সময় খারাপ লাগে, ডিউটি সেরে বাড়ি আসতেই ছেলে ছুটে কোলে আসতে চায়। কিন্তু ইচ্ছে থাকলেও উপায় থাকে না। ওর মা ওকে আটকায়।’’
করিমপুরের এক পুলিশকর্মী জানাচ্ছেন, লকডাউনের শুরু থেকে প্রায় গত দু’মাস ধরে বাড়ি যেতে পারছেন না। তিনি বলেন, ‘‘বাড়িতে দুই মেয়ে ও স্ত্রী একা। ওদেরও সমস্যা হচ্ছে। কিন্তু এই দিক ছেড়ে যাওয়ারও সম্ভয় নয়। মেয়েরা ফোন করে বাড়ি যাওয়ার জন্য বলে। খারাপও লাগে। তবে উপায় নেই। কখনও কখনও ওদের জন্য চিন্তা হলেও ওটা সঙ্গে নিয়েই চলতে হয়।’’
পুলিশের কাজের ভুল নিয়ে প্রচুর আলোচনা হয়। কিন্তু তাদের কাজের ঠিকগুলো নিয়ে আলোচনা করার, পরিশ্রমের স্বীকৃতি দেওয়ার লোকের বড় অভাব। তাই রাস্তায় লোকের ভিড় দেখলেই আমরা আঙুল তুলছি— পুলিশ কিছুই দেখে না, কোথাও কাজ করে বলে। প্রশ্ন হল— আমরা নিজেরা কতটা সচেতন নাগরিক?
তবে নাকাশিপাড়ার এক পুলিশকর্মী জানাচ্ছেন, মানুষ যে লকডাউন একেবারেই মানছে না, এটা ভুল। কিছু কিছু মানুষ বাধ্য হয়েই বাইরে বেরিয়ে পড়ছে। তাঁর যুক্তি, যে সকল শ্রমিকরা বাইরে থেকে বাড়ি ফিরছেন, তাঁদের থাকার পর্যাপ্ত ঘর না থাকার কারণেই বাড়ির বাইরে বেরোচ্ছেন তাঁরা। তবে তাঁদেরকে বলা হলে কথাও শুনছেন তাঁরা। লকডাউনের মধ্যে নাকাশিপাড়ার টোল প্লাজা সংলগ্ন এলাকায় একটি চায়ের দোকান খোলা হয়েছে অভিযোগ পেয়ে সেখানে যেতেই দোকানের মালিক এক বয়স্ক ব্যক্তি বলেন, ‘‘আমার কিছু করার নেই। বাড়িতে খাবার কিছুই নেই। তাই বাধ্য হয়ে চায়ের দোকান খুলেছি।’’ তার পরে পুলিশের পক্ষ থেকে তাঁকে বেশ কিছু খাদ্যসামগ্রী দেওয়া হয়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy